![রাজস্ব আহরণ: স্ববিরোধিতার কয়েকটি দিক](uploads/2024/05/16/D.-MD.-Abdul-Majid-1715838101.jpg)
কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অবস্থায় তা থেকে বোঝা যায়, রাজস্ব আয় অর্জন একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বা পুশ ফ্যাক্টরের মধ্যে আছে। অর্থাৎ রাজস্ব আহরণকে একটা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে উন্নীত করার জোর চেষ্টা চলছে। বিপুলসংখ্যক করদাতা এখনো করজালের আওতায় আসতে পারেনি, আনা যায়নি। অন্যদিকে কর ও শুল্কায়নযোগ্য যে খাতগুলো বাদ পড়ে গেছে বা বাইরে আছে, সেগুলোকে শুল্ক ও করের আওতায় আনার চেষ্টাও চলছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই পরিশীলিত দৃঢ়প্রত্যয়ী রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি উদ্ভূত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়ে একটা করদাতাবান্ধব ও উৎসাহ প্রণোদনামূলক পদ্ধতি গড়ে তোলা বা চাপ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। অর্থাৎ কর যারা দেয় না, তাদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি কর প্রদানে যারা ফাঁকি দিচ্ছে বা এড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের প্রতি কঠোর ও কঠিন মনোভাব পোষণ এবং সর্বোপরি কর প্রদান ও আহরণের সংস্কৃতিকে জাতীয় দায়িত্ববোধের চেতনায় উত্তরণ ঘটানো। কর দান ও আহরণের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা বা জটিলতাসহ স্পর্শকাতরতা রয়েছে, তা দূর করে কার্যকর অবস্থায় নিয়ে আসতে সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই চেষ্টা চলছে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আমদানি বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির সময়ে নিজস্ব উৎপাদনব্যবস্থা তেমন ছিল না বলে তখন আমদানি শুল্ক ব্যতিরেকে কর ও ভ্যাট রাজস্ব আহরণের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন ট্রেডিং-নির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দিকে অগ্রসরমাণ হয়, তখন থেকেই শুল্কের চাইতে করের কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে। রেমিট্যান্সের পাশাপাশি পোশাকশিল্পের হাত ধরে আমাদের রপ্তানি আয় ও উন্নয়ন বেড়ে গেলে এবং আমদানি ব্যয় হ্রাস পেতে থাকলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহসংক্রান্ত বিষয়াদি নতুন করে জাতীয় ভাব-ভাবনার চৌহদ্দিতে চলে আসে। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই রুশ ফেডারেশনের পতনে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন মেরূকরণ শুরু হয়। তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর আগের মতো বিদেশি ঋণ অনুদান প্রাপ্তির সুযোগ এবং সম্ভাবনা হ্রাস পায়। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই বাংলাদেশের মতো অনুন্নত অথচ উন্নয়ন আগ্রহী দেশে নিজস্ব রাজস্ব আহরণের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
এতদসত্ত্বেও রাজস্ব আহরণের প্রয়াস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেও কর জিডিপির রেশিও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছতে এখনো মনে হচ্ছে অনেক পথ বাকি। বাংলাদেশের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বরাবরই নিম্ন পর্যায়ের আশপাশেই ঘুরছে, যদিও সব সময় কর রাজস্ব আহরণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল বা আছে অনেক বেশি। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা বেশি ধরা হলেও তা পূরণে সফলতার গতি গজেন্দ্রগামী। এ ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত, অবকাঠামোগত এবং বিবিধ সব ধরনের ত্রুটি দূর করে উপযুক্ত করদাতাদের মধ্য থেকে যত বেশিজনকে করের আওতায় আনা যায়, সে চেষ্টাই যেন শুধু চলছে। পাশাপাশি যেসব নিত্যনতুন আর্থিক খাত তৈরি হচ্ছে, সেগুলোকেও চটজলদি করের আওতায় আনার প্রয়াস চলছে। কিন্তু কর্মক্ষমতায় ও কর্মদক্ষতায় সে প্রয়াস কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনতে যথেষ্ট সময় নিচ্ছে। জিডিপি বাড়লে আহরণকৃত করের পরিমাণও বাড়বে, এটা স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। মোল্লা নাসির উদ্দীনের সেই গল্পের মতো বিড়াল মাংস খেয়ে ফেলেছে। বিড়ালের ওজন নিয়ে দেখা গেল মাংস ও বিড়ালের হিসাবে মেলানো কঠিন হচ্ছে। এই যদি বিড়ালের খাওয়া মাংস হয়, তাহলে বিড়াল কই। কিংবা এই যদি বিড়ালের ওজন হয়, তাহলে তার খাওয়া মাংস কোথায়। কর ফাঁকিবাজদের আড়াল করতে, ফাঁকি দিতে আয় অপ্রদর্শনকারীকে প্রশ্রয় দিতে মোটা অঙ্কে কর অব্যাহতি মওকুফ করে কর জিডিপি রেশিও বাড়ছে না- এটাকেও মানতে ভিন্নমত বা নারাজি হওয়াটাও কর জিডিপি রেশিওর উন্নতির পথে বাধা।
বছর বছর ট্যাক্স রেট, কর রেয়াতের মাত্রা, অবকাশের হার ও ক্ষেত্রে নিত্যনতুন সংশোধন, সংস্কার প্রস্তাবনা যেন বেড়েই চলেছে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে প্রতিবছরের অর্থ বিলে যদি এক একটা আইনের ধারা-উপধারা অতি পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও সংশোধনের হিড়িক পড়ে, তখন সংশ্লিষ্ট সবার পক্ষে ওই সব পরিবর্তন ফলো করা কঠিন তো হয়ই, এসব প্রয়োগে জটিলতা আরও বাড়ে বৈ কমে না। ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত নিতে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় করদাতাদের। আইনের সংশোধনসংক্রান্ত এসআরওর প্রয়োগ ন্যূনতম তিন বছর বা তার বেশি হলে ওই এআরওর কার্যকারিতা অনুসরণ, অনুধাবন যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এদিকে আয়কর পরিপত্র-১ জারিতে বিলম্ব করেও তাতে কিছু কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা নিরসনে ব্যাখ্যার অবকাশ থেকে যায়। এসবই সঠিক পরিমাণে ন্যায্য কর আদায়ের ক্ষেত্রে বিলম্ব সৃষ্টি বা অন্তরায় হিসেবে কাজ করতে পারে। পরিপত্রে স্পষ্টীকরণ করতে গিয়ে যে দীর্ঘসূত্রতা তা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব না হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রতিবেশগত নানা প্রভাব পুরো বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারে, অনেক ক্ষেত্রেই উপযুক্ত কর আদায়ের জন্য অপারগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের অর্থবছর শুরু থেকেই ঝড়বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি আরও নানান উপলক্ষের সমস্যা থাকে, এর সুযোগ নিয়ে আয়কর দেওয়ার সময় বাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে সবাই। এ অবস্থা থেকে স্থায়ীভাবে বেরিয়ে আসতেই এবার আইনের মধ্যেই সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন মাসের স্থলে পাঁচ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ নভেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যক্তি আয়কর দেওয়া যাবে। যেহেতু সবাই অপেক্ষা করে পরিপত্র জারির, তাই সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষায় কিংবা পরিপত্র জারির দেরি হওয়াকে হয়তো নভেম্বর নির্ধারণে প্রেরণা হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সবাইকে করের আওতায় আনতে চাই, তাহলে অর্থবছর শেষ হওয়ার পর পাঁচ মাস পর্যন্ত অপেক্ষার অবকাশ অর্থাৎ সময়ক্ষেপণের এ ধরনের অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সবার জন্য যথাসময়ে কর দেওয়ার সহজ সুযোগ সৃষ্টি শ্রেয়তর বিবেচিত হতে পারে।
বাজেটে নতুন হারে করারোপের পর অর্থবছরের শুরু থেকেই কর কীভাবে দিতে হবে, কোন কোন পরিস্থিতিতে কী করণীয়, সেটা নিশ্চিত না করা গেলে সমস্যা সৃষ্টি হবে, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে নভেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নেওয়ায় মূল সমস্যা যেটা হতে পারে সেটা হলো, কর প্রদান ও প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা বাড়বে। এ ক্ষেত্রে আগের তুলনায় দুই মাস পর কর আদায় হওয়ায় সামষ্টিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিড়ম্বনা ও ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। কেননা অর্থবছরের শুরু থেকে সরকারি অর্থ ব্যয় অব্যাহত থাকে, কিন্তু রাজস্ব আয় কত আসবে, সেটার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে বেশ কিছুটা সময়। ফলে ব্যাংক বরোয়িং বাড়তে থাকে। অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত কর না-ও আসতে পারে। একবারে তিন থেকে পাঁচ মাস টাইম বেড়ে যাওয়ায় সবাই যাতে যার যার মতো গা-ছাড়া ভাব বা বিলম্ব করার প্রবণতায় অর্জিতব্য রাজস্বের উপযোগিতা যাতে হ্রাস না পায়, সেদিকে সচেতন দৃষ্টিক্ষেপ প্রয়োজন হবে।
এ ক্ষেত্রে কর আহরণের প্রকৃতি এবং বাজেট প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনা প্রয়োজন। উল্লখ করা যেতে পারে, বেশ বিলম্ব করে শুরু হওয়া বাজেট-পূর্ব আলোচনাগুলোর কথা। বাজেট নিয়ে সবাই এমন একসময় নিজেদের দাবি ও সুপারিশ উত্থাপন শুরু করে তখন আর বাজেট প্রস্তাব সংশোধনের কোনো সুযোগ থাকে না। এ ক্ষেত্রে আলোচনা ও দাবিদাওয়া পেশ করার সময়ও পাওয়া যায় না ঠিকমতো। ফলে যে দাবি ও সুপারিশ আসছে তার বিবেচনায় কোনো ভিত্তি হয়ে ওঠে না, ফলে দাবিগুলো ও সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন বা পূরণ করা সম্ভব হয় না ঠিকমতো। অর্থ আইনেই নতুন কর আরোপ, ব্যাখ্যা, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এটি গ্রহণ, পরীক্ষা, পর্যালোচনা এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করার সাংবিধানিক এখতিয়ার বা কর্তৃত্ব এবং দায়দায়িত্ব সংসদের। অর্থ আইন পাস হওয়ার পর ওই আইন বা বিধিবিধান নিয়ে আদালতে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি এ জন্য যে, তাহলে কর আরোপে নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না। এই নিরিখে বাজেট তথা অর্থ আইন পাসে সংসদের মনোযোগ, সতর্কতা সর্বসম্মত অভিমত গঠন জরুরি। এই নিরিখে অর্থ আইন সংসদে পেশের আগে থেকেই এর প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় সংসদীয় কমিটিগুলোর অংশগ্রহণ অনিবার্য হয়ে ওঠে এ জন্য যে, আইন সংসদে পেশ হওয়ার পর এবং তা পাসের আগে চুলচেরা বিশ্লেষণের সময় পাওয়া যায় মাত্র কয়েকটা কার্যদিবস। অর্থ আইন পাসের পর বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে যেসব প্রতিবন্ধকতা উপস্থিত হয়, তা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব, তা পরিপালনের ব্যর্থতার জবাবদিহি চাওয়ার কর্তৃত্ব সংসদেরই।
আরেকটা প্রসঙ্গে একটু বলা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে অর্থবছর সম্পর্কিত। যেখানে অনেক দিন থেকেই বলা হচ্ছে বা দেখা যাচ্ছে খুব স্পষ্টতই যে, বাংলাদেশের অর্থবছরের সময়সীমা বদল হওয়া দরকার। আমাদের এখানে ভরা বর্ষায় অর্থাৎ ১৬ আষাঢ় পয়লা জুলাই থেকে শুরু হয়ে ১৫ আষাঢ় পর্যন্ত (৩০ জুন তা শেষ হয়), উভয় দিকেই নানান প্রাকৃতিক সমস্যা থাকে। এটা যা-ই হোক, অন্তত কর আদায়ের জন্য অর্থবছর গণনার জন্য উপযুক্ত সময়কাল হতে পারে না। কারণ বন্যা থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঝড়বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোক্ষম মৌসুমে কর আদায় শ্লথ হয়ে পড়ে। আয়কর আহরণের ক্ষেত্রে বর্তমানে যে নভেম্বর মাস বলবৎ করা হয়েছে তার সুবিধা একটাই যে, তখন প্রকৃতিগত কোনো সমস্যা থাকে না। নানা কারণ মিলে একটা বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায়, জুন-জুলাই যা-ই হোক অন্তত বাংলাদেশের জন্য অর্থবছর হিসেবে এপ্রিল-মার্চ কিংবা জানুয়ারি-ডিসেম্বর যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।
লেখক: সাবেক সচিব এবং এনবিআরের
সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]