![নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটবে না](uploads/2023/12/02/1701496233.KM-NURUL-HUDA.jpg)
দেশের যেকোনো জাতীয় নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে। নির্বাচনকে ঘিরে সব দল সরব থাকে ও একটি স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনী পরিবেশ বিরাজ করে। কিন্তু বর্তমানে যে অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেখানে একটি বড় দল ক্ষমতায় আছে, আরেকটি বড় দল সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। দলগুলোর মধ্যে মতভেদ অর্থাৎ এক ধরনের অস্থিতিশীল অবস্থা দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংকট রয়েছে। এমতাবস্থায় সংকট নিরসনে নির্বাচন কমিশনের নিজেদের দায়িত্ব পালন ব্যতীত কিছু করার নেই। নির্বাচনী দলগুলোর অবশ্যই সহযোগিতার মনোভাব থাকতে হবে। তাদের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে হবে। সংবিধানে উল্লেখ নেই যে, কোনো দল অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচন বন্ধ থাকবে। আমি মনে করি, আইনগতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার। তবে এর গ্রহণযোগ্যতা অথবা সন্তুষ্টি নিয়ে এক ধরনের আপত্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে নির্বাচনের বিকল্প নেই।
বর্তমানে দুটি প্রধান দল পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থানে আছে। কাজেই নির্বাচন হলে স্বাভাবিকভাবেই যারা বিরোধী দলে আছেন তারা বলবেন, এ সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই। বরং নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করার জন্য সহযোগিতা করতে হবে। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের দলাদলি ও সহিংস অবস্থানে থাকার অভ্যাস আছে। সে কারণেই তাদের এ ব্যাপারে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটবে না।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের পথে তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে নির্বাচন যদি সঠিকভাবে না হয়, তা হবে সবার জন্যই দুঃখজনক। সেক্ষেত্রে দেশের মানুষকে বেশিমাত্রায় মাশুল দিতে হবে। এ বিষয়টি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যারা আছেন তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশনে যে কেউ নিযুক্ত হলেই তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ শুরু হয়ে যায়। এটার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। নির্বাচন কমিশন কাজ করে যায় আইন অনুসারে। নির্বাচন কমিশনে এসে তাদের কথামতো নির্দলীয় গণতান্ত্রিক সরকার তৈরি করা সম্ভব নয়। নির্দলীয় সরকার তৈরি হবে সব দল মিলে। নির্বাচন কমিশনের সেক্ষেত্রে কিছু করার নেই।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। শুধু নিজেরা নিজেদের স্বার্থ দেখে। সব দল এগিয়ে এলে অবশ্যই নির্বাচন ভালো হবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বিএনপি একটি বড় দল। তারা বলছে, তারা সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাড়বে। তাহলে আমার প্রশ্ন, তাদের নির্বাচনের মনোভাব কোথায়? আমি মনে করি, নির্বাচনের জন্য সবাই মিলে স্বপ্রণোদিতভাবেই একটি জায়গায় আসতে হবে।
নির্বাচনকে গঠনমূলক করার চেয়ে বেশির ভাগ সময় দলগুলো পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে কথা বলে। যারা নানারকম বিতর্কে লিপ্ত হন, তারা আসলে দেশকে ভালোবাসেন না। তারা মূলত ক্ষমতার জন্য নির্বাচন করেন। তাদের দেশের কথা ভাবতে হবে। মানুষের কথা ভাবতে হবে। ভোটারদের কথা ভাবতে হবে। তাদের সংলাপে আসতে হবে। সম্মিলিতভাবে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। যেখান থেকে সমস্যাগুলোর সমাধান বের হয়ে আসতে পারে। তাদের ভাবতে হবে, যাতে করে দেশ ও দেশের মানুষ শান্তিতে থাকে।
সরকারে যাওয়ার জন্যই তাদের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমিয়ে সুন্দর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা চিন্তা করতে হবে। নির্বাচনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মনোভাব থাকতে হবে। ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে প্রচুর লোক মারা গেছে। স্কুলে আগুন দেওয়া হয়েছে। পথেঘাটে গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর করা হয়েছে। অনেক মানুষ মারা গেছে। এসবের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে জনগণের ভালো চিন্তা করতে হবে। কাজেই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সংলাপের মধ্য দিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনও যেন সুন্দর, গ্রহণযোগ্য ও সব মহলে প্রশংসাযোগ্য একটি নির্বাচন করতে পারে, সেদিকটায় সবাইকে মনোযোগ দিতে হবে। ভালো নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ দরকার। সেক্ষেত্রে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সবারই সম্মিলিত সহযোগিতা দরকার। জনগণ শান্তিতে ভোট দিয়ে একটি সরকার গঠন করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
বড় দলগুলো যদি নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করে, নির্বাচন কমিশনের জন্য সুন্দর একটি নির্বাচন করা সম্ভব। সে লক্ষ্যে উপযুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির জন্য সহযোগিতামূলক মনোভাব অবশ্যই দরকার। মানুষ যদি ভোট দিতে আসে তাহলে তারা অবশ্যই সুন্দর একটি পরিবেশে ভোট দিতে চাইবে। যাদের দ্বারা নির্বাচন সংঘটিত হবে তাদের সাবধান হতে হবে। তাহলে নির্বাচন কমিশনও সঠিকভাবে ও সহজে নির্বাচন করতে পারবে। একই সঙ্গে নির্বাচনী এজেন্ট যারা থাকবেন তারা নিজেদের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করবেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যেন ভোটকেন্দ্রগুলোকে নজরদারিতে রাখতে পারেন সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশন যদি সবাইকে সব ধরনের সহযোগিতা করে তাহলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। এর আগে নির্বাচন কমিশন তৈরি হয়নি। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। যে দলগুলো নির্বাচন করবে তারাও সহযোগিতা করেছে। জনগণ নির্বিঘ্নে এসে ভোট দিয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন তাদের নির্বাচন সূচারুভাবে করবে, যাতে করে জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে। মানুষ তার নিজের ভোটটি নিজেই দিতে চায়।
আমাদের সেই ভোটের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দেশে যদি অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করে তাহলে মানুষ ভোট দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। পারস্পরিক সদিচ্ছা ছাড়া এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যে দলেরই হোক না কেন সম্মিলিতভাবে একটি সুন্দর নির্বাচন করার চেষ্টা থাকতে হবে। একজন আরেকজনের প্রতি বিরূপভাজন না হয়ে দলমত নির্বিশেষে সুস্থ ও সুন্দর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা উচিত। নির্বাচন সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের স্বপ্রণোদিত ভূমিকা নিতে হবে।
লেখক: সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার