আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুনভাবে কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাতে কোনো ধরনের অব্যাহতি দেওয়া যাবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিরা। একই সঙ্গে বর্তমানে যেসব খাতে বড় অঙ্কের অব্যাহতি রয়েছে, তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্যও বলেছেন। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প, মোবাইল এবং জ্বালানি খাতের রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহার বা কমানোর ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) কোনো ধরনের যুক্তি উপস্থাপন না করার অনুরোধ করেছে আইএমএফ।
গতকাল রবিবার এনবিআরের বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে সকাল ১০টা থেকে টানা সাড়ে ৫ ঘণ্টার বৈঠকে এসব সুপারিশ করে আইএমএফ। এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে এনবিআরের কর, ভ্যাট ও শুল্ক শাখার সদস্য, দ্বিতীয় ও প্রথম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। আইএমএফের ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাতের সুপারিশগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে ধরে। একাধিক বিশ্বস্ত সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিরা করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা করার সুপারিশ করেন। তারা ন্যূনতম কর বাতিল করে এর হার বাড়ানোর পক্ষে বলেন। এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করে এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলে করদাতা হারাবে এনবিআর।
এ বৈঠকে আইএমএফ রাজস্ব প্রশাসনের সততা নিশ্চিতে জোর দিয়ে আদায় কর অবকাশ সুবিধার আওতা কমানো, করদাতার সংখ্যা বাড়ানো, নতুন প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন গ্রহণে বাধ্য করা, ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনা, রাজস্ব পরিশোধে সম্পূর্ণ ই-পেমেন্টের ব্যবহার, অটোমেশনের মাধ্যমে রাজস্ব পরিশোধের তথ্য এনবিআরের তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয় আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে। আইএমএফ থেকে ৩ কোটি টাকা টার্নওভারে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণে জোর দিয়েছে।
এভাবে বৈঠকের শুরু থেকেই আইএমএফ প্রতিনিধিরা আগামী অর্থবছরের রাজস্ব বাজেটের ছক কষে এনবিআর কর্মকর্তাদের পর্যায়ক্রমে জানিয়েছেন। এ সময় দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা অনেক দিন থেকেই তৈরি পোশাকশিল্প বিভিন্ন রাজস্ব সুবিধা পেয়ে আসছে উল্লেখ করে এসব সুবিধা এখন কমানোর সময় হয়েছে বলেও যুক্তি তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তারা মোবাইল ও জ্বালানি খাতের রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহারের সুপারিশ করেন।
আগামী অর্থবছরের আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ক্ষেত্রে এনবিআরের কৌশল কী জানতে চাওয়া হলে এনবিআর থেকে জানানো হয়, ভূমি রেজিস্ট্রেশন, সিগারেট, মোবাইল, ভ্রমণ কর, পরিবেশ সারচার্জ, কার্বোনেটেড বেভারেজ, করের পরিধি বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং বকেয়া কর আদায়ের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে।
পরোক্ষ কর আদায়ের চেয়ে পর্যায়ক্রমে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে বেশি মনোযোগী হতে হবে বলে আইএমএফ প্রতিনিধিরা জানান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ বিষয়টির চর্চা হয়ে এলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখনো ভ্যাটের ওপরই ভর করে রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ খাতের লক্ষ্য ১ লাখ ৬২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার কম হওয়া যাবে না। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১ লাখ ৯৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার কম হওয়া যাবে না।
বৈঠকে এনবিআরের আদায়ের ঘাটতি নিয়ে আলোচনা হয়। দাতা সংস্থা থেকে আবারও এনবিআরকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, ঋণের কিস্তি ছাড়ের অন্যতম শর্ত হলো রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ও রাজস্ব খাতের সংস্কার।
এ সময় এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের হিসাব নিয়েও আলোচনা হয়। জানানো হয়, রাজস্ব খাতে সংস্কারের মাধ্যমে এনবিআরকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩ করতে হবে। এ শর্ত পূরণ করতে গেলে বর্তমানে যে রাজস্ব আয় আছে, তার থেকে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করতে হবে। অথচ এরই মধ্যে এনবিআরের ঘাটতি ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলেও বৈঠকে আলোচনা হয়।
বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিরা স্পষ্ট বলেন, আগামী অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে কর-জিডিপির অনুপাত ৮ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রাজস্ব থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করতে হবে। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে বলেছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এ অর্থবছরে এনবিআরকে বর্তমান আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত আরও ৯৬ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। সব মিলিয়ে এনবিআরকে আগামী ৩ অর্থবছর শেষে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের হিসাব মিলিয়ে দেওয়ার জন্য বলা হয়।