জোহরের নামাজের পরপরই সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.) দরগা প্রাঙ্গণে বেজে ওঠে ঐতিহ্যবাহী ‘নাকাড়া’। ‘শাহজালাল বাবা কি জয়’, ‘৩৬০ আউলিয়া কি জয়’, ‘লালে লাল শাহজালাল’, ‘নারায়ে তাককির-আল্লাহ হু আকবার’, স্লোগানে দরগা প্রাঙ্গণ প্রকম্পিত করে তোলেন হাজার হাজার শাহজালাল ভক্ত।
এরপর নাঙ্গা তলোয়ার ও কুড়াল হাতে দরগা প্রাঙ্গণ থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজারও শাহজালাল ভক্ত বর্ণাঢ্য মিছিল করে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে লাক্কাতুরা চা-বাগানের নির্দিষ্ট পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করতে রওয়ানা দেন। প্রায় ৭০৫ বছর ধরে আরবি শাওয়াল মাসের ২৬ এপ্রিল ঐতিহাসিক লাকড়ি তোড়া উৎসব পালন করা হয় সিলেটে।
গতকাল সোমবার জোহর নামাজের পর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভক্তরা এই উৎসবে অংশগ্রহণ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সিলেটে আসেন। প্রাচীন এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর স্মৃতি। এই দিন অত্যাচারী রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করে শ্রীহট্ট রাজ্য হজরত শাহজালাল (রহ.) বিজয় করেন। তাই এই দিনটি সিলেট বিজয় দিবস নামেও পালিত হয় ।
শিশুকাল থেকেই এই লাকড়ি তোড়া উৎসবে আসেন সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার শাহ সিদ্দিকুর রহমান চিশতি। এবারও তিনি এসেছেন। বলেন, ‘আমি শিশুকালে বাবার হাতধরে এই উৎসবে এসেছি। আজকের এই দিন ইসলামের বিজয়ের দিন। এই ইতিহাস আগামী প্রজন্মকে জানতে হবে। আমরা কেন লাকড়ি তোড়া উৎসবে আসি। মানুষের আভিজাত্যের অহংকার ভাঙতেই এই লাকড়ি তোড়া উৎসব শুরু করেছিলেন হজরত শাহজালাল (রহ.)।’
কথিত আছে, রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করার পর হজরত শাহজালাল (রহ.) প্রায় প্রতিবছর ‘বিজয় দিবস’ উদযাপন করতেন। এক বছর বিজয় দিবস উদযাপনের কিছুদিন আগে হজরতের কাছে এক নওমুসলিম কাঠুরে ফরিয়াদ নিয়ে এলেন। তার বিয়ের যোগ্য পাঁচ মেয়ে আছে। কিন্তু তিনি খুবই দরিদ্র ও নিচু জাতের মানুষ বলে মেয়েদের জন্য কোনো বিয়ের প্রস্তাব আসে না। হজরত কিছুদিন পর এর প্রতিকার করবেন বলে কাঠুরেকে আশ্বস্ত করলেন। সিলেট বিজয়ের দিন বরাবরের মতো সবাই সমবেত হলে সঙ্গীসহ হজরত শাহজালাল (রহ.) জোহরের নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে তিনি কুড়াল হাতে করে পাহাড়-টিলাবেষ্টিত (বর্তমান লাক্কাতুরা চা-বাগানের নির্ধারিত টিলা) উত্তর প্রান্তের গভীর জঙ্গলের দিকে যেতে থাকলেন। সঙ্গীরা তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। এক জায়গায় এসে তিনি নিজ হাতে লাকড়ি সংগ্রহ করতে লাগলেন। মুর্শিদের অনুসরণ করতে থাকলেন ভক্তরা।
এরপর লাকড়ি কাঁধে নিয়ে সঙ্গীসহ ফিরে আসেন নিজ আস্তানায়। লাকড়ি স্তূপ করে সমবেতদের নিয়ে আসরের নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে তিনি সঙ্গীদের কাছে জানতে চাইলেন, আজ আমরা কি কাজ করেছি? উপস্থিতরা বলেন, হজরত, আমরা আজ লাকড়ি ভেঙেছি। তিনি তখন বলেন, যারা লাকড়ি ভাঙে তারা যদি কাঠুরে হয় তবে আজ থেকে আমরাও কাঠুরে। এরপর তিনি সমবেতদের কাছে ইসলামের সাম্যের বাণী ও শ্রমের মর্যাদার কথা তুলে ধরেন এবং গরিব কাঠুরের ফরিয়াদের কথা জানান। তখন সমবেতদের মধ্য থেকে অনেকেই কাঠুরের কন্যাদের বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কাঠুরে এবার আগ্রহীদের মধ্য থেকে উপযুক্ত পাত্র বাছাই করেন।
এই বিজয় উৎসব পালনের ২১ দিন পর হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর ওফাত হয়। মুর্শিদের দেহান্তরের সংবাদে দূর-দূরান্ত থেকে মুরিদ ও ভক্তরা সমবেত হতে থাকেন। সমবেত মানুষের খাবার রান্নায় এই লাকড়ি ব্যবহার করা হয়। সেই স্মৃতির ধারাবাহিকতায় শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও আভিজাত্যের গৌরব ধ্বংস করার জন্য এই ‘লাকড়ি ভাঙার প্রথা’ পালন অব্যাহত থাকে।