![ক্ষণজন্মা তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য](uploads/2024/05/10/sukanto-1715317103.jpg)
সুকান্তের কবিতার উৎকর্ষ ও সৌন্দর্য বুঝতে হলে তার কবিতা পড়তে হবে। কবিতার ছন্দ ও অলঙ্কার বিশ্লেষণ করলে তার সামর্থ্য ও উৎকর্ষ ধরা পড়বে। তিনি ছোটগল্প ও কয়েকটি প্রবন্ধও লিখেছেন। সেগুলোতে তার ভাষাগত ও চিন্তাগত উৎকর্ষের পরিচয় আছে। শিশুদের জন্য লেখা তার ছড়া ও গল্পগুলোতেও উৎকর্ষের পরিচয় মেলে। তার চিঠিপত্র পড়লে বোঝা যায়, মার্কসবাদী হয়েও তিনি মতান্ধ হননি, সব মানবীয় প্রবণতা তার মধ্যে সজীব ছিল। তার গদ্যও আকর্ষণীয় ও পরিচ্ছন্ন।...
সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট (৩০ শ্রাবণ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ)। মাতামহ সতীশচন্দ্র ভট্টাচার্যের কলকাতার কালীঘাটে ৪২ নম্বর মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়ির দোতলার একটি ছোট্ট ঘরে। পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া। সুকান্তের পিতা শ্রী নিবারণ চন্দ্রের দ্বিতীয় স্ত্রী শ্রীমতি সুনীতি দেবীর কোল আলো করে বেড়ে উঠেছিল সুকান্ত। সুকান্তের বয়স যখন ১২ বছর তখন ১৯৩৮ সালে মা মারা যান। সেই থেকে সুকান্ত পিতামহের বাড়িতে প্রতিপালিত হতে থাকেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার সুন্দর একটি পরিবেশ ছিল সুকান্তের বাড়িতে। শিশু সুকান্তের দিন কাটত ঠাকুরমার ঘরে কিংবা কখনো তার প্রিয় রানীদির কোলে। এই রানীদিই নাম রাখেন সুকান্ত।
শিক্ষাজীবনে সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪৫ সালে বেলেঘাটা দেশবন্ধু স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের পক্ষে ‘আকাল’ (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘দৈনিক স্বাধীনতার’ (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে ‘ছাড়পত্র’। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪৭ সালের ১৩ মে কলকাতার যাদবপুরে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য আসলে জাত কবি। তার পুরো অস্তিত্বের অস্থিমজ্জায় এই কাব্যিকতা বিদ্যমান ছিল। কবির স্বল্পাবয়ব জীবনপরিধিতে যা কিছু ছিল সবই মানুষের অধিকার রক্ষায় মুখর। রাজনীতি-অর্থনীতি, মিটিং-মিছিল, আন্দোলন-সংগ্রাম, স্বাধিকার-সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ, দুর্ভিক্ষ-দৈন্য-কোনোকিছুই কবির পথ চলাকে বিঘ্নিত করতে পারেনি। জীবন ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হতে পারে, কিন্তু মানবতার প্রশ্নে অধিকার রক্ষার সংগ্রাম কখনো থমকে যেতে পারে না। সুকান্ত ভট্টাচার্য জীবনপণ সংকল্পের মধ্য দিয়ে তা-ই প্রমাণ করেছেন। ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় সুকান্ত ভট্টাচার্য দৃপ্তকণ্ঠে বলেন-
‘এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপনে পৃথিবীর সবার জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
কবির এই প্রত্যয়-ভাবনা শুধুমাত্র কবিত্ব কল্পনার লীলাবিলাস নয়। কথায়, কাজে, মনে ও জীবনের অন্যসব আয়োজন মানুষের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। ১৯৪৫ সালে সুকান্তের মেজো বৌদিকে এক পত্রে বলেন, ‘আমি কবি বলে নির্জনতাপ্রিয় হবো, আমি কি সেই ধরনের কবি? আমি যে জনতার কবি হতে চাই, জনতা বাদ দিলে আমার চলবে কী করে?’ প্রত্যক্ষ জীবনবাস্তবতা নিয়ে সুকান্ত কবি হতে চেয়েছিলেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য একটি কবিতায় বলেন-
‘আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়
আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়
আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে
আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে।’
সুকান্ত সাহিত্য মহলে আমাদের আত্মার আত্মীয় হয়ে ওঠেন। অনেকে সুকান্ত ভট্টাচার্য উচ্চারণ করতেই পাশাপাশি ‘হে মহাজীবন’ কবিতাটি উদ্ধৃত করেন। এই কবিতায় সুকান্ত বলেন-
‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’
প্রসঙ্গত, বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারাজীবন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থেকে কাব্য সাধনা করতে চেয়েছেন। কারণ তিনি জন্ম ও কর্মসূত্রে এক অভিজাত মহলে জীবনযাপন করেছেন। এর ফলে তার কাব্যসাধনাও অসম্পূর্ণ বলে তিনি মনে করেন। কবি ‘ঐকতান’ কবিতায় লিখেছেন-
‘আমার কবিতা আমি জানি
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।’
রবীন্দ্রনাথের এই আক্ষেপ সারাজীবনই ছিল। তাই তিনি কবিতায় লিখেছেন-
‘যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।’
রবীন্দ্রনাথের এই কাঙ্ক্ষিত কবিপুরুষই সুকান্ত ভট্টাচার্য বলে অনেকেই মনে করেন। সমালোচক শ্রীযুক্ত জগদীশ ভট্টাচার্য ১৯৪৭ সালে পরিচয় শারদীয়তে ‘কবি কিশোর’ প্রবন্ধে বলেন, ‘যে কবির বাণী শোনবার জন্য কবিগুরু কান পেতে ছিলেন, সুকান্ত সেই কবি। শৌখিন মজদুরি নয়, কৃষাণের জীবনের সে ছিল সত্যকার শরিক। কর্মে ও কথায় তাদেরই সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিল তার। মাটির রসে... ঋদ্ধ ও পুষ্ট তার দেহমন। মাটির বুক থেকে সে উঠে এসেছিল।’ বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রপূর্ব যুগে যে কাব্যধারা প্রবাহিত- সুকান্ত ভট্টাচার্য এর মধ্যে একটা যুগ-যুগান্তর সৃষ্টি করেন।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জীবনানন্দ দাশসহ সে সময়ের বড় বড় কবির ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি। নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন নিজ প্রতিভা, মেধা ও মননে। সুকান্ত তার বয়সিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন তার পরিণত ভাবনায়। ভাবনাগত দিকে সুকান্ত তার বয়স থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবনকাল মাত্র ২১ বছর। এই বয়সেই নিজেকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তিনি। তার রচনা পরিসরের দিক থেকে স্বল্প অথচ তা ব্যাপ্তির দিক থেকে সুদূরপ্রসারী।