আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার হবিগঞ্জে বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এরপরও মলিন জেলার কৃষকদের মুখ। পাইকার এবং ফড়িয়া সিন্ডিকেটের কারণে ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা।
প্রতি মণ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ ৮০০ টাকার বেশি। সেই হিসাব বিবেচনা করে সরকার এবার প্রতি মণ ধানের দাম ১ হাজার ২৮০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু পাইকার এবং ফড়িয়ারা সিন্ডিকেট করে প্রতি মণ ধান ৭৫০ থেকে ৯০০ টাকায় কিনছেন।
হাওরজুড়ে এখন মহা কর্মযজ্ঞ। ধান কাটা, মাড়াই করা, শুকানো, আর কেনাবেচাতে সরগরম মাঠের পর মাঠ। সোনারাঙা ধানগুলো কৃষকদের কাছে একেকটি স্বপ্ন। সারা বছরের খোরাকি রেখে যে ধান অবশিষ্ট থাকবে তা বিক্রি করে সন্তানদের লেখাপড়া, মেয়ের বিয়ে, বৃদ্ধ মা-বাবার চিকিৎসাসহ পরিবারের সারা বছরে আনুষঙ্গিক খরচ মিটবে। কিন্তু অর্থের প্রয়োজনে স্বপ্নের এই ধান ঘরে তোলার আগেই মাঠ থেকে কমমূল্যে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে।
কৃষকরা বলছেন, ধান কাটা ও মাড়াইসহ আনুষঙ্গিক খরচের জন্য অর্থের জোগান দিতে বাধ্য হয়েই পাইকারদের নির্ধারিত দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। হবিগঞ্জের বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, লাখাই এবং নবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা মাঠ থেকেই শ শ মণ ধান কিনছেন। স্থানভেদে ধানের দামেও রয়েছে পার্থক্য। কাঁচা ধান মণপ্রতি ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা এবং শুকনো ধান ৮৮০ থেকে ৯০০ টাকা দামে কেনাবেচা হচ্ছে।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা এলাকার কৃষক এমরান হোসেন বলেন, ‘এবার ধানের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন করতে খরচ বেশি হওয়ায়, বর্তমান দামে আমাদের পুষছে না। এখন ৭৭০ টাকায় প্রতি মণ কাঁচা ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। ৩২ শতক জমি করতে ১৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। ধান পাওয়া যায় ১৮ থেকে ২০ মণ। যদি ধানের দাম ১ হাজার টাকার বেশি হতো, তাহলে আমাদের কিছুটা লাভ হতো।’
একই উপজেলার কৃষক আলী আমজাদ বলেন, ‘সব জিনিসের দাম বাড়ছে। সারের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ধান কাটার শ্রমিকদের ১ হাজার টাকা করে দৈনিক মজুরি দেওয়া লাগে। কিন্তু ধান বিক্রির সময় দাম পাই না। ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় এক মণ ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। ধান করে আমরা এখন লোকসানে আছি, এভাবে যদি লোকসান হতে থাকে তাহলে আর বেশি দিন ধানের আবাদ করা যাবে না। সব জিনিসের দাম বাড়ে, ধানের দাম বাড়ে না।’
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক চাই থোয়াই প্রু মার্মা বলেন, ‘হাওরের প্রায় ৯৫ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। তবে এখনো সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু হয়নি। হবিগঞ্জে ৭ মে থেকে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে। জেলা থেকে ১৪ হাজার ৭৬০ টন ধান কেনা হবে।’
জেলায় এ বছর ১ লাখ ২৩ হাজার ৭৩৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। যেখানে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২০ হাজার ৬৫০ টন। যার বাজার মূল্য প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
পরিসংখ্যান বলছে, হবিগঞ্জে প্রতি বছর যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয় তার ১৮ থেকে ২০ শতাংশ কিনতে পারে সরকার। বাকি ৬০ শতাংশের বেশি ধান পাইকার বা ফড়িয়াদের কাছেই বিক্রি করতে হয়। কৃষকদের দাবি, সরকার যদি বৈশাখের শুরুতেই পাইকারি পর্যায়েও ধানের দাম নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন তারা। অন্যথায় প্রতি বছরের লোকসানের যে বৃত্ত তৈরি হয়, সেখান থেকে বের হওয়া যাবে না।
লাখাই উপজেলার কৃষক আবদুল মজিদ বলেন, ‘হাওরের বেশির ভাগ ধানই কাটা হয়ে গেছে। কিন্তু সরকার একটি দাম নির্ধারণ করে বসে আছে। এখনো ধান কেনা শুরু করেনি। কৃষকরা যখন কম দামে পাইকার বা ফড়িয়াদের কাছে ধান বিক্রি করে ফেলবেন, তখন সরকার ধান কিনবে। তাহলে সরকারের এই দামে কি কৃষক উপকৃত হবেন? এ ছাড়া কৃষক যদি সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে যায়, তাহলে তাদের নানা অজুহাত থাকে। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। এ ছাড়া বৈশাখের শুরুতেই ধান কেনার ব্যবস্থা করতে হবে।’
জেলা নাগরিক আন্দোলন কমিটির সভাপতি পীযূষ চক্রবর্তী বলেন, ‘কৃষক রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলায়। অথচ বিক্রির সময় তারা দাম পান না। ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দামে তাদেরকে ধান বিক্রি করতে হয়। কিন্তু বাজারে চালের দাম দেখা যায় দিন দিন বাড়ছেই। কারণ মধ্যস্বত্বভোগীরা নিজেদের ইচ্ছামতো কৃষকদের জিম্মি করে রেখেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কৃষকদের সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো, তারা সারা বছর যে ফসল ফলিয়েছেন তার দাম কত হবে তারা জানেন না। তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয় তৃতীয় পক্ষ। যদি কৃষকদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে সার্বিকভাবে দাম নির্ধারণ করা হতো তাহলে কৃষকের অন্তত লোকসান গুনতে হতো না।’