ব্যবসা করেন কিংবা ব্যবসা করবেন, এমন প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের জেনে রাখা আবশ্যক কোন কোন ব্যবসা ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ বা হারাম। ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হালাল-হারামকে গুরুত্ব দিতে হবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের যে জীবিকা দিয়েছেন, তা থেকে বৈধ ও পবিত্র বস্তু আহার করো এবং আল্লাহকে ভয় করো- যার প্রতি তোমরা সবাই বিশ্বাসী।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৮৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হালাল জীবিকার সন্ধান করা নির্ধারিত ফরজগুলোর পর বিশেষ একটি ফরজ।’ (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৮৩৬৭)
মদ, নেশাজাতীয় দ্রব্য, শূকর, মূর্তি-প্রতিকৃতি এবং ইসলামের দৃষ্টিতে যেসব পণ্য-দ্রব্য গ্রহণ, আদান-প্রদান নিষিদ্ধ সেগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য বা ক্রয়-বিক্রয়ও নিষিদ্ধ বা হারাম। অন্যায়, প্রতারণা, মধ্যস্বত্বভোগী কিংবা নিষিদ্ধ যে কোনও বস্তু-পণ্য-দ্রব্য-উপাদানের ব্যবসা হারাম। নিষিদ্ধ বা হারাম ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থও হারাম। আর এই হারাম উপার্জনে গড়া দেহ জান্নাতে প্রবেশ করার অনুমতি পাবে না। (হালাল-হারামের বিধান, ড. ইউসুফ আল-কারজাভি, অনুবাদ : আসাদুল্লাহ ফুআদ, সমকালীন প্রকাশন, পৃষ্ঠা : ২৬০)
স্বর্ণ ও রেশমের ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা বৈধ। নারীদের জন্য এর পণ্য হালাল। তবে স্বর্ণ বা রেশম দিয়ে এমন কিছু বানিয়ে বিক্রি করা যাবে না, যা কেবল পুরুষরাই ব্যবহার করতে পারবে। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ২৬০)
হারাম পণ্য-দ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা-বাণিজ্য করা হারাম। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসুল মদ, মৃত জন্তু, শূকর ও প্রতিমার বেচাকেনা হারাম করেছেন। তখন জানতে চাওয়া হলো, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি জানেন, লোকজন মৃত পশুর চর্বি দিয়ে নৌকায় প্রলেপ দেয়, চামড়া দিয়ে বার্নিশ করে, প্রক্রিয়াজাতের কাজ করে এবং লোকজন তা দিয়ে প্রদীপ জ্বালায়? এ কথা শোনর পর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এগুলো হারাম না। এরপর তিনি বললেন, আল্লাহতায়ালা ইহুদিদের ধ্বংস করেছেন। চর্বি হারাম করার পরও ইহুদিরা তা গলিয়ে বিক্রি করত এবং তার মূল্য ভোগ করত।’ (বুখারি, হাদিস : ২২৩৬; মুসলিম, হাদিস : ১৫৮১)
সুদের লেনদেন ও সুদি কায়-কারবার পরিত্যাজ্য। সুদ নির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য হারাম এবং এর মাধ্যমে উপার্জনও হারাম। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ ব্যবসা করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চার শ্রেণির মানুষকে লানত (অভিসম্পাত) করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ২২৩৬; মুসলিম, হাদিস : ১৫৮১)
ওজনে কম দেওয়া গুরুতর অপরাধ। ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা ওজনে কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১)
পণ্য-দ্রব্যের ত্রুটি লুকিয়ে বিক্রি করা নিষিদ্ধ। উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছি—‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সুতরাং কোনও মুসলমানের জন্য তার অন্য ভাইয়ের কাছে পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে বিক্রি করা বৈধ নয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪৬)
বৈধ ব্যবসা পরিচালনার কোনও ধাপে যেসব ব্যবসায়ী দুষ্কর্ম ও অত্যাচার করবে, আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী তিনি বা তারা জাহান্নামি। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আর নিশ্চয়ই দুষ্কর্মকারীরা জাহান্নামে থাকবে।’ (সুরা ইনফিতার, আয়াত : ১৪)
প্রতারণা করে ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা করা যাবে না। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতারণামূলক ও কাঁকর নিক্ষেপ করে ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২৩০)
মজুদদারি ও গুদামজাতকারীকে রাসুলুল্লাহ (সা.) পাপী বলেছেন। (মুসলিম, হাদিস : ৪২০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮৬১৭) সুতরাং মজুদদারি ও গুদামজাত ত্যাগ করে ব্যবসা করতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে মজুদদারি ও গুদামজাতকরণ নিষিদ্ধ।
মিথ্যা শপথ করে পণ্য-দ্রব্য বিক্রি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিবসে আল্লাহতায়ালা তিন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে দেখা করবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না এবং তাদের পবিত্রও করবেন না। এর মধ্যে অন্যতম এক শ্রেণি হলো, যারা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১০৬)
পণ্য-দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে জুলুম করা যাবে না এবং অতিরিক্ত মুনাফা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এমনভাবে পণ্যের মূল্য ঠিক করতে হবে, যাতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই সন্তুষ্ট ও লাভবান হন। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একবার এক ব্যক্তি এসে রাসুলুল্লাহকে (সা.) বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের পণ্য-দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি দোয়া করব। এরপর আরও এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের পণ্য-দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহতায়ালা পণ্য-দ্রব্যের মূল্য বাড়ান-কমান। আমার পক্ষ থেকে কারও প্রতি সামান্য জুলুমও থাকবে না, আমি অবশ্যই এমন অবস্থায় তার সঙ্গে মিলিত হতে চাই।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৫০)
গ্রাহককে ভেজাল পণ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে-ই হবে। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) খাদ্যশস্যের একটি স্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যের একটি স্তূপের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন এবং এতে তার আঙুলগুলো ভিজে গেল। তিনি বললেন, হে স্তূপের মালিক! কী ব্যাপার? দোকানি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টির পানি পড়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন বললেন, তাহলে তুমি ভিজাগুলো স্তূপের ওপর দিকে রাখলে না কেন? লোকজন দেখে নিতে পারত। জেনে রাখো- যে ব্যক্তি ধোঁকা দেয়; সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৮৫)
লেখক : আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক