![মুক্তিযুদ্ধ ও ঈদ: স্মরণীয় কিছু কথা](uploads/2024/04/09/1712640856.shukoronjon.jpg)
যখন গ্রামের স্কুলে নিচু ক্লাসে পড়তাম, তখনই পবিত্র রমজান মাসে ইফতার খাওয়ার জন্য স্কুলের আশপাশে অপেক্ষা করতাম। স্কুল কর্তৃপক্ষ রুটিন করে দিয়েছিল। কোন ক্লাসের ছাত্ররা কবে ইফতার করতে পারবে। সেই ছয় দশক আগেকার কথা। আবার খুশির ঈদ এসেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ঈদের সম্পর্কের কথা শুরুতেই বলছি। তখন পশ্চিমবঙ্গে চলছে মুক্তিযুদ্ধের উন্মাদনা। এমনই একদিন অধ্যাপক ইউসুফ আলি, যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির নেতা ছিলেন, আমাকে ফোন করে বললেন, চলে আসুন। হেনা ভাই (আবু হেনা কামারুজ্জামান), নজরুল সাহেব আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। যত তাড়াতাড়ি পারেন, চলে আসুন।
কামারুজ্জামান সাহেব প্রশ্ন করলেন, কলকাতায় ঈদের নামাজ কোথায় হয়। আমি বললাম কলকাতার সব মাঠেই হয়। তিনি বললেন, তুমি আমাদের নিয়ে যাবে। আমি উত্তরে বললাম, আপনারা ভারত সরকারের অনুমতি নিয়েছেন। সবাই বললেন- না, আমরা অনুমতি নিইনি। আপনারা তো কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আছেন। কী করে নামাজ পড়তে যাবেন? সোজা পার্কস্ট্রিট ধরে আমরা সেখানে উপস্থিত হলাম। গাড়ি থেকে নামিয়ে নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের নামাজস্থলে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমার স্কুলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। স্কুলের ছেলেরা নতুন জামাকাপড় পড়ে খুশির মেজাজে কোলাকুলি করছে।
এবার ফেরার পালা। গাড়িতে উঠতে যাব, তখন ইউসুফ আলি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আর কোথায় কোথায় নামাজ পড়া হয়, আর ঈদের উৎসব পালন করা হয়। বিশ্বের ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটিকে মহাসমারেহে পালন করেন। ইউসুফ আলি বললেন, আরও দু-একটা জায়গায় আমাদের নিয়ে চলুন। আমরা শুধু দেখব। আমি তাদের প্রথমে পার্ক সার্কাস ময়দান, তারপর মৌলালী ময়দানে নিয়ে গেলাম। এবার ওরাই বললেন, আর দেখব না। এবার ফিরে চলুন।
গাড়িতে বসে ক্যাপ্টেন মনসুর আলি বললেন- আরে, আমরা স্বাধীনতার পর থেকে শুনে আসছি পশ্চিমবঙ্গে ঈদের নামাজ হয় না। এবার তো স্বচক্ষে দেখলাম। এতদিন পাকিস্তান আমাদের মিথ্যে কথা বলে এসেছে। কামারুজ্জামান উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমি তো দীর্ঘদিন পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলাম। আমি করাচি, ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি সব দেখেছি। ওরা বাঙালিদের নামই শুনতে চাইত না। ভারত সম্পর্কে ঘৃণা ছাড়া কোনো কথাই বলত না। ওদের কথার কোনো মূল্য আছে?
সবচেয়ে বড় নামাজ হয় রেড রোডে। সেখানে লাখ লাখ লোক আসেন। তার বর্তমান নাম ইন্দিরা গান্ধী সরণি। সৈয়দ সাহেবের নির্দেশেই ইউসুফ আলি গোলক মজুমদারের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানালেন।
গোলক মজুমদার তাদের সরাসরি বলে দিলেন, নিরাপত্তার দিকটি আমি দেখব। কিন্তু দিল্লির অনুমতি চাই। দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করে সেদিন রাতেই গোলক মজুমদার জানিয়ে দেন, আপনাদের চারজনকে দিল্লি অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু তাজউদ্দিন সাহেবকে অনুমতি দেয়নি।
বিষয়টি নিয়ে কামারুজ্জামান, সৈয়দ সাহেবরা তাজউদ্দিনের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বললেন। তাজউদ্দিন সাহেব বাকি নেতাদের রেড রোডে নামাজ পড়তে যাওয়ার সম্মতি ছিলেন। তার নামাজের জন্য মুজিবনগর দফতরে সব ব্যবস্থা করা হলো। আমি কলকাতার সুরেন্দ্রমোহন এভিনিউয়ে যেখানে থাকতাম, তার পাশেই একটি বাড়িতে এই নেতারা থাকতেন।
ঈদের দিন আমাকে সকালে ওই বাড়িতে যেতে বলা হয়েছিল। নিরাপত্তার জন্য সেখানে সাত-আটটি পুলিশের গাড়িও উপস্থিত ছিল। ওদের একটি বড় গাড়িতে তোলা হলো। আমিও সেই গাড়িতে ছিলাম। প্রায় তিন ঘণ্টা পর আমরা যখন সুন্দরী মোহন এভিনিউয়ে এলাম, গাড়ি থেকে নেমে চারজন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মিষ্টি না খেয়ে যাবে কোথায়? আমি স্থির করে তিনজনের বাড়ি গিয়ে মিষ্টি খেলাম। আর কামারুজ্জামানের বাড়ি গিয়ে বিরিয়ানি খেয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
বাড়িতে ঢুকতেই গোলক মজুমদারের ফোন- সব ঠিকঠাক আছে তো? আমি বললাম, আপনি তো খবর পেয়েই গেছেন। আর আমি আনন্দবাজারে খবরটা আজ করব। করেওছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ ও ঈদ। ঈদ সবার। আনন্দের উৎসব। আমার ছোটবেলায় যা ছিল, আজও তাই।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক