
লেখাটির শিরোনাম চমকে ওঠার মতো- গাজা মাস্ট বি রিবিল্ট বাই প্যালেস্টিনিয়ানস্, ফর প্যালেস্টিনিয়ানস্। কী বলা যায় একে? ‘গাজাবাসীদের জন্য গাজা অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের দ্বারা পুনর্নিমিত হবে’, এই তো? এই গদ্যের শুরুটাই হয়েছে গাজার ধ্বংসযজ্ঞকে কেন্দ্র করে। ধ্বংসস্তূপ, তার নিচে চাপা পড়েছে অসংখ্য মৃতদেহ। এই ধ্বংসস্তূপের বিশেষ অর্থ আছে, ‘এ হচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞের দ্বারা ক্ষতবিক্ষত সেই জায়গা, যেখানে আমাদের প্রিয় মানুষেরা থাকতেন আর এখানেই তাদের মৃত্যু হয়েছিল। সময় যখন আসবে তখন শুধু আমরাই ধ্বংস হয়ে যাওয়া সামগ্রী আবার ব্যবহার করে একে পুনর্নির্মাণ করব।’ এই যে তীব্র ভাবাবেগপূর্ণ আশাপ্রদ গদ্য, এর রচয়িতা মোসাব আবু তোহা। গদ্যটি প্রকাশের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। এই গদ্য প্রকাশের ঠিক তিন মাস পরে এই ধরনের গদ্য রচনার সূত্রে এ বছর পুলিৎজার পুরস্কার পেলেন তোহা। তোহা একাধারে লেখক, কবি, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার। বিশ্বসাহিত্য পরিমণ্ডলে এই মুহূর্তে যেসব ফিলিস্তিনি লেখকের কথা সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তোহা রয়েছেন তার শীর্ষে।
তোহার গদ্য রচনাটি পড়ার সময় মনে পড়ছিল প্রয়াত ফিলিস্তিনি মহান লেখক, চিন্তক এডওয়ার্ড সাঈদের কথা। সাঈদও তোহার মতো মতামতধর্মী গদ্য লিখে গেছেন। পশ্চিমাবিশ্বে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের ভাষ্যকার ছিলেন তিনি। পার্থক্য এই যে, তোহা একজন কবি আর সাঈদ ছিলেন তীক্ষ্ণ অন্তর্দর্শী শিক্ষক, ভাবুক ও বুদ্ধিজীবী। তোহার বিশিষ্টতা হচ্ছে, তিনি গাজাবাসীর দৈহিক ও মানসিক নিপীড়নকে সংবাদভাষ্যের আদলে প্রকাশ করে থাকেন। তাতে তিনি মিশিয়ে দেন গাজাকেন্দ্রিক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত স্মৃতি। পুলিৎজার কর্তৃপক্ষ তোহাকে পুরস্কার দিতে গিয়ে ঠিক এই মন্তব্য করেছে।
মোসাব আবু তোহার জন্ম ১৯৯২ সালে, গাজার উত্তরে অবস্থিত আল-শাতি উদ্বাস্তু শিবিরে। পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে গাজার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৭ সালে তিনি গাজার বেইথ লাহিয়াতে প্রথম একটা ইংরেজি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০২৩ সালে সাইরাকস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন গাজায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থায়। পরে বৃত্তি পেয়ে চলে আসেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেই তিনি পত্র-পত্রিকার জন্য মন্তব্যধর্মী গদ্য লিখতে শুরু করেন। তার এই লেখাগুলো প্রথমে অ্যারোস্মিথ প্রেসে; পরে দ্য ন্যাশন, লিটের্যারি হাব, নিউইয়র্ক টাইমস্ ও দ্য নিউইয়র্কারে প্রকাশিত হয়েছে।
বর্তমানের দুঃসহ বিপন্নতার প্রত্যক্ষ ছবি আর যাপিত স্মৃতির বিমিশ্রণে লেখা হয়েছে তার এক-একটি গদ্য। ২০২৩ সাল, তোহার বয়স তখন ৩২, স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে গাজা ছেড়ে আসতে গিয়ে ইসরায়েলের হাতে বন্দি হন। বন্দিশিবিরে থাকার স্মৃতিচারণা করেছেন এইভাবে, ‘ইসরাইলি সেনারা আমাকে আমার স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, শারীরিকভাবে নির্যাতন করে, তারপর চলে জেরা।’ তোহা লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তার বন্ধুরা যখন তার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হলো, তখনই ইসরায়েল তাকে মুক্তি দিল। গাজায় থাকতে খাদ্যের অভাবে ভুগেছে তার পরিবার। যুদ্ধের চাইতে প্রতিদিনের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যই তাকে বেশি চিন্তিত থাকতে হতো। মা-বাবা টেবিলে বসে আছেন, বোনেদের জন্য তিনি চা বানিয়ে দিচ্ছেন; কিছুই নয়, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছেন তার আত্মীয় পরিজনদের।
গাজার এ রকম অনেক ছবি আছে তার কাছে। এখন তিনি যখন আমেরিকায়, তখন সেই ছবিগুলো দেখেন আর মনে পড়ে যায় জাবালিয়া উদ্বাস্তু শিবিরের ধ্বংসযজ্ঞের কথা। দাদা-দাদি সেখানে থাকতেন আর তোহা নিয়মিত তাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। পাশাপাশি পড়তেন একটা স্কুলে। ‘এই ছবিগুলো আমি সব সময় দেখি আর দেখি। কবরের পর কবর, আমার মনে গেথে যায়।’ এরকমই হচ্ছে তোহার গদ্য; ব্যক্তিজীবন, গাজার ধ্বংসযজ্ঞ, পরিবার, প্রিয় বন্ধু এবং কাছের মানুষের আবেগী বর্ণনায় উজ্জ্বল।
গাজা প্রকৃত পক্ষে তোহার সব ধরনের লেখালেখির উৎস। একবার এক সাক্ষাৎকারে গাজা তাকে কতটা প্রভাবিত করে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি আমাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি যে একটা খাঁচায় ছিলাম। গাজার বিস্তৃতি ১৪১ বর্গকিলোমিটার। আমি ২০১৯ সালের আগে কখনো গাজা ত্যাগ করিনি। বয়স যখন ২৭, বড় হয়েছি; তখনো আমার কোনো ধারণাই ছিল না পৃথিবীটা কত বড়। জানতাম না প্লেনে ওড়ার কথা, সমুদ্রের জাহাজে চলার কথা। গাজার মানুষ শুধু বোমার শিকার হচ্ছে না, তারা তাদের ভূপ্রকৃতির সৌন্দর্য থেকেও বঞ্চিত।’
তোহা কবি হিসেবেও খ্যাতিমান। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই ‘থিংস ইউ মে ফাইন্ড হিডেন ইন মাই এয়ার: পোয়েমস্ ফ্রম গাজা’ প্রকাশিত হয় ২০২২ সালে। মোসাব আবু তোহার কবিতা লিরিকধর্মী, গীতল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা ও দুঃখের ফল্গুধারা বহমান। সামরিক অভিযান চালিয়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীকে মুছে দিচ্ছে। এক অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে বছরের পর বছর কাটছে ফিলিস্তিনিদের। ইসরায়েল গাজাকে পরিণত করছে জনশূন্য বিরান ভূমিতে। কবি তোহা এই বর্বরতার সাক্ষী ও প্রত্যক্ষ ভাষ্যকার। বহির্বিশ্বে একসময় এডওয়ার্ড সাঈদ যেমন হয়ে উঠেছিলেন নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর; তোহাও সেভাবেই হয়ে উঠছেন তাদের প্রতিদিনের দুঃখগাথার ভাষ্যকার। তার ব্যক্তিজীবন থেকে উৎসারিত আবেগকম্প্র মর্মস্পর্শী জাতিগত বিবরণ পাঠককে সহজেই ছুঁয়ে যায়। একবার তাই তার লেখালেখির বিষয়আশয় নিয়ে তাকে বলতে শুনি, ‘আমার চারপাশে কী ঘটছে আমি শুধু তা বর্ণনা করি না। আমি আমাদের জাতিগত কথাকে গতিময় করতে চাই। যেভাবে কেতলিতে পানি টগবগ করে ফোটে, আমি সে রকম সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বাষ্পায়িত বিবরণে ভীষণভাবে আগ্রহী। আমার লেখা সময়কে ধারণ করে। কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে আমি নিজেকেও বুঝতে চাই। আমার মন-মানসিকতা কবিতায় মূর্ত হয়; নিজেকে প্রশমনের একটা পথ হচ্ছে এই কবিতা।’
তোহার কবিতা পড়লে যেকোনো পাঠক বুঝতে পারবেন, তার মনোজগতে গাজাই পুরোপুরি স্থান করে নিয়েছে। তিনি একে যেমন জাতিগত সংগ্রামের উদ্দীপক বলে মনে করেন, তেমনি এর ধ্বংসাত্মক পরিণতিও তাকে বেদনার্ত করে, ক্ষুব্ধ করে। এতে তোহার নির্বাসিত ব্যক্তিজীবন যেভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে, তা যেমন স্মৃতিবিধুর, তেমনি মর্মস্পর্শী। কিন্তু শুধু এই দুঃখকাতরতা নয়, ফিলিস্তিনিদের জাতিগত দৃঢ়তাও তার কবিতায় চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন তোহা।
গাজার মানুষেরা তোহা মনে করেন অনেক সৃষ্টিশীল। তিনি বলেছেন, গাজার মানুষ এখনো তাদের কথা বলতে পারছেন না, ‘গাজায় কোনো সাহিত্য পত্রিকা নেই। আমাদের কোনো প্রকাশক নেই। গাজার মানুষেরা এভাবেই নীরব হয়ে আছে।’ এই কথাগুলো মোসাব আবু তোহা বলেছেন গত ১১ মে, তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন সেই সাইরাকস বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে।
ফিলিস্তিনিদের কথা ও কণ্ঠ বিশ্ববাসীর কাছে কবিতার মাধ্যমে প্রথম পৌঁছে দিয়েছিলেন মাহমুদ দারবিশ। তার মৃত্যুর বহু দিন পরে নান্দনিক প্রাতিস্বিকতায় সমকালীন ফিলিস্তিনিদের মর্মন্তুদ জীবনের কথা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেল মোসাব আবু তোহার মাধ্যমে। তিনিই এখন তার জাতির মুখপাত্র। বিষয়টি পুলিৎজার কর্তৃপক্ষ বুঝেছে বলেই এমন এক কবি-ভাষ্যকারকে পুরস্কারে ভূষিত করেছে, যার বয়স ৪০ বছর ছোঁয়নি।