![বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি](uploads/2024/04/04/1712205802.shakwat.jpg)
ডয়চে ভেলের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা যৌন হয়রানি করে তাদের ৯ শতাংশই শিক্ষক, ৫৬ শতাংশ সহপাঠী। এই যৌন নিপীড়করা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। যৌন নিপীড়নের শিকার ৯০ ভাগই নানা ভয়ের কারণে অভিযোগ করেন না। ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার পর ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরকে বরখাস্ত এবং একজন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অন্য একজন ছাত্রী অভিযোগ করেন, শিক্ষকের বন্ধুত্বের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে শুধু ফেল করানো হচ্ছে। ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় তিন নম্বর দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের গবেষণায় উঠে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়কদের মধ্যে ৯ শতাংশই শিক্ষক। ৫৬ শতাংশ যৌন নিপীড়কই ছাত্রীদের সহপাঠী। ২৪ শতাংশ তাদের চেয়ে ছোট বা বড়, ১১ শতাংশ বহিরাগত। ১০ শতাংশ ছাত্রী জানান, নির্যাতনের ৩০ শতাংশ বাজে মন্তব্য ও ৬০ শতাংশ সাইবার হয়রানি। নিপীড়নের ঘটনায় মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে ৫ শতাংশ বিভাগের শিক্ষকদের কাছে এবং বাকি ৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ সেলে। ৯০ শতাংশ অভিযোগকারী জানান, ন্যায়বিচার না পাওয়া ও চরিত্র হননের ভয়ে তারা সেলে অভিযোগ করেননি।
২০২১ সালে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রতিবেদনে বলা হয় জনসমাগমস্থলে ৮১ ভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিনিয়র সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হচ্ছেন ৭৪ শতাংশ। ২০২২ সালে ডাটা ফর ইমপ্যাক্ট-এর এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে অবিবাহিত মেয়েদের প্রতি তিনজনে একজন ১২ মাসে কমপক্ষে একবার যৌন হয়রানির শিকার হন। যৌন হয়রানির অভিযোগে ময়মনসিংহের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপককে বরখাস্ত এবং বিভাগীয় প্রধানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন অধ্যাপককে যৌন হয়রানির অভিযোগে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক বছরে ২০টির মতো যৌন হয়রানির অভিযোগ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্বের থিসিস করতে গিয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন রসায়ন বিভাগের এক ছাত্রী। তদন্তসাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত শিক্ষককে বহিষ্কার করেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি রোধে হাইকোর্ট ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠনের নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশে অভিযোগ গ্রহণ ও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়। কোনো অভিযোগ পেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেল কাজ করার কথা। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানেই এখনো যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল নেই। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী তেমন কার্যকর নয়। কার্যকর না থাকায় হয়রানির শিকার শিক্ষার্থীরা সেলে অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকছে।
বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে মেধাবীরাই যোগদান করছেন। ব্যতিক্রম যে নেই, সেটিও বলা যাবে না। তবে এখনো অধিকাংশ জায়গায় বিভাগের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়ে থাকে। আর শিক্ষার্থী হিসেবে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মেধা তালিকায় শীর্ষে থাকা শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে।
সর্বোপরী একটি প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন। একটি স্বপ্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন শিক্ষার্থীরা। জ্ঞান সৃজন, জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সংরক্ষণের অদম্য ইচ্ছে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীরা তাদের পথচলা শুরু করেন। যৌন নিপীড়নের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর স্বপ্নের পথচলা হোঁচট খায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় পরিসরের জায়গায় শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই বরদাশত করার মতো নয়। সে কারণেই যৌন নিপীড়ন সেলে কিংবা বিভাগের সভাপতির কাছে অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগটি আমলে নিয়ে তড়িৎ গতিতে ঘটনার সত্যানুসন্ধান জরুরি হয়ে পড়েছে। যেহেতু ব্যাপারটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, সেহেতু খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে গুরুত্ব প্রদান করে নিয়মানুযায়ী তদন্ত করা প্রয়োজন। ওপরে যত সংখ্যক ঘটনা আলোচনায় এসেছে অধিকাংশ জায়গায় দেখা যাচ্ছে, ঘটনার শুরুতে কর্তৃপক্ষ যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করত তাহলে আত্মহননের ঘটনা ঘটত না।
একজন শিক্ষার্থী শুরুতেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে উদ্যত হয় না, বিচার না পেয়ে একসময় নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা মনে করতে শুরু করে। হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করে, ক্লাসে কিংবা বন্ধুমহলে অন্যদের থেকে কিছুটা হলেও দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয় অভিযোগ দায়েরের কারণে। জাতিসংঘের মতে, পৃথিবীর পাঁচজনে একজন নারী তার জীবনের কোনো না কোনোসময় শারীরিকভাবে কিংবা যৌন বিচারে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে নারী নির্যাতন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিদিন খবরের কাগজে দেশের আনাচেকানাচে নারী নির্যাতনের ঘটনার বিষয়ে প্রত্যেকেই ওয়াকিবহাল। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের অবস্থান হওয়ায় এ ধরনের পবিত্র জায়গায় যৌন হয়রানির ঘটনা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন যৌন হয়রানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে- এর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হলে সমাধানের লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে হবে। পঠন-পাঠন, গবেষণা, শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন ও প্রতিভাকে জাগ্রত করার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে শিক্ষকরা যখন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে মনোযোগী হন তখনি কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যে পেশার গুরুত্ব, মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্য শ্রীহীন হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ট্রেনিংয়ের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে বিশেষ করে যারা নতুন শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করছেন তাদের একটি প্রিলিমিনারি পর্যায়ের প্রশিক্ষণের ভিতর দিয়ে যোগদানের ব্যবস্থা করা অতীব জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, গবেষণা প্রভূত বিষয়ে ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও মৌলিক প্রশিক্ষণের আয়োজন বাধ্যতামূলক করা অবশ্য পালনীয় হয়ে যাচ্ছে।
কাজেই যৌন হয়রানি বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দায়িত্বশীল ইউনিটকে অগ্রসর ভূমিকা পালন করতে হবে। সাধারণত শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া আগ্রাসী আচরণ, ইভ টিজিং কিংবা অন্যান্য অসঙ্গতির বিরুদ্ধে বিভাগকে অবহিত করে থাকেন। প্রত্যেক বিভাগে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিংয়ের জন্য একটি কমিটি থাকা প্রয়োজন, যদিও অনেক বিভাগে এ ধরনের কমিটি নেই। শিক্ষার্থীদের সুবিধা, অসুবিধা, মানসিক অবস্থান, আগ্রাসী মনোভাব, পিয়ার গ্রুপের চালচলন প্রভূত বিষয়ে মূলত কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজন হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীরা যখন বিভাগে অভিযোগ দায়েরের পর সমাধান পেতে ব্যর্থ হয় তখনি মূলত বিষয়টিকে নিয়ে তারা কেন্দ্রীয় যৌন নিপীড়ন সেলের দ্বারস্থ হয়।
আবার অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা তাদের অভিযোগের ব্যাপারে বিভাগ থেকে কোনোরূপ সমাধান না পেয়ে হতাশার মধ্যে পর্যবসিত হয়ে থাকেন। এমনটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। এভাবে অনেকের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায় কিংবা সেমিস্টার ড্রপ হয়ে যায় অনেকের। অনেকেই আবার নীরবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীই অনিয়মের বিরুদ্ধে সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দেখান। এ প্রতিবাদগুলোর কারণেই অভিযোগের খতিয়ান সাম্প্রতিককালে সামনে আসছে। অসংখ্য যৌন নির্যাতনের ঘটনা আড়ালেই থেকে যায় কেবলমাত্র সম্মান হারানোর ভয়ে তথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠিত নিয়মের বেড়াজালে। নারী শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারটি সামনে আনার ক্ষেত্রে অপারগতা দেখায়। কেননা সমাজ ও পরিবার এখনো নারীদের এ ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যুতে দোষারোপ করে থাকে। নারীদের শোষণের বেড়াজালে রেখে অঘোষিত নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। এ ধরনের পদক্ষেপ মূলত নারীদের মানসিকভাবে পিছিয়ে দেয়, প্রতিবাদের ভাষাকে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়।
মূল কথা হচ্ছে, সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবেই। যেখানেই অনিয়ম হবে সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানাতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিবাদের পাল্লা প্রতিনিয়ত ভারী হচ্ছে এবং এর ধারাবাহিকতা আমাদের ধরে রাখতে হবে। পাশাপাশি যারা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলকে আরও সাংগঠনিকভাবে তৎপর ও শক্তিশালী হিসেবে তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]