বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতিসত্তার এক অসাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যার মূলমন্ত্র হলো নবজাগরণ, নবচেতনা এবং পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণ করা। সময়ের ক্যালেন্ডার ঘুরে আবার এসেছে পয়লা বৈশাখ, বাংলা ১৪৩২। এই দিনটি বাঙালির হৃদয়ে জাগায় এক অভাবনীয় আবেগ, ঐতিহ্য আর মিলনের আহ্বান। এ যেন রবীন্দ্রনাথের গানের সেই চিরন্তন ডাক- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। বৈশাখের এই আগমনী বার্তা কেবল ঋতুর পালাবদলের নয়, এটি জীবনের রূপান্তরের প্রতীক।
পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন মানে কেবল নতুন বছরকে বরণ করা নয়, বরং এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, অতীত স্মৃতি, বর্তমান চেতনা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার সম্মিলন। সেই সঙ্গে এটি একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শুদ্ধিকরণও, যার মর্মবাণী আমরা পাই রবীন্দ্রনাথেরই অমর পঙ্ক্তিতে- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’।
বাংলা সনের সূচনা হয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকে। তার শাসনামলে ১৫৮৪ সালে চন্দ্র ও সৌর পঞ্জিকার সমন্বয়ে প্রবর্তন হয় ফসলি সন, যার গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের কাছ থেকে সময়মতো খাজনা আদায় এবং কৃষিজীবী সমাজের হিসাব সহজ করা। পরবর্তীতে এটি হয়ে ওঠে বাঙালির নিজস্ব বর্ষপঞ্জি- বাংলা সন। আর এই সনের প্রথম দিন, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে উৎসব ও মিলনের প্রতীক।
প্রথমদিকে এই দিনটি ছিল মূলত অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যবসায়িক বার্ষিক হিসাবের সূচনা দিন। হালখাতা, নতুন খাতা খোলা, পুরানো দেনা মুছে ফেলা- এসবই ছিল পয়লা বৈশাখের প্রধান অনুষঙ্গ। কৃষিপ্রধান বাংলায় এই দিনটি কৃষকদের জন্য ছিল নতুন আশার সূচনা, জমিদারদের জন্য ছিল প্রশাসনিক গুরুত্ব, এবং ব্যবসায়ীদের জন্য ছিল শুভ সূচনা।
কিন্তু সময়ের স্রোতে এই দিনটি শুধু লেনদেনের দিন থেকে পরিণত হয়েছে জাতিসত্তার চেতনার উৎসবে। বাংলার মানুষ নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পেয়েছে এই দিনটিতে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় নববর্ষকে আহ্বান করেছেন এক ধ্বংস ও সৃজনের অনুপম সংলগ্নতায়। তার গান ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ শুধু একটি গান নয়, এটি এক সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক। এই আহ্বানে আছে পুরানো গ্লানি, অচলায়তন ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভাষা। নববর্ষ আসে শুধু সময়ের পরিবর্তন নিয়ে নয়, এটি আসে মনের মধ্যে, সমাজের মধ্যে, জাতির মধ্যে এক শুদ্ধি আনতে।
এই শুদ্ধির বার্তা আসে আরও তীব্রভাবে রবীন্দ্রনাথের সেই পঙ্ক্তিতে- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। এ যেন এক প্রতীকী আগুনে অশুভকে দহন করে শুভকে আহ্বান করার আহ্বান। বৈশাখের খরতাপে শুধু প্রকৃতি নয়, আমাদের চেতনা, মনন ও সমাজ যেন শুদ্ধ হয়ে ওঠে। তাই নববর্ষ মানে কেবল উল্লাস নয়, এটি আত্মশুদ্ধির এক সাংস্কৃতিক উদ্যাপন।
বাংলা ১৪৩২ এসেছে এমন এক সময়, যখন বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি প্রবল এক উত্তেজনা ও পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন, সামাজিক মাধ্যমে সাংস্কৃতিক চর্চা- সব মিলিয়ে পয়লা বৈশাখ এখন আগের চেয়ে ভিন্ন এক বাস্তবতায় উদ্যাপিত হচ্ছে।
ঢাকায় ছায়ানটের রমনা বটমূলে বর্যবরণ অনুষ্ঠান, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, শহরজুড়ে বিভিন্ন বৈশাখী মেলা, রেস্তোরাঁয় বৈশাখী মেনু, গ্রামে-গঞ্জে পান্তা-ইলিশ খাওয়া- এসবকিছু এখন নববর্ষের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এর পাশাপাশি আছে নিরাপত্তার কড়াকড়ি, নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, করপোরেট বাণিজ্যের আধিক্য এবং প্রান্তিক জনগণের অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধতা।
তবু আশার কথা-নতুন প্রজন্ম এখনো পয়লা বৈশাখকে নিজেদের বলে মনে করে। তারা এদিনে বাংলায় কথা বলে, বাংলা পোশাক পরে, বাংলা গান গায়, বাংলা কবিতা পড়ে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে তারা নববর্ষকে পৌঁছে দিচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে।
গ্রামে এখনো নববর্ষ মানে হালখাতা, মেলা, গান, নাটক, পুতুলনাচ, লাঠিখেলা। গ্রামের মাঠে-মাঠে হয় বৈশাখী গান, স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় উঠে আসে মাটির কথা, মানুষের কথা, প্রকৃতির কথা। যদিও প্রযুক্তির আধিপত্যে ও আর্থিকসংকটে অনেক জায়গায় ঐতিহ্যবাহী মেলা হারিয়ে যাচ্ছে, তবু কিছু কিছু অঞ্চলে একঝাঁক সৃষ্টিশীল মানুষ এখনো ধরে রেখেছে শতবর্ষের সংস্কৃতি।
প্রবাসে বসবাসরত বাঙালিদের জন্য পয়লা বৈশাখ এক ভিন্ন আবেগের দিন। দেশছাড়া বাঙালিরা এই দিনটিতে যেন ফিরে যেতে চান শেকড়ে। নিউইয়র্ক, টরন্টো, লন্ডন, সিডনি, কুয়ালালামপুর, রোম কিংবা মেলবোর্ন- যেখানেই বাঙালিরা আছেন, সেখানেই বসে বৈশাখী মেলা, কবিতা পাঠ, নাটক, সংগীতানুষ্ঠান, নৃত্য এবং প্রাচ্যধর্মী খাদ্য উৎসব। এটি তাদের সংস্কৃতির পুনঃসংযোগ এবং পরিচয়ের পুনর্নির্মাণ।
বাংলা নববর্ষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বর্তমান প্রজন্মের চর্চা ও সমাজের মূল্যবোধের ওপর। যদি আমরা নববর্ষকে কেবল বিনোদনের মাধ্যমে, করপোরেট বাণিজ্যে কিংবা ফ্যাশন শোতে সীমাবদ্ধ রাখি, তবে এর অন্তর্নিহিত চেতনা হারিয়ে যাবে। তাই আমাদের প্রয়োজন নববর্ষের চেতনার মূল- বাঙালিত্ব, শেকড়, ঐতিহ্য এবং শুদ্ধির বার্তাকে ধরে রাখা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নববর্ষ ঘিরে সাংস্কৃতিক চর্চার প্রসার, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা, বাংলা পঞ্জিকার আধুনিকায়ন এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা বাংলা নববর্ষকে করে তুলতে পারি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সৃজনশীল।
পরিবেশগত দিক থেকেও আমাদের সচেতন হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যদি বৈশাখী পরিবেশ বিপন্ন হয়, তবে তার প্রভাব পড়বে আমাদের সংস্কৃতিতেও। তাই নববর্ষ উদ্যাপনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের বার্তাও যেন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ কেবল একটি নতুন ক্যালেন্ডার বছরের সূচনা নয়, এটি একটি চেতনার নবজাগরণ। রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের নতুন আলোয়, নতুন প্রাণে আহ্বান জানায়- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’, আর আমাদের মনে জাগায় সেই মহৎ আকাঙ্ক্ষা- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’।
এই নববর্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাঙালি জাতি তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানবিক চেতনাকে ধারণ করেই এগিয়ে যাবে ভবিষ্যতের পথে। সময়ের ঝড়, রাজনীতির ধোঁয়াশা, বৈশ্বিক আগ্রাসন- সবকিছু উপেক্ষা করেই বাংলা নববর্ষ থাকবে আমাদের হৃদয়ের গভীরে। অতীতের গৌরব, বর্তমানের সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় বাংলা ১৪৩২ হোক শুদ্ধির, সংহতির এবং স্বপ্নের বার্তাবাহী এক নবদিগন্ত।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]