ঢাকা ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, সোমবার, ০৩ জুন ২০২৪

কোন কোন ব্যবসা নিষিদ্ধ বা হারাম?

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:৪৯ এএম
কোন কোন ব্যবসা নিষিদ্ধ বা হারাম?
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ছবি

ব্যবসা করেন কিংবা ব্যবসা করবেন, এমন প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের জেনে রাখা আবশ্যক কোন কোন ব্যবসা ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ বা হারাম। ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হালাল-হারামকে গুরুত্ব দিতে হবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের যে জীবিকা দিয়েছেন, তা থেকে বৈধ ও পবিত্র বস্তু আহার করো এবং আল্লাহকে ভয় করো- যার প্রতি তোমরা সবাই বিশ্বাসী।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৮৮)

 

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হালাল জীবিকার সন্ধান করা নির্ধারিত ফরজগুলোর পর বিশেষ একটি ফরজ।’ (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৮৩৬৭)

 

মদ, নেশাজাতীয় দ্রব্য, শূকর, মূর্তি-প্রতিকৃতি এবং ইসলামের দৃষ্টিতে যেসব পণ্য-দ্রব্য গ্রহণ, আদান-প্রদান নিষিদ্ধ সেগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য বা ক্রয়-বিক্রয়ও নিষিদ্ধ বা হারাম। অন্যায়, প্রতারণা, মধ্যস্বত্বভোগী কিংবা নিষিদ্ধ যে কোনও বস্তু-পণ্য-দ্রব্য-উপাদানের ব্যবসা হারাম। নিষিদ্ধ বা হারাম ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থও হারাম। আর এই হারাম উপার্জনে গড়া দেহ জান্নাতে প্রবেশ করার অনুমতি পাবে না। (হালাল-হারামের বিধান, ড. ইউসুফ আল-কারজাভি, অনুবাদ : আসাদুল্লাহ ফুআদ, সমকালীন প্রকাশন, পৃষ্ঠা : ২৬০)

 

স্বর্ণ ও রেশমের ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা বৈধ। নারীদের জন্য এর পণ্য হালাল। তবে স্বর্ণ বা রেশম দিয়ে এমন কিছু বানিয়ে বিক্রি করা যাবে না, যা কেবল পুরুষরাই ব্যবহার করতে পারবে। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ২৬০)

 

হারাম পণ্য-দ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা-বাণিজ্য করা হারাম। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসুল মদ, মৃত জন্তু, শূকর ও প্রতিমার বেচাকেনা হারাম করেছেন। তখন জানতে চাওয়া হলো, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি জানেন, লোকজন মৃত পশুর চর্বি দিয়ে নৌকায় প্রলেপ দেয়, চামড়া দিয়ে বার্নিশ করে, প্রক্রিয়াজাতের কাজ করে এবং লোকজন তা দিয়ে প্রদীপ জ্বালায়? এ কথা শোনর পর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এগুলো হারাম না। এরপর তিনি বললেন, আল্লাহতায়ালা ইহুদিদের ধ্বংস করেছেন। চর্বি হারাম করার পরও ইহুদিরা তা গলিয়ে বিক্রি কর এবং তার মূল্য ভোগ কর।’ (বুখারি, হাদিস : ২২৩৬; মুসলিম, হাদিস : ১৫৮১)

 

সুদের লেনদেন ‍ও সুদি কায়-কারবার পরিত্যাজ্য। সুদ নির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য হারাম এবং এর মাধ্যমে উপার্জনও হারাম। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ ব্যবসা করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫)

 

রাসুলুল্লাহ (সা.) সুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চার শ্রেণির মানুষকে লানত (অভিসম্পাত) করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ২২৩৬; মুসলিম, হাদিস : ১৫৮১)

 

ওজনে কম দেওয়া গুরুতর অপরাধ। ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা ওজনে কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১)

 

পণ্য-দ্রব্যের ত্রুটি লুকিয়ে বিক্রি করা নিষিদ্ধ। উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছি‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সুতরাং কোনও মুসলমানের জন্য তার অন্য ভাইয়ের কাছে পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে বিক্রি করা বৈধ নয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪৬)

 

বৈধ ব্যবসা পরিচালনার কোনও ধাপে যেসব ব্যবসায়ী দুষ্কর্ম ও অত্যাচার করবে, আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী তিনি বা তারা জাহান্নামিআল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আর নিশ্চয়ই দুষ্কর্মকারীরা জাহান্নামে থাকবে।’ (সুরা ইনফিতার, আয়াত : ১৪)

 

প্রতারণা করে ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা করা যাবে না। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতারণামূলক ও কাঁকর নিক্ষেপ করে ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২৩০)

 

মজুদদারি ও গুদামজাতকারীকে রাসুলুল্লাহ (সা.) পাপী বলেছেন। (মুসলিম, হাদিস : ৪২০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮৬১৭) সুতরাং মজুদদারি ও গুদামজাত ত্যাগ করে ব্যবসা করতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে মজুদদারি ও গুদামজাতকরণ নিষিদ্ধ।

 

মিথ্যা শপথ করে পণ্য-দ্রব্য বিক্রি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিবসে আল্লাহতায়ালা তিন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে দেখা করবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না এবং তাদের পবিত্রও করবেন না। এর মধ্যে অন্যতম এক শ্রেণি হলো, যারা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১০৬)

 

পণ্য-দ্রব্যের মূল্য নির্ধাণের ক্ষেত্রে জুলুম করা যাবে না এবং অতিরিক্ত মুনাফা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এমনভাবে পণ্যের মূল্য ঠিক করতে হবে, যাতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই সন্তুষ্ট ও লাভবান হন। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একবার এক ব্যক্তি এসে রাসুলুল্লাহকে (সা.) বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের পণ্য-দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি দোয়া কর। এরপর আরও এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের পণ্য-দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহতায়ালা পণ্য-দ্রব্যের মূল্য বাড়ান-কমান। আমার পক্ষ থেকে কারও প্রতি সামান্য জুলুমও থাকবে না, আমি অবশ্যই এমন অবস্থায় তার সঙ্গে মিলিত হতে চাই।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৫০)

 

গ্রাহককে ভেজাল পণ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে-ই হবে। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) খাদ্যশস্যের একটি স্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যের একটি স্তূপের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন এবং এতে তার আঙুলগুলো ভিজে গে। তিনি বললেন, হে স্তূপের মালিক! কী ব্যাপার? দোকানি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টির পানি পড়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন বললেন, তাহলে তুমি ভিজাগুলো স্তূপের ওপর দিকে রাখলে না কেন? লোকজন দেখে নিতে পারত। জেনে রাখো- যে ব্যক্তি ধোঁকা দেয়; সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৮৫)

 

লেখক : আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক

হজের পুরস্কার জান্নাত

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৪, ০৭:০০ পিএম
হজের পুরস্কার জান্নাত
কাবা শরিফ তাওয়াফ করছেন মুসল্লিরা। ছবি : আল-কাবা

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা আবশ্যক।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি মারাত্মক অসুবিধা, জালেম বাদশা কিংবা হজ আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কোনো ব্যাধি দ্বারা অবরুদ্ধ না হয়, আর সে হজ আদায় না করেই মারা যায়, তাহলে সে ইহুদি বা খ্রিষ্টান হয়ে মরুক (তাতে কিছু যায় আসে না)।’ (দারেমি, হাদিস: ১৮২৬)

যাদের ওপর হজ আবশ্যক
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার কাছে হজে গমন করার খরচ এবং এমন বাহনের ব্যবস্থা রয়েছে, যা তাকে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ তার সামর্থ্য ও সক্ষমতা রয়েছে এবং বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার বাহনের ব্যবস্থাও রয়েছে; এ সত্ত্বেও সে যদি হজ না করে, তাহলে তার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই যে, সে ইহুদি হয়ে মরল নাকি খ্রিষ্টান হয়ে। কেননা, আল্লাহতায়ালা বলেন, আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা সেসব নারী-পুরুষের ওপর আবশ্যক, যার জন্য বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য ও সক্ষমতা রয়েছে; আর যে তা অস্বীকার করল, সে জেনে রাখুক, আল্লাহতায়ালা সারা দুনিয়া থেকে অমুখাপেক্ষী।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস: ২৫২১)

হজ মানুষকে নিষ্পাপ করে
সামর্থ্যবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যারা হজ আদায় করবে, আল্লাহতায়ালা তাদের জন্য বহু ফজিলত রেখেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে হজ আদায় করবে এবং হজ পালন করা অবস্থায় অশ্লীল কথোপকথন না করবে এবং কোনো প্রকার পাপাচারে লিপ্ত না হয়, সে এমন পাপমুক্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করে, যেমন তার মা তাকে নিষ্পাপ অবস্থায় প্রসব করেছিল।’ (বুখারি, হাদিস: ১৫২১)

কবুল হজের পুরস্কার জান্নাত
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হজ এবং উমরা ধারাবাহিকভাবে পালন করতে থাকো। কেননা, এ দুটি দারিদ্র্য ও গুনাহসমূহকে এমনভাবে দূর করে দেয়, যেমন কর্মকারের হাপর লোহা ও সোনা-রুপা থেকে ময়লাকে দূর করে দেয়। আর কবুল হজের বিনিময় শুধু জান্নাত।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৮১০)

অতীতের সব পাপ মোচন হয়
ইবনু শামাসা আল মাহরি (রহ.) বলেন, ‘আমরা আমর ইবনুল আস (রা.)-এর মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে দেখতে গেলাম। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদলেন। দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলেন। এরপর বললেন, আল্লাহ যখন আমার অন্তরে ইসলামের অনুরাগ সৃষ্টি করে দিলেন, তখন আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে অনুরোধ জানালাম, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, আমি বাইয়াত হব। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু আমি আমার হাত গুটিয়ে নিলাম। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, কী ব্যাপার হে আমর। আমি বললাম, আমি শর্ত করতে চাই। তিনি বললেন, কী শর্ত করতে চাও? আমি বললাম, আল্লাহ যেন আমার (পেছনের সব) গুনাহ মাফ করে দেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আমর, তুমি কি জানো না, ইসলাম তার আগের সব পাপ দূর করে দেয় এবং হিজরত তার আগের সবকিছুকে বিনাশ করে দেয়। একইভাবে হজ তার আগের সবকিছুকে বিনষ্ট করে দেয়।’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস: ২৫১৫)।

হজের নানা কার্যক্রমে বহুমুখী প্রতিদান
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘একবার আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে মিনার মসজিদে উপবিষ্ট ছিলাম। এ সময় একজন আনসার ও সাকিফ গোত্রের এক লোক এসে সালাম দিল। এরপর বিভিন্ন প্রশ্ন করল। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি যখন বায়তুল্লাহ তওয়াফের উদ্দেশে বের হও, তোমার এবং তোমার উটের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহ তার জন্য একটি করে নেকি লেখেন। তোমার থেকে একটি গুনাহ মিটিয়ে দেন। তওয়াফের পর তোমার দুই রাকাত নামাজ আদায় বনি ইসমাইল গোত্রের একটি গুলাম মুক্ত করার সমান। এরপর সাফা-মারওয়ায় সাঈ করা সত্তরটি গোলাম মুক্ত করার সমতুল্য। তোমার সন্ধ্যায় আরাফায় অবস্থান করা, এ দিন আল্লাহতায়ালা প্রথম আকাশে নেমে আসেন এবং ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করে বলেন, ‘আমার বান্দারা দূর-দূরান্ত থেকে এলমেল হয়ে আমার কাছে এসেছে। তারা আমার রহমতের প্রত্যাশা করে। যদি তোমাদের গুনাহ বালুর পরিমাণ বা বৃষ্টির ফোঁটা বা সমুদ্রের ফেনার পরিমাণও হয়, তবু আমি তা ক্ষমা করে দেব। হে আমার বান্দারা, তোমরা কল্যাণের দিকে ধাবিত হও, তোমাদের জন্য ক্ষমা রয়েছে। তাদের জন্যও ক্ষমা রয়েছে, যাদের জন্য তোমরা সুপারিশ করবে।’ আর তোমার প্রতিটি নিক্ষিপ্ত কঙ্কর ধ্বংসাত্মক আমলের জন্য কাফফারাস্বরূপ। আর তোমার কোরবানিটি আল্লাহর কাছে তোমার জন্য ভাণ্ডার। আর তোমার মাথা মুণ্ডন, যার প্রতিটি চুলের বিনিময়ে তোমার জন্য রয়েছে একটি নেকি এবং এর মাধ্যমে তোমার একটি গুনাহ দূর হবে। আর তোমার বায়তুল্লাহর বিদায়ি তওয়াফ, যেটি তুমি করবে, এতে তোমার কোনো গুনাহ থাকবে না। ফেরেশতা এসে তোমার কাঁধে হাত রেখে বলবে, ভবিষ্যতের জন্য তুমি আমল করতে থাকো। কারণ, তোমার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে।’ (মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস: ৬১৭৭) 

লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক

যাদের ওপর হজ ফরজ

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৪, ০৯:০০ এএম
যাদের ওপর হজ ফরজ
হাজিদের সংবর্ধনা দিচ্ছেন সৌদি আরবের হজ কর্তৃপক্ষ। ছবি: হারামাইন

হজ আরবি শব্দ, যার অর্থ সংকল্প করা। হজ হলো নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট কার্যাবলির মাধ্যমে বায়তুল্লাহ শরিফ জেয়ারত করা অথবা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে বায়তুল্লাহ যাওয়ার সংকল্প করা। (ফতোয়ায়ে শামি, ২/৪৫৪)

হজ ইসলামি শরিয়তের অন্যতম স্তম্ভ ও রোকন। আর্থিক ও দৈহিকভাবে সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা ফরজ।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘লোকসকল, আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন।’ আকরা ইবনে হাবিস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, এটা কি প্রত্যেক বছর ফরজ?’ উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তবে ফরজ হয়ে যেত। আর প্রতি বছর হজ ফরজ হলে তা তোমরা সম্পাদন করতে সক্ষম হতে না। এ জন্য হজ জীবনে একবারই ফরজ। কেউ যদি একাধিকবার করে, তবে তা হবে নফল হজ।’ (বুখারি, হাদিস: ৭২৮৮)। এ ছাড়া হাদিসে হজের অসংখ্য সওয়াব ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।

যাদের ওপর হজ ফরজ

পাঁচটি শর্তসাপেক্ষে হজ ফরজ—

  • মুসলমান হওয়া।
  • আকল থাকা বা বিবেকবান হওয়া অর্থাৎ পাগল না হওয়া।
  • প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া।
  • স্বাধীন হওয়া অর্থাৎ কারও গোলাম না হওয়া।
  • দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া। 

তবে নারীদের ক্ষেত্রে সঙ্গে মাহরাম (যেসব পুরুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বৈধ) থাকা। স্মরণ রাখতে হবে, জাকাত ফরজ না হয়েও কারও ওপর হজ ফরজ হতে পারে। কেননা, হজ ও জাকাতের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। যেমন—জাকাতের সম্পর্ক নির্ধারিত নেসাবের সঙ্গে। হজের সম্পর্ক মক্কায় আসা-যাওয়ার খরচের সঙ্গে। সুতরাং স্থাবর সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে কেউ যদি হজ আদায় করতে সক্ষম হয় এবং হজ থেকে ফিরে এসে বাকি সম্পত্তি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, তাহলে তার ওপর হজ ফরজ। (আহসানুল ফাতাওয়া, ৪/৫১৬)

একইভাবে ব্যবসায়ীর দোকানে যে পরিমাণ পণ্য আছে, তার কিছু অংশ বিক্রি করলে যদি হজ করা সম্ভব হয় এবং ফিরে এসে যদি বাকি পণ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, তাহলে তার ওপরও হজ ফরজ। (ইমদাদুল আহকাম, ২/১৫৩)

হজ কখন করতে হয়?

হজের নির্দিষ্ট সময় হলো আশহুরুল হুরুম তথা শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিন; বিশেষত জিলহজের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত। এই পাঁচ দিনই মূলত হজ পালন করা হয়। হজের নির্ধারিত স্থান পবিত্র কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা ও মুজদালিফা। দূরের হাজিদের জন্য মদিনা মুনাওয়ারায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা জিয়ারত করা ওয়াজিব। হজের কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে ইহরাম, তালবিয়া, তওয়াফ ও সাঈ, উকুফে আরাফা, উকুফে মুজদালিফা, উকুফে মিনা, কংকর নিক্ষেপ, দম ও কোরবানি, হলক ও কসর, জিয়ারতে মদিনা এবং রওজাতুল রাসুলুল্লাহ (সা.) ইত্যাদি।

হজ কত প্রকার?

হজ তিন প্রকার—হজ্জে ইফরাদ, হজ্জে তামাত্তু ও হজ্জে কিরান। 

  • হজ্জে ইফরাদ হলো শুধু হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই ইহরামেই হজের সব আমল সম্পন্ন করা। 
  • হজ্জে তামাত্তু হলো শুধু ওমরার নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওমরার কাজ সমাপ্ত করা, এরপর মাথা মুণ্ডিয়ে ইহরাম থেকে মুক্ত হয়ে ওই সফরেই হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে হজের সব আমল সম্পাদন করা। 
  • হজ্জে কিরান হলো একসঙ্গে ওমরা ও হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই (একই) ইহরামেই ওমরা ও হজ পালন করা। এ তিন প্রকার হজের মধ্যে সওয়াবের দিক দিয়ে সর্বাধিক উত্তম হলো কিরান, এরপর তামাত্তু, এরপর ইফরাদ। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে সহজতার বিবেচনায় প্রথমে তামাত্তু, এরপর ইফরাদ, এরপর কিরান হজ উত্তম। (ফতোয়ায়ে শামি, ২/৫২৯)

লেখক: আলেম ও সাংবাদিক

হজের ফরজ, ওয়াবিজ ও সুন্নত

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ০৭:০০ পিএম
হজের ফরজ, ওয়াবিজ ও সুন্নত
সাঈ করছেন হাজিরা। ছবি : হারামাইন

পৃথিবীর পাড়া-মহল্লা আর নগর-বন্দর থেকে মানুষ ছুটছে মক্কায়। ইহরামের শুভ্রতায় একাকার হচ্ছে সবাই। এ এক নয়ন জুড়ানো দৃশ্য। সেদিকে শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। হাজিদের দিকে তাকালেই যেন দৃষ্টিতে পবিত্রতার পরশ মেখে যায়। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘সামর্থ্যবান প্রত্যেকের ওপর বায়তুল্লাহ জিয়ারত করা বা হজ করা আমার অধিকার। যে তা অস্বীকার করবে, তার জেনে রাখা উচিত, নিঃসন্দেহে আমি সৃষ্টিকুলের মুখাপেক্ষী নই।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)

হজের ফরজ ৩টি

  • মিকাত (রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত স্থান) থেকে ইহরাম বাঁধা।
  • ৯ জিলহজ আরাফার ময়দানে অবস্থান করা।
  • ১০ জিলহজ সুবহে সাদিকের পর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগে বায়তুল্লাহ তাওয়াফে জিয়ারত করা। এর কোনো একটি ব্যত্যয় ঘটলে হজ নষ্ট হয়ে যাবে, আবার হজ করতে হবে।

হজের ওয়াজিব ৬টি

  • ৯ জিলহজ সূর্যাস্তের পর থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত মুজদালিফায় অবস্থান করা।
  • সাফা-মারওয়ায় সাঈ করা। 
  • মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা।
  • ইহরাম খোলার জন্য মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছাঁটা। 
  • মিকাতের বাইরের লোকদের জন্য বিদায়ী তওয়াফ করা। 
  • কোরবানি করা। (এটি তামাত্তু ও কিরান হজ আদায়কারীদের জন্য ওয়াজিব, অন্যদের জন্য নয়)। এগুলো যদি যথাযথভাবে আদায় করা না যায়, তবে তা ছুটে যাওয়ার কারণে কোরবানি আবশ্যক হবে।

হজের সুন্নত ও মুস্তাহাব ৯টি

১. হজে ইফরাদ বা কিরান পালনকারীর তাওয়াফে কুদুম করা। 
২. তাওয়াফে কুদুমের প্রথম তিন চক্করে রমল করা। তাওয়াফে কুদুমে রমল না করে থাকলে তাওয়াফে জিয়ারাতে রমল করা। 
৩. জিলহজের ৮ তারিখে মক্কা থেকে মিনায় গিয়ে জোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজর—এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা এবং রাতে মিনায় অবস্থান করা। 
৪. জিলহজের নয় তারিখে সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফার ময়দানের দিকে রওনা হওয়া। 
৫. জিলহজের নয় তারিখে সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দান থেকে মুজদালিফার দিকে রওনা হওয়া। 
৬. উকুফে আরাফার জন্য সেদিন জোহরের আগে গোসল করা। 
৭. জিলহজের দশ, এগারো ও বারো তারিখ দিবাগত রাতগুলোতে মিনায় অবস্থান করা। 
৮. মিনা থেকে বিদায় নিয়ে মক্কায় আসার পথে মুহাসসাব নামক জায়গায় কিছু সময় অবস্থান করা। 
৯. ইমামের জন্য খুতবা দেওয়া। (ফতোয়ায়ে শামি, ২/৪৬৭, ফতোয়ায়ে আলমগিরি, ১/২১৯)

লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক

 

হজ কী ও কেন

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ০৯:৫৪ এএম
হজ কী ও কেন
মসজিদে হারামে নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা। ছবি: হারামাইন

হজ আরবি শব্দ, অর্থ সংকল্প করা। নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট কার্যাবলির মাধ্যমে বায়তুল্লাহ জিয়ারত করা অথবা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে বায়তুল্লাহ যাওয়ার সংকল্প করা হলো হজ। (কাওয়ায়িদুল ফিকহ, ২৫)। হজের নির্দিষ্ট সময়—শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিন। বিশেষত ৮ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন।

হজের বিধান
স্বাধীন সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের জন্য জীবনে একবার হজ ফরজ। সামর্থ্যবান বলতে আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য বোঝায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘লোকসকল, আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন।’ আকরা ইবনে হাবিস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, এটা কি প্রত্যেক বছর ফরজ?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তবে ফরজ হয়ে যেত। আর প্রতিবছর হজ ফরজ হলে তা তোমরা সম্পাদন করতে সক্ষম হতে না। হজ জীবনে একবারই ফরজ। কেউ যদি একাধিকবার করে, তবে তা হবে নফল হজ।’ (বুখারি, হাদিস: ৭২৮৮)

হজের প্রকারভেদ

  • ইফরাদ: হজের নিয়তে ইহরাম পরে ওই ইহরামেই হজ সম্পন্ন করা।
  • তামাত্তু: ওমরার নিয়তে ইহরাম পরে ওমরা শেষ করে মাথা মুণ্ডন করে ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়া। পরে ওই সফরেই হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে হজের কাজ শেষ করা।
  • কিরান: ওমরা ও হজের নিয়তে ইহরাম পরে ওই ইহরামে ওমরা ও হজ পালন করা।  (ফাতাওয়া শামি, ২/৫২৯)

হজ সর্বোত্তম আমল
যে কাজে কষ্ট বেশি, তার সওয়াব ও ফজিলত তত বেশি। ঈমানের পর জিহাদ ও হজকে সর্বোত্তম আমল বলা হয়েছে। একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘সর্বোত্তম আমল কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনা।’ প্রশ্ন করা হলো, ‘তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।’ আবার প্রশ্ন করা হলো, ‘এরপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘হজে মাবরুর তথা মকবুল হজ।’ (বুখারি, হাদিস: ১৫১৯)

হজের ফজিলত

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গুনাহর কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। আর মকবুল হজের পুরস্কার জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুই নয়।’ (বুখারি, হাদিস: ১৫২১)

দ্রুত হজ করার তাগিদ
হজ ফরজ হলে দ্রুত আদায় করা উত্তম। হজ বছরে নির্দিষ্ট সময়ে একবার আদায় করতে হয়। যেখানে মানুষের জীবন-মরণের এক সেকেন্ডের কোনো নিশ্চয়তা নেই, সেখানে এক বছর অনেক দীর্ঘ সময়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছে করেছে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা করে নেয়।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১৭৩২)

হজ ত্যাগের পরিণাম
হজ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। বিনা কারণে পরিত্যাগ করা মারাত্মক গুনাহ। হজ পরিত্যাগকারী সম্পর্কে আল্লাহতায়ালার কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও সতর্ক করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে বায়তুল্লাহ পৌঁছার পথ খরচের সামর্থ্য রাখে, অথচ হজ করল না, সে ইহুদি হয়ে মারা যাক বা খ্রিষ্টান হয়ে, তাতে কিছু আসে যায় না।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৮১২)

লেখক: আলেম ও সাংবাদিক

জিন: অদৃশ্য ও রহস্যময় এক সৃষ্টি

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ০৯:০০ এএম
জিন: অদৃশ্য ও রহস্যময় এক সৃষ্টি
সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত জিন উপত্যকার ছবি

আবহমান কাল থেকে মানুষের মধ্যে জিন সম্পর্কে নানারকম ভ্রান্ত ধারণা ও কল্পকাহিনি প্রচলিত আছে। তবে জিন, মানুষ এবং ফেরেশতাদের জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা। জিন এক অদৃশ্য সৃষ্টি, আল্লাহতায়ালা এদের আগুন থেকে তৈরি করেছেন। পৃথিবীতে এদের অস্তিত্ব ছিল, আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। জিনদের অস্তিত্ব, জীবনাচার, খাদ্য, বিয়েশাদি, আমল-ইবাদত, শ্রেণিবিন্যাস এবং জিনদের নানাবিধ কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন মিরাজ রহমানরায়হান রাশেদ

জিন বলা হয় কেন?
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তিনি (আল্লাহতায়ালা) জিনদের সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াহীন অগ্নিশিখা থেকে।’ (সুরা রহমান, ১৫) । আরবি ‘জিন’ শব্দের অর্থ আবরণ। জিন শব্দের ধাতু থেকে উৎপন্ন সব শব্দেই আবরণের অর্থ পাওয়া যায়। জিন ও মানুষের মাঝে টেনে দেওয়া হয়েছে আবরণ। ফলে মানুষ তাদের দেখতে পায় না। কিন্তু তারা ঠিকই মানুষকে দেখতে পায়। মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থাকায় তাদের জিন বলা হয়। আল্লাহতায়ালা জিন ও শয়তানদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘সে (শয়তান) ও তার দলবল তোমাদের যেভাবে দেখতে পায়, তোমরা তাদের সেভাবে দেখতে পাও না।’ (সুরা আরাফ, ২৭) 
সৃষ্টিজগতের মধ্যে একমাত্র মানুষ ও জিনদের আল্লাহতায়ালার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। মানবজাতির মতো কিয়ামতের মধ্য দিয়ে জিনেরাও ধ্বংস হয়ে যাবে। হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশ হবে শুধু এই দুই জাতির, তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে ভালো ও মন্দ কর্মের প্রতিদান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষ ও জিনদের একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত, ৫৬)
ইসলাম তো বটেই, অন্যান্য ধর্মও জিনের অস্তিত্ব স্বীকার করে। খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরা মনে করেন, সব জিনই ইবলিস শয়তান। তাদের মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। সৃষ্টিগতভাবে তারা মানুষ থেকে শক্তিশালী। তারাই মানুষের সব পাপের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল। তাই তাদের অপবিত্র আত্মা বা শয়তানের আত্মা বলে ডাকা হয়। (আল-মাওসুআতুল ইয়াহুদিয়া, ৫/১৫২৬)
ইহুদিদের ধর্মীয় গ্রন্থ তালমুদ অনুসারে, ‘শয়তান অর্থাৎ জিন কয়েক ধরনের, যাদের ভিন্ন ভিন্ন উপাদান থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের কাউকে সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন থেকে, কাউকে পানি থেকে, কাউকে আবার বাতাস থেকে। মাটি থেকেও তৈরি করা হয়েছে তাদের এক দলকে। তবে সবার রুহ সৃষ্টি করা হয়েছে চাঁদের আলোর এক বিশেষ ধরনের উপাদান দিয়ে।’ (আসাতিতুল ইয়াহুদ, লুইস জিনজবার্গ, ১/২১৩)

এদের কখন সৃষ্টি করা হয়েছে?
মানুষ সৃষ্টির আগে আল্লাহতায়ালা জিনদের সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কালো কাদামাটি থেকে, যা শুকিয়ে ঠনঠনে হয়েছিল। আর তাদের আগে জিনকে সৃষ্টি করেছি লেলিহান অগ্নিশিখা থেকে।’ (সুরা হিজর, ২৬-২৭)ইবনে আব্বাস (রা.), আতা ইবনে রাবাহ, হাসান আল-বসরি, মুকাতিল ও কাতাদাসহ অধিকাংশের মতে, ‘আল-জান্না’দ্বারা উদ্দেশ্য ইবলিস অর্থাৎ আল্লাহ জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন মানবজাতির আগেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা জান্নাতে আদমের প্রতিকৃতি তৈরি করার পর নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত রেখে দেন। তখন ইবলিস আদমের মাটির প্রতিকৃতির চারপাশ ঘুরে ঘুরে এর মধ্যে ফাঁকা দেখে সে বুঝতে পেরেছিল, এটা এমন এক সৃষ্টি, যারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।’(মুসলিম, ২৬১১) 
ইমাম হাকিম (রহ.) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘মানুষ সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে আল্লাহতায়ালা জিন জাতিকে সৃষ্টি করেন। পৃথিবীর সর্বত্র তারা ফেতনা-ফ্যাসাদ ছড়াতে থাকে। অবশেষে আল্লাহ ফেরেশতাদের আদেশ করেন, তাদেরকে পিটিয়ে সমতলভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সমুদ্রের বিভিন্ন দ্বীপে পাঠিয়ে দিতে। এরপর আল্লাহ যখন ফেরেশতাদের বললেন, পৃথিবীতে তিনি তাঁর প্রতিনিধি পাঠাবেন। ফেরেশতারা বলল, আপনি কি এমন জাতি পাঠাবেন, যারা ফেতনা-ফ্যাসাদ ও রক্তপাত করবে; আগে যেমন জিন জাতি করেছিল?’ (মুসতাদরাকুল হাকিম, ৩০৩৫) 
শরীর কেমন?
ইবলিস ও জিন সম্পর্কে আল্লাহ মানুষকে যতটুকু জানিয়েছেন, এর বাইরে তাদের অবয়ব, আকৃতি ও ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছুই জানে না। মানুষের মতো জিনদেরও চোখ, কান ও হৃদয় আছে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি অনেক জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা অনুধাবন করে না। তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না। তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং তার থেকেও নীচ; তারাই অমনোযোগী।’(সুরা আরাফ, ১৭৯)
বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত কিছু হাদিস থেকে জানা যায়, শয়তানদের জিহ্বা ও লালা আছে। আবু সাইদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘তিনি একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পেছনে ফজরের নামাজ আদায় করছিলেন। হঠাৎ নবি (সা.) তেলাওয়াতের মাঝে এদিক-সেদিক করে ফেলেন। নামাজ শেষ করে তিনি বলে ওঠেন, তোমরা যদি আমাকে আর ইবলিসকে দেখতে পেতে! আমি তাকে জাপটে ধরে তার শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করছিলাম। এমনকি আমার বৃদ্ধাঙুলি আর তর্জনীতে তার লালার শীতলতা টের পাচ্ছিলাম। আমার ভাই সুলাইমানের দোয়া না থাকলে আজ সকালে তোমরা তাকে মসজিদের খুঁটিতে বাঁধা অবস্থায় পেতে। আর মদিনার বাচ্চারা তাকে নিয়ে খেলা করত।’(মুসলিম, ৫৪২)

শ্রেণিবিন্যাস
জিনদের কি নাম আছে? কিংবা কোনো শ্রেণি বিভাগ? প্রকারভেদ অনুযায়ী তাদের একেক জনের নাম কি একেক রকম? চলুন বিষয়গুলো জেনে নিই—রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জিনেরা তিন ধরনের। এক. যাদের পাখা আছে, যার সাহায্যে তারা বাতাসে উড়তে পারে। দুই. যারা কুকুর ও সাপের বেশ ধরে থাকে। তিন. যারা এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়, আবার কোথাও অবস্থান করে।’ (মুসতাদরাকুল হাকিম, ৩৭০২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের বলেছেন, দ্বিতীয় প্রকারের জিন যদি বাসাবাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও সাপের বেশে দেখা যায় এবং বোঝা না যায়, সেটা সাপ না জিন। তা হলে সাপ হিসেবে এর অনিষ্ট থেকে বাঁচতে, সেটাকে মেরে ফেলা যাবে। এমনকি যদি কোনো পবিত্র স্থানেও দেখা যায়। তবে ঘরবাড়িতে দেখা গেলে তিনবার বলবে, ‘এটা তোমার আবাসস্থল নয়; আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, যদি তুমি মুমিন হও, এখান থেকে চলে যাও। যদি না যাও, আমি তোমাকে হত্যা করব।’ এভাবে তিনবার বলার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। আবু লুবাবা (রা.) বলেন, ‘নবি (সা.) ঘরবাড়িতে দেখতে পাওয়া সাপকে তিনবার সতর্ক করার আগে মারতে নিষেধ করেছেন।’ (বুখারি, ৩২৮৯)। তিনবার সতর্ক করার পরও যদি না যায়, তা হলে মেরে ফেলবে। কারণ সেটা কোনো জিন নয়; বরং সাধারণ সাপ। তৃতীয় প্রকারের জিন, তারা যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায়। ইচ্ছে হলে কোথাও নেমে থাকতে শুরু করে। কিছুদিন বা কয়েক মাস অথবা কয়েক বছর থাকার পর আবার চলে যায়। 
ইবনে আব্দিল বার (রহ.) বলেছেন, জিনদের বিভিন্ন শ্রেণি রয়েছে—১. সাধারণ জিনদের বলা হয় জিন্নি। ২. যেসব জিন মানুষের সঙ্গে বাসাবাড়িতে অবস্থান করে, তাদের বলা হয় আমির। ৩. যেসব জিন বাচ্চাদের সামনে আবির্ভূত হয়, তারা আরওয়াহ। এটি রুহ শব্দের বহু বচন। ৪. যেসব জিন খারাপ হয়ে যায় এবং মানুষের ক্ষতি করতে চায়, তারা শয়তান। ৫. যেসব শয়তানের দুষ্কৃতি খুব বেড়ে যায়, তাদের বলে মারিদ। ৬. যারা শক্তিশালী ও দুশ্চরিত্র হয়ে ওঠে, তাদের বলা হয় ইফরিত। (আত-তামহিদ, ইবনে আব্দিল বার, ১১/১১৭-১১৮)

দেখা যায় না কেন?
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মোরগের ডাক শুনলে তোমরা আল্লাহর কাছে রহমতের দোয়া করবে। কারণ মোরগ ফেরেশতাদের দেখতে পায়। আর গাধার ডাক শুনলে আল্লাহর কাছে শয়তানের কবল থেকে আশ্রয় চাইবে। কারণ গাধা শয়তানকে দেখতে পায়।’(বুখারি, ৩৩০৩)। এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, গাধা ও কুকুর জিনদের দেখতে পায়। পশুপাখিরা জিন ও ফেরেশতাদের দেখতে পায়। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহতায়ালা প্রাণীদের এমন অনেক ক্ষমতা দিয়েছেন, যা মানুষদের দেননি। নির্দিষ্ট প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণ করে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা নির্ণয় করা হয়। ভূমিকম্পের আগমন টের পেলে এসব প্রাণী খুব দ্রুত পালিয়ে বেড়ায়। বিপদ খুব কাছে চলে এলে এরা কান পেতে তা শোনে। এরা এমন সব আওয়াজ শোনে, যা মানুষ শুনতে পায় না। আধুনিক প্রযুক্তি এখনো এতটা উন্নত হয়নি, যা দিয়ে পৃথিবীর বুকের ভেতর প্রোথিত এসব ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাত থেকে নিশ্চিতভাবে আগাম সতর্কতা লাভ করা যায়। সংঘটিত কোনো পরিবর্তন দেখে আসন্ন বিপদের খবর পাওয়া যায়। অথচ আল্লাহ ছোট ছোট এসব প্রাণীকে এমন কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন, যার সাহায্যে এরা এ ধরনের অনেক আগাম খবর জানতে পারে।
আল্লাহ পশুপাখিদের বিশেষ সক্ষমতা দিয়েছেন, তাই তারা জিন ও ফেরেশতাদের দেখতে পায়। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ইমাম বুখারি মুসয়াব ইবনে উমাইর (রা.)-এর ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তার ঘোড়া রাতে কোরআন তেলাওয়াতের সময় যে ছোটাছুটি করছিল, তা মূলত ফেরেশতাদের দেখার কারণে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসয়াব (রা.)-কে বলেন, ‘তারা ছিল ফেরেশতা, তোমার সুমধুর তেলাওয়াত শুনতে তারা জড়ো হয়েছিল। যদি তুমি তেলাওয়াত করতেই থাকতে, সকালে মানুষ তাদের দেখতে পেত। তারাও মানুষদের থেকে আড়াল হতো না।’(বুখারি, ৫০১৮)

কোথায় বাস করে?
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ‘কার’ বিশিষ্ট ভূমিতে প্রবেশ করতে নিষেধ করছেন। কারণ সেটা তোমাদের ভাই জিনদের আবাসস্থল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘কার’ কি? তিনি বলেন, ঘন ঝাড়-জঙ্গল, গাছপালা বিশিষ্ট নিম্নাঞ্চল। এ ছাড়া জনবসতির শৌচাগার, গোসলখানা, নোংরা ও অপবিত্র স্থান, আবর্জনার স্তূপ এবং কবরস্থানে দুষ্ট জিন-শয়তান বিচরণ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় শৌচাগারে দুষ্ট জিন-শয়তান উপস্থিত থাকে। তাই তোমরা যখন সেখানে প্রবেশ করবে তখন বলবে, বাংলা উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিলান খুবুসি ওয়াল খবাইস।’ বাংলা অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে যাবতীয় দুষ্ট পুরুষ ও নারী জিন ও শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (আবু দাউদ, ৬) 
হাদিসে শৌচাগার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যেখানে নাপাকি থাকে বা শরীর বস্ত্রহীন করতে হয়, সেসব স্থানে শয়তানের আনাগোনা থাকে। মানুষকে বিবস্ত্র করা শয়তানের অন্যতম একটি মিশন। কারণ আল্লাহর এবং বান্দার মাঝে আবরণ হলো লজ্জা। আদম ও হাওয়া (আ.) যখন আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছিলেন, প্রথমেই তাদের শরীর থেকে জান্নাতি পোশাক খুলে গিয়েছিল।
রাসুলুল্লাহ (সা.) মাটির গর্তে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে সারজিসের সূত্রে কাতাদা (রহ.) বর্ণনা করেন, গর্তে প্রস্রাব করতে নবিজি (সা.) নিষেধ করেছেন। কাতাদাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কেন তিনি নিষেধ করেছেন? কাতাদা বলেন, ‘জিনদের বসবাসের স্থান।’
কবরস্থানে জিনেরা সাধারণত মানুষের মতোই যাতায়াত করে। আবার কখনো অবস্থান করে দীর্ঘদিন। ভালো-মন্দ সব ধরনের—এমনকি সেখানে দুষ্ট প্রকৃতির জিন-শয়তানরাও অবস্থান করে। একটা ভুল ধারণা লোকসমাজে প্রসিদ্ধ আছে, ‘বদকারদের কবরের আজাবের ভয়ে জিনেরা কবরস্থানে থাকে না।’ যেমনভাবে মানুষ কবরস্থানে যেতে ভয় পায়, বিশেষ করে একা একা রাতের বেলা, জিনেরাও তেমনই ভয় পায়। কবরে কাফেরকে প্রশ্নোত্তর করার পরের অবস্থা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অতঃপর তার জন্য লোহার বিশাল হাতুড়িধারী একজন অন্ধ ও বধির ফেরেশতা নিযুক্ত করা হয়। যদি সে ওই হাতুড়ি দিয়ে পাহাড়কেও আঘাত করে তবে পাহাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সেই ফেরেশতা ওই হাতুড়ি দিয়ে কাফেরকে এমন জোরে আঘাত করে; যার আওয়াজ মানুষ ও জিন ছাড়া পূর্ব-পশ্চিমের সব সৃষ্টি শুনতে পায়। আঘাতে সে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ধুলায় পরিণত হয়ে যায়। অতঃপর তাকে আবার জীবিত করা হয়।’ (আবু দাউদ, ৪৭৫৩)
এসব বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, জীবিত মানুষের কবরস্থানে যাওয়া-আসা বা অবস্থান করা যেমন সাধারণ বিষয়, হোক সে ভালো কিংবা খারাপ, মুমিন বা কাফের, তেমনই জিনদের বেলায়ও একই ব্যাপার। কারণ, মানুষের মতো তারাও কবরের ভয়ানক আজাব দেখতে বা শুনতে পায় না। তাই কবরস্থানে জিন-শয়তান থাকে না, এমন কথা একেবারেই অবান্তর; বরং বিভিন্ন কবরস্থানে মাঝে মধ্যে যে ভৌতিক ঘটনা ঘটে থাকে, তা মূলত সেখানে উপস্থিত জিন-শয়তানরাই করে থাকে। এ ছাড়াও বাজার ও দোকানপাটে দুষ্ট জিন-শয়তানের আনাগোনা বেশি থাকে। আল্লাহর রাসুল (সা.) জানিয়েছেন, ‘বাজারে শয়তান তার যুদ্ধের পতাকা উত্তোলন করে।’ (মুসলিম, ২৪৫১) 

খাদ্য ও পানীয়
শৌচকর্ম সম্পাদনের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার আবু হুরায়রা (রা.)-কে কিছু পাথর নিয়ে আসতে বললেন। তবে হাড় বা গোবর আনতে নিষেধ করলেন। আবু হুরায়রা (রা.) কাপড়ে করে কিছু পাথর এনে সেগুলো নবিজি (সা.)-এর পাশে রেখে চলে গেলেন। নবিজি (সা.) কাজ সেরে ফিরে আসার পর আবু হুরাইরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, হাড় ও গোবরে সমস্যা কী? তিনি উত্তরে বললেন, সেগুলো জিনদের খাবার। নাসিবিন শহরে জিনদের একটি প্রতিনিধি দল এসেছিল। তারা সবাই খুব ভালো জিন। আমার কাছে খাবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি আল্লাহর কাছে তাদের জন্য দোয়া করি। তাই তারা যে হাড় বা গোবরের পাশ দিয়ে যাবে, তাতেই নিজেদের জন্য খাবার খুঁজে পাবে।’ (বুখারি, ৩৮৬০)
এ জন্য কেউ যদি বিসমিল্লাহ বলে খাবার খায় এবং হাড় থেকে মাংস খাওয়ার পর নাপাক স্থানে না ফেলে, মুমিন জিনেরা সেই হাড় হাতে নিলে তাতে গোশত ফিরে আসবে। (তিরমিজি, ৩২৫৮)। আর দুষ্ট জিন এবং শয়তানরা খায় এমন সব খাবার, যেখানে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় না। যেসব খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা হয়, সেগুলো তারা ছুঁয়েও দেখে না। আর গোবরে জিনদের পশুদের জন্য খাবার জমা হয়। তার মানে জিনদের পোষা প্রাণী আছে এবং তারা তাতে আরোহণ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গোবর বা হাড় নাপাকি পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার করো না। কারণ এগুলো তোমাদের ভাই জিনদের খাবার।’ (তিরমিজি, ১৮)

বিয়ে ও সন্তানসন্ততি
জিনদের মধ্যে বিয়ের প্রচলন রয়েছে। জিন ও শয়তান একই জাতি, একই উপাদান দিয়ে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের মতো তাদেরও সংখ্যা বৃদ্ধি হয় প্রজননের মাধ্যমে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে (শয়তানকে) এবং তার চ্যালাচামুণ্ডাদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেছ? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। বস্তুত জালেমদের বিনিময় কতই না নিকৃষ্ট।’ (সুরা কাহাফ, ৫০)
জিনরাও স্ত্রী-সহবাস করে। তাদেরও আছে প্রবৃত্তির চাহিদা। জান্নাতের হুরদের বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যাদের এর আগে কোনো মানুষ বা জিন সম্ভোগ করেনি।’ (সুরা রহমান, ৫৬)
কাতাদা (রহ.) বলেন, ‘মানুষের মতো জিনরাও সন্তান জন্ম দেয়।’ (তাফসিরে ইবনে আবি হাতিম, ১২৮৫১)। ইমাম বাইহাকি, সাবিত (রহ.) থেকে মুরসাল সূত্রে বর্ণনা করেন, ইবলিস বনি আদমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আল্লাহর কাছে তার সন্তান বৃদ্ধির জন্য দরখাস্ত করলে আল্লাহতায়ালা ইবলিসের আবেদন মঞ্জুর করে বলেন, ‘প্রতি একজন বনি আদমের বিপরীতে তোর সন্তান জন্ম হবে ১০ জন করে।’ (বাইহাকি, ৬৬৬৯)

জিনের সঙ্গে মানুষের বিয়ে
মানুষ ও জিন আলাদা জাতি। মৌলিক উপাদান ভিন্ন হওয়া এটির বড় প্রমাণ। অধিকাংশ ফকিহ জিনের সঙ্গে মানুষের বিয়েশাদি নিষেধ করেছেন; চাই সে পুরুষ হোক বা নারী। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর অন্যতম একটি নিদর্শন হলো, তোমাদের থেকেই তিনি তোমাদের সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পারো। আর সুদৃঢ় করেছেন তোমাদের পরস্পরের মাঝে দয়া ও ভালোবাসা। নিশ্চয় এর মাঝে রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্য বহু নিদর্শন।’(সুরা রুম, ২১)
অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের থেকেই তোমাদের জোড়া তৈরি করেছেন।’(সুরা নাহল, ৭২)। এই দুই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিররা বলেছেন, ‘আল্লাহ পুরুষের সঙ্গী হিসেবে নারী জাতিকে সৃষ্টি করেছেন সমগোত্রীয় এবং একই উপাদান থেকে।’ আনাস ইবনে মালেক (রা.)-এর কাছে ইয়েমেনের এক সম্প্রদায় জিজ্ঞাসা করে, ‘একটি পুরুষ জিন আমাদের গোত্রের এক নারীর ব্যাপারে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, তারা ভেবেছিল এ ধরনের বিয়ে হালাল হবে। আমরা কি তা কবুল করব? উত্তরে তিনি বলেন, আমি তা ভীষণ অপছন্দ করি। এর দ্বারা বরং ফেতনাই বৃদ্ধি পাবে। কারণ যখন কোনো গর্ভবতী নারীকে জিজ্ঞাসা করা হবে এটা কার সন্তান? সে বলবে জিনের। (রুহুল মায়ানি, ১০/১৮৪) আনাস ইবনে মালেক (রা.)-এর মতে, ‘কেউ কেউ জিনের সঙ্গে বিয়েকে হারাম না বলে অপছন্দনীয় বলেছেন।’(মাজমাউল ফাতাওয়া, ১৯/৩৯)

আমল-ইবাদত
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি জিন ও মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য।’(সুরা জারিয়াত, ৫৬)। হাশরের ময়দানে মানুষের মতো জিনদেরও হিসাব-নিকাশ হবে, প্রতিদানস্বরূপ দেওয়া হবে জান্নাত ও জাহান্নাম। ইসলামে মানুষ ও জিনদের ইবাদতের পদ্ধতি একই। শুধু তাই নয়, জিনদের মধ্যেও রয়েছে মানুষের মতো ধর্ম বিভাজন। এ সম্পর্কে জিনদের উক্তি আল্লাহ সুরা জিনে উল্লেখ করেছেন, ‘আর নিশ্চয় আমাদের (জিনদের) কতক সৎকর্মশীল এবং কতক এর ব্যতিক্রম। মূলত আমরা ছিলাম (মুসলিম ও কাফের) বিভিন্ন দলে বিভক্ত।’(সুরা জিন, ১১)
জিনেরা অদৃশ্য হওয়ায় তাদের আমল মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় না। হাদিস, সাহাবি ও তাবিয়িদের থেকে এমন কিছু ঘটনার বর্ণনা উঠে এসেছে, যার মাধ্যমে জিনদের ইবাদত করার কথা জানা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমরা রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করো, তেলাওয়াত উচ্চৈঃস্বরে করবে। কারণ এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করে বা সেই ঘরে বসবাস করে এমন জিন; তার সঙ্গে নামাজ আদায় করে ও মনোযোগসহকারে কোরআনের তেলাওয়াত শোনে।’(মুসনাদুল বাজজার, ২৬৫৫)
হজ ও ওমরার মতো শারীরিক ইবাদতেও জিনদের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে। আবু নুআইম স্বীয় গ্রন্থ দালাইলুন নুবুওয়াহতে বর্ণনা করেছেন, আতা ইবনে রাবা বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে আমর একবার মসজিদুল হারামে ছিলেন। হঠাৎ একটি সাপ এসে বায়তুল্লায় সাতটি তাওয়াফ করল এবং মাকামে ইবরাহিমে গিয়ে নামাজ আদায় করল। তখন আবদুল্লাহ ইবনে আমর দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে জিন, তোমার ইবাদত তো শেষ হয়েছে। মূর্খ লোকদের ভয়ে এখানে তোমার অবস্থান আমি নিরাপদ মনে করি না। এটা শুনে সাপটি কুণ্ডলী পাকিয়ে বসল, তারপর আকাশে উড়ে গেল।’(দালাইলুন নুবুওয়াহ, আবু নুআইম, ৫১৫)
মুমিন জিনরা নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত করলেও কাফের ও দুষ্ট জিনরা সব সময় মানুষ ও জিনের ইবাদত ভণ্ডুল করতে সক্রিয় থাকে। (বুখারি, ৩৪২৩)

ইবলিস শয়তান জিন নাকি ফেরেশতা?
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সেজদা করো; তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সেজদা করল। সে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ (সুরা বাকারা, ৩৪) 
কোরআনের এই আয়াত থেকে কারও কারও মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, ইবলিসকে কেন ফেরেশতাদের সঙ্গে সিজদা করতে আদেশ করা হলো? ইবলিস কি তাহলে ফেরেশতাদের দলভুক্ত? ইবলিস জিনদের একজন, তার মৌলিক উপাদান আগুন। ইমাম রাজি (রহ.) তিনটি দলিল উপস্থাপন করে বলেছেন, ‘ইবলিসের জিন প্রমাণিত হওয়ার জন্য এই দলিলগুলো যথেষ্ট।’(আত-তাফসিরুল কাবির, ২/৪২৯-৩০)
এক. ইবলিসকে সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন থেকে। কোরআনে এসেছে, ইবলিস বলেছে, ‘আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে আর তাকে (আদমকে) সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে।’(সুরা আরাফ, ১২)
দুই. ইবলিসের ছেলেমেয়ে আছে, সে বংশবিস্তার করে। ফেরেশতারা এসব বিষয় থেকে মুক্ত। তাদের স্ত্রী-সন্তান নেই। তাদের মধ্যে নেই নারী-পুরুষের বিভাজনও। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি তাকে (ইবলিসকে) এবং তার বংশধরকে আমার পরিবর্তে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করছ?’ (সুরা কাহফ, ৫০)
তিন. ফেরেশতারা আল্লাহর সব আদেশ মেনে চলে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তারা (ফেরেশতারা) কখনোই আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না; বরং যে কাজে তাদের নিয়োজিত করা হয়েছে, সব সময় সেই কাজই করে।’(সুরা তাহরিম, ৬)

লেখকদ্বয় : বিভাগীয় সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক, ইসলাম, খবরের কাগজ