রিকন্ডিশনড বা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি দেখতে একেবারে ঝা চকচকে নতুন গাড়ির হয় না। তবে দেখেশুনে কিনলে এই গাড়িগুলোও অনেক দিন ব্যবহার করা যায়। যা একদিকে বিলাসিতাও হবে, অপরদিকে পকেটকেও খানিকটা আরাম দেবে। বেশ কিছু সময় ব্যবহারের পর রিপেয়ার করে বাজারে আসে রিকন্ডিশনড গাড়ি। এসব গাড়ি ১ থেকে ৫ বছরের পুরোনো হয়ে থাকে। আর এই রিকন্ডিশনড গাড়ি কিনতে যাচাই করে নিন অকশন শিট। জানাচ্ছেন আবরার জাহিন
অকশন শিট
জাপান থেকে বাংলাদেশে রিকন্ডিশনড গাড়ির সিংহভাগ আসে। আপসহীন মানের জন্য জাপানি গাড়ির খ্যাতি বিশ্বজোড়া। কয়েক বছর ব্যবহারের পর জাপানিরা গাড়ি পরিবর্তন করে নতুন গাড়ি কেনেন। এর ফলে দেশটিতে নির্দিষ্ট সময় পর অনেক গাড়ি জমে যায়। এসব গাড়িই জাপানে অকশন বা নিলামে তোলা হয়। পরবর্তীতে সেগুলো রিকন্ডিশনড গাড়ি হিসেবে দেশে আসে।
খুঁটিনাটি তথ্য ও ছবিসহ রিকন্ডিশন গাড়ি অকশন হাউসে রাখা হয়। একটি কাগজেই গাড়ির সব তথ্য থাকে। যেন কাগজগুলো পড়ে যে কেউ গাড়ি সম্পর্কে চটজলদি স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারেন। গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় একটি গাড়ি দেখতে দু-তিন মিনিটের বেশি সময় পাওয়া যায় না। জাপানিদের তৈরি অকশন শিট দেখে যে কেউ গাড়ি কিনতে পারেন। কারণ অকশন শিটে হুবহু গাড়ির নির্ভুল বর্ণনা দেওয়া থাকে। বড় কোনো সমস্যা ছাড়াই এসব গাড়ি হাজার হাজার মাইল চালানো যায়। জাপানি রিকন্ডিশনড গাড়ির মান ভালো হওয়ায় ইউরোপ বা আমেরিকার গাড়ির তুলনায় দাম বেশি থাকে।
অকশন শিট দেখলে আপনার রিকন্ডিশন গাড়ি চোখে দেখারও প্রয়োজন পড়বে না। অকশন শিটে একটি গাড়ির সবকিছুর বিশদ বর্ণনা দেওয়া থাকে। যা দেখে আপনি গাড়িটি কিনতে পারবেন। অকশন শিটে গাড়ির মাইলেজের ওপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
যেমন- একটি গাড়ি যদি ১০ হাজার কিমি. চলে তাহলে সেটার দাম বেশি হবে আর ৫০ হাজার কিমি মাইলেজের গাড়ির দাম কম হবে। তবে বাংলাদেশে অকশন শিটগুলো দেখার সময় অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে নেবেন। তাহলে ঠকে যাওয়ার চিন্তা থাকবে না।
রিকন্ডিশন গাড়ি গ্রেডের ব্যাখ্যা
সাধারণত অকশন শিটে গাড়ির গ্রেডিং তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে করা হয়। প্রথমত, এক্সটেরিওর বা গাড়ির বাইরের বিষয়; দ্বিতীয়ত, ইন্টেরিওর বা ভেতরের বিষয় ও তৃতীয়ত, মাইলেজ বা গাড়িটি কত কিলোমিটার চলাচল করেছে।
এক্সটেরিওর গ্রেডিং
গাড়ির ডেন্ট, ঘষা খাওয়া বা অন্য কোনো সমস্যা ইংরেজি অক্ষর এ, বি, সি, ডি দিয়ে বোঝানো হয়। এ, বি, সি, ডি দিয়ে যথাক্রমে গাড়ির অল্প সমস্যা থেকে বেশি সমস্যা নির্দেশ করে।
গ্রেড এ- গাড়ির বাইরের একদম নতুনের মতো দেখতে হলে ‘এ’ দিয়ে বোঝানো হয়।
গ্রেড বি- একটু দাগ তবে খুব সহজেই তোলা যাবে এমন হলে ‘বি’ গ্রেড ব্যবহার করা হয়।
গ্রেড সি- যদি গাড়ির এক্সটেরিওরের অবস্থা মোটামুটি ভালো থাকে, তবে অল্প কোনো পোড়া দাগ থাকে তাহলে এটি হবে ‘সি’ গ্রেড।
গ্রেড ডি- ‘ডি’ গ্রেড দিয়ে বোঝানো হয় গাড়ির বাইরের অবস্থা খুব খারাপ।=
ঝকঝকে নতুনে মতো গাড়ির জন্য গ্রেড ‘এস’ ব্যবহার করা হয়। এই গ্রেডের গাড়ি এতই নতুনের মতো যে, না বলে দিলে বুঝতেই পারবেন না এটি ব্র্যান্ড নিউ না। অকশন হাউস থেকে বলা হয় এই গাড়িটির মাইলেজ সর্বোচ্চ ১০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে বাস্তবে এস গ্রেডের গাড়ি সাধারণত কয়েক শ কিলোমিটার মাইলেজের, এমনকি শুধু ডেলিভারি মাইলেজেরও হয়ে থাকে।
এই গ্রেডের গাড়ি বাংলাদেশে খুব কম আসে। বাংলাদেশে মূলত ‘এস’ গ্রেডের গাড়ি ব্র্যান্ড নিউ বলে বিক্রি করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া আরও কিছু অক্ষর দিয়ে গাড়ির বাইরের অবস্থা বর্ণনা করা হয়-
এ- গাড়ির ওপরের অংশে কোনো দাগ
ইউ- গাড়িতে কোনো প্রকার গর্ত থাকলে
বি- দাগের সঙ্গে কিছু গর্ত দেখা গেলে
ডব্লিউ- গাড়িতে হালকা কাজ করানো হয়েছে এমন
এস- জং ধরা (কমলা রং দেখা যায় এমন)
সি- জং বেড়ে ভেতরের ধাতুর অংশ দেখা যায় এমন
পি- রঙের দাগ
এইচ- রং উঠে যাওয়া
এক্সএক্স- প্যানেল প্রতিস্থাপন করা
এক্স- কোনো পার্টসের প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন
জি- গ্লাসে পাথর টুকরা
ওয়াই- ফাটা কোনো কিছু দেখা গেলে
ই- টোল খাওয়া
ইন্টেরিওর গ্রেডিং
গ্রেড এ- গাড়ির ভেতরে কোনো পার্টস খোয়া যায়নি এমন ক্ষেত্রে এই গ্রেডে ব্যবহার করা হয়। সব পার্টস মজুত রয়েছে।
গ্রেড বি- এই গ্রেডের গাড়িগুলো মোটামুটি ভালো থাকে। কোনো রং, ডেন্ট বা মেরামতের প্রয়োজন পড়বে না।
গ্রেড সি- অল্প কিছু মেরামতের প্রয়োজন পড়তে পারে। যেমন- সিগারেটের পোড়া দাগ, খাবারের দাগ, স্ক্রুর কোনো গর্ত ইত্যাদি থাকতে পারে।
গ্রেড ডি- এই গ্রেডের গাড়িগুলো মোটামুটি খারাপ হয়। দাগ, পোড়া দাগ অথবা অন্য দাগ লক্ষ্য করা যায়।
গ্রেড ই- খুবই খারাপ অবস্থার গাড়ি ‘ই’ গ্রেডের হয়ে থাকে। ড্যাশ বোর্ড ভাঙা, সিটগুলো জীর্ণ এবং অনেক মেরামতের প্রয়োজন হতে পারে।
মাইলেজ গ্রেডিং
গ্রেড ৭, ৮, ৯ অথবা এস- গ্রেডের গাড়িগুলোর ডেলিভারি মাইলেজে খুব কম হয়ে থাকে। একদম নতুনের মতো গাড়িকে এই গ্রেড দেওয়া হয়। তেমন একটা ব্যবহারই হয় না এসব গাড়ি। বলতে পারেন একদম টপ ক্লাস গাড়ি। এ ধরনের গাড়ি বাংলাদেশর রাস্তায় খুব কম দেখা যায়।
গ্রেড ৬- নতুন গাড়ির জন্য এই গ্রেড দেওয়া হয় তবে ডেলিভারি মাইলেজ আরেকটু বেশি হয়। মাইলেজ সর্বোচ্চ ৩০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হয়। কোনো ধরনের দাগ থাকলে গ্রেড ৬ দেওয়া হয় না। অর্থাৎ খালি চোখে দেখে বোঝা যায় গাড়িটি পুরোনো না নতুন।
গ্রেড ৫- এমন গাড়ির মাইলেজ সর্বোচ্চ ৫০ হাজার কিলোমিটার হয়। দু-একটা আঁচড়ের দাগ থাকতে পারে।
গ্রেড ৪.৫- গাড়ির অবস্থা চমৎকার তবে মাইলেজ ১ লাখের ওপর হয়।
গ্রেড ৪- এই গ্রেডের গাড়িগুলোও খুবই নির্ভরযোগ্য ও ভালো হয়। দুই ধরনের গাড়িকে এই গ্রেড দেওয়া হয়ে থাকে। প্রথমত, কম মাইলেজের ভালো
গাড়ি, তবে যার কিছুটা সামান্য রিপেয়ার (ছোট-খাট স্ক্র্যাচ/ডেন্ট কারেকশন/পেইন্টিং টাইপের) দরকার। অথবা যার অল্প কিছু রিপেয়ার হয়েছে।
গাড়িটি দেড় লাখ কিলোমিটার চলেছে তবে মাইলেজ জনিত স্বভাবিক ক্ষয় ছাড়া আর তেমন কোনো সমস্যা নেই। পাশাপাশি ফিল্ড টেস্টে অভিজ্ঞ পরিদর্শকের চোখে পাশ করা। অনেক সময় দেখা যায় ডেন্ট পেইন্টের কাজ টপ ক্লাস মানের হয়নি তখন এই গ্রেডে চলে আসে।
গ্রেড ৩.৫- অনেকটা গ্রেড-৪ এর মতো গাড়ির মতো তবে রং আর প্যানেলে কিছু কাজ করার দরকার পড়তে পারে।
গ্রেড ৩- জরুরি ভিত্তিতে রং আর প্যানেলের কাজ করাতে হবে। অথবা প্যানেল জরুরিভিত্তিতে পাল্টাতে হবে। এই গ্রেডের মাইলেজ অনেক বেশি থাকে।
গ্রেড ২- খারাপ অবস্থার গাড়িগুলো ২ নম্বর গ্রেডে ফেলা হয়। এই গ্রেডে গাড়ির শোচনীয় অবস্থা বোঝায়। গর্ত, ক্ষয় ইত্যাদি গুরুতর সমস্যা নির্দেশ করে এই গ্রেড।
গ্রেড ১- দুই ধরনের গাড়িকে এই গ্রেড দেওয়া হয়ে থাকে। ইঞ্জিনের মডিফিকেশন বা অটো থেকে ম্যানুয়াল ট্রান্সমিশন পরিবর্তন করা।
গ্রেড ০, এ, আর, আরএ- এই গাড়িগুলো আগে মেরামতের ইতিহাস থাকে। গাড়ির ভেতরের প্যানেল ঠিক করার কথা উল্লেখ থাকবে। এই মেরামত কম হতে পারে আবার বেশিও হতে পারে।
নজর দিতে হয় মাইলেজে
রিকন্ডিশনড গাড়ি বা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনার বিষয়ে সর্বপ্রথম মাইলেজের ওপরে বেশি জোর দিতে হবে। রিকন্ডিশনড গাড়ি কেনার জন্য প্রথমে গাড়ির মাইলেজ চেক করতে হবে। দেশে বেশির ভাগ রিকন্ডিশনড গাড়ি যেহেতু জাপান থেকে আসে, তাই সেখানে গাড়িটি কত মাইল চলেছে তা যাচাই করতে হবে। গাড়ি কত মাইল চলেছে সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ অকশন পেপারে থাকে।
অকশন পেপারে লিখিত গাড়ির মাইলেজের ওপর ভিত্তি করে গাড়ির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। রিকন্ডিশনড গাড়ির মাইলেজের ওপর ভিত্তি করে দাম ওঠানামা করে। মাইলেজ কম হলে বা কম সময় রাস্তায় চললে দাম কিছুটা বেশি পড়ে। পাশাপাশি মাইলেজ যদি বেশি হয় বা বেশি সময় ধরে রাস্তায় চলে, তাহলে গাড়ির দাম কিছুটা কম হয়।
অকশন পেপার যাচাই
একজন ক্রেতা চাইলে অর্থ খরচ করে জাপানের আসল অকশন পেপার যাচাই করতে পারেন। এর মাধ্যমে জানা যায় গাড়িটি আসলেই অকশনে ছিল কি না। অকশন পেপার গাড়ির ডকুমেন্টের সঙ্গেই থাকে। আবার অনেক সময় ডকুমেন্টের সঙ্গে না থাকলে ইঞ্জিন চেসিস নম্বর নিয়ে ট্রু রিপোর্ট বের করতে পারবেন। ট্রু রিপোর্টে সব তথ্য পেয়ে যাবেন।
কলি