চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে দলের একাংশের তৎপরতায় জাতীয় পার্টিতে (জাপায়) সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। তবে জি এম কাদের তার অবস্থান থেকে সরে আসছেন না।
তিনি বলছেন, অপতৎপরতার সঙ্গে তিনি কোনো আপস করবেন না। যারা দলের গঠনতন্ত্রের নীতির বিরোধিতা করে ভাঙার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন তাদের সঙ্গে তিনি কোনো সমঝোতায় বসবেন না।
গতকাল রবিবার খবরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে এমন কঠোর অবস্থানের কথা জানান জি এম কাদের। তিনি জানান, নীতির সঙ্গে তিনি কোনোদিন আপস করেননি, করবেনও না। তবে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এর চেয়ে বেশি কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
এদিকে, আগামী ২৮ জুন রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জাপার দশম কাউন্সিল আয়োজনের চেষ্টা করছেন দলটির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মো. মুজিবুল হক চুন্নু। তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বিতীয় সারির কয়েকজন নেতা ও দু-তিনটি জেলার নিষ্ক্রিয় কয়েক নেতা এই কাউন্সিল আয়োজনের কথা বলে দলকে অস্থিতিশীল করছেন বলে দলে অভিযোগ উঠেছে। তবে জাতীয় পার্টির দপ্তর ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, দলের প্রেসিডিয়াম, কেন্দ্রীয় কমিটি ও তৃণমূলের নেতারা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে অকুণ্ঠ সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছেন। বারবার দলকে অস্থিতিশীল করার দায়ে তারা দলটির তিন শীর্ষস্থানীয় নেতার পদ ত্যাগের দাবিও তুলেছেন।
জাপার কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, জি এম কাদেরের অবস্থান স্পষ্ট । তিন শীর্ষ নেতার কারও সঙ্গে তিনি বৈঠকে বসবেন না; কথাও বলবেন না। এ ছাড়া দল ছেড়ে চলে যাওয়া ও বহিষ্কৃত নেতাদের আবারও দলে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে প্রেসিডিয়াম সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষপাতী তিনি। পার্টি ফোরাম সর্বসম্মতভাবে মতামত জানালে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। দলছুট বা বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফেরাতে জি এম কাদের এককভাবে কোনো উদ্যোগ নেবেন না বলে খবরের কাগজকে নিশ্চিত করেন জাপা নেতারা।
জাপা চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠরা জানান, যেসব নেতা চেয়ারম্যানের ক্ষমতা খর্ব করার নামে তৎপরতা চালাচ্ছেন, তারা মূলত সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলছেন। এই নেতারা আওয়ামী লীগের আমলেও সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলেছেন, তাকে বিপদে ফেলেছেন। এখনো একই ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তারা কখনো রওশন এরশাদকে সামনে রেখে, আবার কখনো বা বহিষ্কৃতদের সঙ্গে আঁতাত করে জি এম কাদেরকে চাপে রেখেছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জি এম কাদেরকে বাদ রেখেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশ নিয়েছিল। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে পুরো সময়টাই তারা নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে জি এম কাদেরকে চাপে রেখেছেন। বর্তমান তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত নেতারা ওই সময়ই গোপনে শেখ হাসিনা ও রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। এ কারণে শেখ হাসিনার সরকার ইচ্ছামতো জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করতে পেরেছে। ফলে নির্বাচনের আগে জি এম কাদের সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েও শেষ পর্যন্ত সরকারের চাপে নির্বাচনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ ওই নেতারা তখন সরকার ও রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। জি এম কাদের নির্বাচনে না গেলে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে ওই নেতারা তখন নির্বাচনে অংশ নিতেন। আর এর ফলে জাতীয় পার্টি আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়ত বলে রাজনীতিতে আলোচনা ছিল।
জাপার সূত্রগুলো জানাচ্ছে, গত ১৭ বছর যাবৎই ওই নেতারা ক্ষমতার সুবিধাভোগী ছিলেন। আবার এখনো তারা ক্ষমতার সঙ্গে থাকতেই কাদেরবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। কারণ কাদের সরকারের বিরুদ্ধে কিছুটা কঠোর অবস্থানে আছেন। জাপা নেতারা বলছেন, সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে জাতীয় পার্টিকে ওই নেতারা বিপদে ফেলার চেষ্টা করছেন। তাদের মূল টার্গেট জি এম কাদের ও জাপাকে ধ্বংস করা।
জি এম কাদের খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি আমার নীতি ও আদর্শে অটল আছি। আমি দলের কোনো নেতার বিরুদ্ধে অবিচার করিনি। নেতিবাচক অবস্থান নিইনি। পুরো দল আমার সঙ্গে আছে। দুয়েকজন নেতা যা বলছেন, যা করছেন সেটি তাদের ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধাপ্রসূত। কারও কাছে আমি নতি স্বীকার করব না।’
গত ২০ মে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সভার পরে দলে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হয়। দলের শীর্ষ তিন নেতা এবং প্রেসিডিয়ামের জনাতিনেক নেতা জাপা চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা রহিত করার পক্ষে মত দেন। এ নিয়ে দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে সভায় বাদানুবাদ হয়।
জানা গেছে, জাতীয় কাউন্সিল করার উদ্যোগ হিসেবে আগামী ২৮ জুনের জন্য রাজধানীর চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তাই জাপা চেয়ারম্যান কাউন্সিল অধিবেশন আয়োজনে কিছুদিন সময় চেয়ে নেন পার্টি ফোরামে। তবে দলের তিন শীর্ষ নেতার দাবি ছিল, তারা কাকরাইলেই এই কাউন্সিল অধিবেশন আয়োজন করতে চান। এ নিয়ে জি এম কাদেরকে চাপ দিলেও কোনো লাভ হয়নি। জি এম কাদের নির্বাচন কমিশনকে চিঠি লিখে জানান, জাপা ২৮ জুন কাউন্সিল অধিবেশন করবে না।
এ দুই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন জাপার তিন নেতা। তারা যেকোনো মূল্যে ২৮ জুন কাউন্সিল অধিবেশন আয়োজন করতে চেষ্টা করছেন।
ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ রবিবার খবরের কাগজকে বলেন, ‘তিনি (জি এম কাদের) কাউন্সিল অধিবেশনের ডাক দিয়ে এখন আবার তা বাতিল করতে চাইছেন। এটি তো হতে পারে না। চেয়ারম্যান জি এম কাদের যে কাউন্সিল ডেকেছেন আগামী ২৮ জুন, আমরা সেই কাউন্সিলে যাচ্ছি।’
জি এম কাদের সেই সম্মেলনে যেতে সম্মত হবেন কি না জানতে চাইলে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ কোনো মন্তব্য করেননি। তবে দলের চেয়ারম্যান সেই কাউন্সিলে না গেলে তা ‘আইনগতভাবে ত্রুটিযুক্ত’ হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলের সংবিধানের ১২ ধারায় বলা আছে, কাউন্সিল করতে গেলে সম্মতি লাগবে প্রেসিডিয়ামের। প্রেসিডিয়ামের সভাপতি হিসেবে চেয়ারম্যান যদি অনুপস্থিত থাকেন তাহলে সেই কাউন্সিল গ্রহণযোগ্য হবে না।’
দলে এই অস্থিরতায় জাপায় সপ্তম দফায় ভাঙনের প্রশ্ন জোরদার হয়েছে। এ নিয়ে জানতে চাইলে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘ভাঙন কীভাবে হয়? ভাঙন তো তখনই হয় যখন আলাদাভাবে কেউ দল থেকে বের হয়ে যাবে। আমরা তো তা করছি না। চেয়ারম্যান কাউন্সিল ডেকেছিলেন, আমরা সেই কাউন্সিলে যাচ্ছি।’
জাপার দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম বলেন, ‘অতীতে কাজী জাফর, মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো জনপ্রিয় নেতারা দল ভেঙে নতুন দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু হেভিওয়েট সেই নেতারাও তো সুবিধা করতে পারেননি। যতবার জাপায় দল ভেঙে নতুন কিছু করার চেষ্টা করা হয়েছে, ততবারই ব্যর্থ হতে হয়েছে। সুতরাং ভাঙনের চেষ্টা করে লাভ নাই। দলের চার-পাঁচজন নেতা ছাড়া সবাই জি এম কাদেরের পক্ষে আছেন।’
ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘যাদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে এখন, সেই তিনজন নেতা অনেক বড় মাপের নেতা। তারা অনেকবার মন্ত্রী বা এমপি ছিলেন। তারা অনেকবার জাতীয় পার্টির হাল ধরেছেন। আমার ধারণা তারা চেয়ারম্যানের নেতৃত্ব মেনে নেবেন। যেকোনো পার্টির চেয়ারম্যান থাকেন একজনই। তার নেতৃত্বে দল চলে। এটা তো মেনে নিতে হবে। তারা যদি জাতীয় পার্টিকে ভালোবাসেন, ধারণ করেন তবে সবাই মিলে একসঙ্গে থাকব। একসঙ্গে সবকিছু মোকাবিলা করব, একসঙ্গে নির্যাতিত হব।’
চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা খর্ব করতে দলের শীর্ষ নেতারা যে ফাটলের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন তা যেকোনো মূল্যে বন্ধ করা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
তিনি বলেন, ‘সিনিয়র কো চেয়ারম্যান, কো চেয়ারম্যানরা প্রেসিডিয়াম সভাতে বলতে পারতেন এই ধারাটি আমরা বাতিল চাই। সেখানে প্রেসিডিয়াম যদি বলত বাতিল; তাহলে বাতিল হয়ে যেত। এটা আসলে বাইরে আলোচনা করা, আন্দোলন করা বা সেপারেট কাউন্সিল করে এটা বাতিল করার দরকার ছিল না। এটার ফোরাম আছে। এখনো আলোচনার সুযোগ আছে।’