![মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের প্রেক্ষাপট](uploads/2023/12/01/1701409562.----------------------.jpg)
বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। পূর্ব বাংলা হয় পূর্ব পাকিস্তান। জনগণ আশা করেছিলেন, এবার তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। তাদের প্রত্যাশিত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণ উন্নত জীবনের অধিকারী হবে। কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অনুভব করল, তাদের প্রত্যাশা পূর্ণ হওয়ার নয়। পাকিস্তানের শাসকবর্গ পূর্বপরিকল্পিত ঐক্যবদ্ধ একক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র সংকুচিত করা হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা বঞ্চনার শিকার হয়েছে। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৯৫২ সালে ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য জীবন দান করতে হয় পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতার। জনগণ প্রত্যাশা করেছিল নির্বাচিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ইতিহাস পাল্টাবেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। পাকিস্তান সরকার এ যৌক্তিক দাবির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে ১৯৪৮ সালেই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ চলতে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত হয় ১৯৫২ সালে এবং সেই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্ররা একত্রিত হয়। পুলিশ এ জনসমাবেশের ওপর গুলি চালানোর ফলে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন। এ ঘটনা আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দান করে এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়।
’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক স্লোগান পরিবর্তিত হয়। ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ ‘পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা।’ ‘জাগো জাগো-বাঙালি জাগো’। এই ধারাবাহিকতায় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকে উন্মুক্ত করে। অহিংস আন্দোলন সহিংসতার দিকে ধাবিত হতে থাকে। এই সময় রাজনৈতিক দলের ছয় দফা দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। বাঙালি একক জাতিসত্তার আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান দেশে সামরিক শাসন জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। জানুয়ারি ’৬৯-এ গৃহিত ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির একক এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ’৬৯-এ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল গণংবর্ধনায় শেখ মুজিবর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
২৫ মার্চ ৬৯ সারা দেশে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও সামরিক সরকার গণদাবিকে উপেক্ষা করার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। তাই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সারা দেশে এক ব্যক্তি এক ভোটের নীতিতে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ৭ ডিসেম্বর ’৭০ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ’৭০-এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে তফসিল ঘোষণা করা হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে দেশব্যাপী এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জয়লাভের পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠনে মত দিতে অস্বীকার করেন। একটি রাজনৈতিক দল জনগণের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেয়েছে। তারা সরকার গঠন করবে, এটাই ছিল বাস্তবতা। কিন্তু সামরিক শাসক সরকার গঠন বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে এক আলোচনা শুরু করে।
জাতীয় সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১ মার্চ ১৯৭১ দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সর্বস্তরের জনগণ একবাক্যে বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অচল করে তোলে। ২ মার্চ ’৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা প্রদর্শিত হয়। ৩ মার্চ ’৭১-এ রমনা রেসকোর্স ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করা হয়। এই ইশতেহারে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক দিকনির্দেশনমূলক ভাষণে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বন জানান। এই ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। ...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দের ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হিসেবে বিবেচিত। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ কোনো দলীয় নেতার নির্দেশ ছিল না। ছিল একজন জাতীয় নেতার নির্দেশ। এই নির্দেশ দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বাঙালি সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী সবাইকে সচেতন করে তোলে। ২ মার্চ ’৭১ থেকে পূর্ব বাংলার সব প্রশাসনিক কাজকর্ম চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।
২৩ মার্চ ’৭১ সকালে পল্টন ময়দানে জয় বাংলা বাহিনীর এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান শেষে এই বাহিনীর নেতৃবৃন্দ মিছিলসহকারে বাংলাদেশের পতাকাসহ বঙ্গবন্ধু ভবনে প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়িতে এই পতাকা উত্তোলন করেন। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে এই পতাকা লাগান হয়। ২৩ মার্চ পূর্ব বাংলার প্রতিটি শহরে পাকিস্তান দিবসের অনুষ্ঠান বর্জিত হয় এবং পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা যায়।
অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগণ স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের জন্য রাজনৈতিক আলোচনার আড়ালে সামরিক বাহিনী মাত্র ২২ দিনে দুই ডিভিশন অবাঙালি সৈন্য পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় স্থানান্তরে সক্ষম হয়। বাস্তবতায় এটিই ছিল তাদের আলোচনার নামে কালক্ষেপণের মূল উদ্দেশ্য। ২৪ মার্চ ’৭১ সামরিক শাসকগণ হেলিকপ্টারে সব সেনানিবাসে এই আক্রমণের পরিকল্পনা হস্তান্তর করে। বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এই কুখ্যাত হত্যাযজ্ঞের নির্দেশ নামা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচিতি। ২৫ মার্চ ’৭১ রাত ১১টায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে সেনানিবাস অথবা আক্রমণের স্থানগুলো ত্যাগ করে। একই সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের সব বড় শহর ও সেনানিবাসের বাঙালি রেজিমেন্টসমূহ আক্রান্ত হয়। সেনাবাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু বন্দি হওয়ার আগে তিনি দলীয় নেতৃবৃন্দকে করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে অবস্থান পরিবর্তনের কথা বলেন। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য বাংলার জনগণকে আহ্বান জানান। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে বিজয়ের পতাকা ওড়ানো হয়।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়