![অর্থনীতি ‘ম্যাচিউর’ হয়েছে, জটিলতাও বেড়েছে](uploads/2024/04/04/1712205951.Atiuar-Rahman.jpg)
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। কৃষকরা এ দেশের মূল শক্তি। কৃষক ও কৃষিসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছাতে আমরা নানামুখী সাহসী নীতি-উদ্যোগ নিয়েছিলাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি সরকারের রাজস্বনীতির সহায়তায় স্বল্পমূল্যে রপ্তানিমুখী শিল্পে অর্থায়নেও গতি সঞ্চার করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলাম। রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশের সঙ্গে কেবল বৈদেশিক মুদ্রা আয় নয়, কর্মসংস্থানও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সমর্থন আর এ দেশের উদ্যমী মানুষের কল্যাণে আমাদের নীতি-উদ্যোগগুলো প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সুফল বয়ে এনেছিল। বাজারে ঋণের সরবরাহ ব্যাপকভাবে সংকুচিত না করেও আমরা মূল্যস্ফীতি অল্প সময়ের মধ্যেই সহনীয় পর্যায়ে আনতে পেরেছিলাম। স্থিতিশীল বিনিময় হার বজায় রেখে রিজার্ভ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির চাকাকেও বহুলাংশে গতিশীল করা গিয়েছিল।
এবার যদি এখনকার বিদ্যমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে নজর দিই, তাহলে দেখতে পাই, প্রায় দেড় যুগ ধরে অন্তর্ভুক্তিমূলক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির সুবাদে অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ালেও টালমাটাল ভূ-রাজনীতি আর নিজস্ব কাঠামোগত সমস্যার কারণে আমাদের সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে। সুশাসনের চ্যালেঞ্জের মতো পুরনো সংকটগুলোও নতুন করে বেশি বেশি নজরে পড়ছে।
মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সব শ্রেণির উদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার মতো ইস্যুগুলো এখন তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব পর্যায়ের অংশীজনদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। এ ছাড়া নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এবং স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে থাকায় আমাদের সামনে যে নতুন সম্ভাবনাগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতেও নতুন নতুন নীতি-পরিকল্পনা দরকার। ডলার সংকট, রিজার্ভ ক্ষয়, আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও রপ্তানি বহুমুখীকরণের চাপ, টাকা-ডলার বিনিময় হারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ বাস্তবতায় মুদ্রানীতিসহ অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-পরিকল্পনার নির্দেশনা এখন কেমন হওয়া উচিত? কোন পথে এগোলে আমরা তুলনামূলক বেশি নিরাপদ থাকব? প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল রাখতে কতটা ঝুঁকি নেওয়াকে গ্রহণীয় মনে করব? সর্বোপরি প্রান্তিক মানুষ, বিশেষত যারা অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরশীল, তাদের সুরক্ষাই বা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়?
আমাদের অর্থনীতি যত ‘ম্যাচিউর’ হয়েছে, ততই এর জটিলতাও বেড়েছে। আমাদের সংকটগুলোর কারণ যেমন বহুমুখী, সমাধানের উপায়ও তেমনি জটিল হতে বাধ্য। মনে রাখা চাই, সমাধানের জন্য উদ্যোগী হওয়ার কারণ কিন্তু বদলায়নি। আগেও গ্রাহক/নাগরিকের সুরক্ষাই প্রধান অগ্রাধিকার ছিল। এখনো তা-ই আছে। এ বিষয়ে মার্কিন অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নেটওয়ার্ক কেপিএমজির প্রধান অর্থনীতিবিদ ডায়ান সোওংকের সাম্প্রতিক উদ্ধৃতিটি বিশেষ প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, ‘বাজারে চাহিদা ও জোগানকে প্রভাবিত করতে পারে এমন বিষয় আগে কম ছিল। এখন চাহিদা ও জোগানকে প্রভাবিত করার মতো বিষয় অনেক। এবং এগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্কও বহুমুখী। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দায়িত্ব আগের মতোই আছে। তা হলো মোটাদাগে মূল্য স্থিতিশীল রাখা। তবে ভুলে গেলে চলবে না, মূল্য বলতে পণ্য, ঋণ এবং বৈদেশিক মুদ্রা- এর সব কটির মূল্যই বোঝানো হয়। কাজেই বর্তমান বাস্তবতায় মূল্য স্থিতিশীল রাখাটা খুবই জটিল।’
বাংলাদেশের মতো দেশের জন্যও যে এসব কথা সমান প্রাসঙ্গিক, সে কথাটিও মানতে হবে। ১০ থেকে ১৫ বছরে আমাদের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণের মতো বেড়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্য আর রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও একই মাত্রার ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। তবু এখনো দেশের অর্থনীতিতে রয়েছে উচ্চমাত্রার অনানুষ্ঠানিকতা (৮০ শতাংশের বেশি শ্রমশক্তি নিয়োজিত আছে অনানুষ্ঠানিক খাতে)। পুরো অর্থনীতিতেই নানা রকম কাঠামোগত কমতি বা ‘ডেফিসিট’ তো রয়েছেই। কাজেই কেবল ঋণের সুদ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কিংবা আমদানি কমিয়ে রিজার্ভ রক্ষার প্রচেষ্টার মাধ্যমে কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে, পুরোটা নিশ্চয় নয়।
আমদানিতে কড়াকড়ির কারণে শিল্পোৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রাদির সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। টাকা পাচার ঠেকানো ও রিজার্ভ রক্ষার্থে আমদানিতে কড়াকড়ি করাটাকে প্রাথমিকভাবে যৌক্তিক মনে হলেও আদতে এতে ‘রিয়াল ইকোনমি’র কতটা ক্ষতি বা লাভ হচ্ছে, তা-ও খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানো হলেও এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। এতে ধারণা করা যায়, কেবল বাজারে ঋণের সরবরাহ বেশি আছে বলেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, বিষয়টি এমনও নয়।
কাজেই এমনটি সন্দেহ করা একেবারেই অমূলক হবে না যে, আমাদের সরবরাহ চেইনের সংকটগুলোও উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রাখছে। গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে, একদিকে উৎপাদনকারী কৃষক ফসলের দাম একেবারেই পাচ্ছেন না, অন্যদিকে গ্রাহক/ভোক্তারা উচ্চ খুচরা মূল্যের কারণে চাপে পড়ছে। কাজেই আমাদের যে বাস্তবতাটুকু মেনে নিতেই হবে তা হলো, কেবল মুদ্রানীতি (সুদের হারের হ্রাস-বৃদ্ধি) দিয়ে বাংলাদেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এই মুহূর্তে পুরোপুরি সম্ভব নয়। তবে মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদের হার না বাড়িয়েও উপায় নেই। খেয়াল রাখতে হবে, তা আরও কতটা বাড়ালে মূল্যস্ফীতি সহনীয় করা যাবে। পাশাপাশি কাঠামোগত কমতিগুলো পূরণ করাটাকেও অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। আর এ ক্ষেত্রে সব অংশীজনের স্বার্থের প্রতি সংবেদনশীল হয়েই এগোতে হবে। কেননা বাজারের ওপর জোরজবরদস্তি খাটে না। সে জন্য অংশীজনদের সঙ্গে নিবিড় আলাপ করার কোনো বিকল্প নেই।
অর্থনীতির বাজারকে তার আপন গতিতে চলতে দিতেই হবে। এতে প্রাথমিকভাবে কিছুটা চাপ মোকাবিলা করতে হলেও দীর্ঘমেয়াদে সবার জন্যই সুফল পাওয়া যাবে। সুদের হার নিয়ন্ত্রণের মতোই মুদ্রাবিনিময় হারের ক্ষেত্রেও বাজারভিত্তিক সমাধানের পথে এগোতে আমরা কিছুটা দেরি করছি বলেই মনে হয়। তবে হালে পরিস্থিতি বেশ খানিকটা উন্নত হয়েছে। এখনো বাজারে একাধিক মুদ্রাবিনিময় হার বিরাজ করছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, বাজারে ডলারের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে একটা ব্যাপক পার্থক্য এখনো রয়ে গেছে। কাজেই চাহিদা ও জোগানের সূত্র মেনেই ডলারের বিপরীতে টাকার আরও অবমূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি। এতে প্রাথমিকভাবে আমাদের বাণিজ্য ও নিত্যদিনের ভোগ একটু চাপের মুখে পড়বে। তবে দীর্ঘমেয়াদে সাম্যাবস্থায় পৌঁছতে এটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে সবাইকে প্রস্তুত থাকতেই হবে। এমনকি আর্থিক খাতের সংস্কারের প্রশ্নেও নীতিনির্ধারকদের আরও বেশি বিশ্লেষণনির্ভর এবং সাবধানী হতে হবে।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর