![হাওরের জলস্রোত](uploads/2023/12/01/1701416511.hawrer-jolosrut-date-01dec-.jpg)
রেজাউল নিজেকে শাসন করে নিশ্চুপ হয়ে যায়। হাওরের চারদিকে তাকিয়ে থাকলে দেখতে পায় কী সুন্দর এলাকা।
এখানে বাস করলে সুন্দর চিন্তা করা উচিত। শীতকালে যখন শত শত পাখি এসে হাওরে নামে, তখন হাওরের ছবি ভিন্ন মাত্রার হয়। হাওরের সৌন্দর্য এমনই। নানাভাবে হাওরবাসীকে সুখী রাখে। রেজাউল নিজের ভাবনার মাঝে ডুবে যায়। রেজাউলের দুই চোখজুড়ে পানি জমে। তারপর টুপটাপ পড়তে থাকে। একসময় হাওরের জলস্রোতের মতো পানি গড়ায় চোখ দিয়ে। ও হাত উঠিয়ে মোছে না। ভাবে, আমার দুই চোখ হাওরের জলস্রোত। হাওরে বাঁধ নির্মাণ হয়। কিন্তু চোখের পানির জন্য হাত বাঁধের কাজ করে। আজ ও হাত কাজে লাগায় না। ভাবে, পানি গড়ালে ওর ভালো লাগছে। সে জন্য দুই গাল বেয়ে নেমে আসা চোখের পানি ওর কাছে হাওরের জলস্রোত হয়ে যায়। ও পানিভরা দুই চোখে সামনে তাকিয়ে থাকে। প্রতিদিনের দেখা এলাকা আজ চোখের পানিতে দেখা ভিন্নরকম এলাকা হয়। ও চুপচাপ বসে থাকে। ওর মনে হাওরের চারদিকে তাকালে প্রতিদিন এক রকম দেখা হয় না। নানা রকমভাবে উল্টেপাল্টে যায় হাওর। পরক্ষণে নিজেকে বকা দিয়ে বলে, সব সময় এভাবে ভাবা উচিত না। হাওরের দিকে তাকালে কখনো অন্য রকম হয়ে যায়। এটা ওর নিজের ভাবনার জগৎ। এই ভাবনা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চিন্তায় রেজাউল পায়ের আঙুল দিয়ে হাওরের মাটি খুঁটতে থাকে। গানের সুরে বলে, বেঁচে থাকি মাটি নিয়ে, ভাত খাই মাটিতে। শুয়ে থাকি মাটিতে। হাওরের ভালোবাসায়। ওহ্, বাবা-মায়ের গ্রামের থাকার চেয়ে এখানে থাকতে বেশি ভালো লাগছে। বাবা আমাকে বকাবকি করে। কেন আমি এখানে থাকতে ভালোবাসি?
আমি বাবার পক্ষে সায় দিই। বলি, বাবা আমি আপনার হাওরের জমি দেখাশোনা করি। আপনি তো প্রচুর ধান পান।
- হ্যাঁ রে বাবা, পাই। তাহলে তুই থাক। কিন্তু তুই বাড়িতে না থাকলে আমার মন খারাপ থাকে। চারদিকে তোর জন্য তাকাই। দেখি না কোথাও।
- আচ্ছা, ঠিক আছে বাবা। আমি কিছুদিন গ্রামে থাকব। কিছুদিন হাওরে থাকব।
- হ্যাঁ, থাকবি। এখন থেকে আমি নিজেকে শাসন করব। তোকে কষ্টের কথা বলব না। তাহলে ধান পাওয়া কমে যাবে।
- কমবে না বাবা। আমি বেশি ধান পাওয়ার চেষ্টা করব নানাভাবে।
- ওরে আমার বাবা সোনা রে, তোকে কষ্ট করতে হবে না। কম ধান পেলে ক্ষতি নেই। আমি নিজেকে শাসন করব, যেন তুই হাওরে থাকতে পারিস। আমার ভুতুড়ে কথা তোকে আর শোনাব না।
রেজাউল হাসতে হাসতে বলে আমি ভুতুড়ে কথা শুনতে ভালোবাসি, বাবা। ছোটবেলায় অনেক ভ‚তের গল্প শুনেছি আপনার কাছ থেকে। সে সব গল্প এখনো আমার মনজুড়ে আছে। বিয়ের পর ছেলেমেয়েদের এসব গল্প শোনাব।
- মনে রাখতে পারবি?
পারব, বাবা। খুব ভালোভাবে পারব। মোস্তফা হাসতে হাসতে বলে, তুই একজন ধন্য বাবা হবি। ছেলেমেয়েদের হাসিখুশি রাখবি। রেজাউল বাবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। বাবা ওর মাথায় হাত রাখে। ও উঠে দাঁড়ায় না। বাবার দুই পা জড়িয়ে ধরে হাঁটুর ওপর মাথা ঠেকায়। বাবা ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে জড়িয়ে ধরে। বলে, তুই আমার সোনার ছেলে। আমার বুকে থাকবি। পায়ে থাকবি না।
রেজাউল বাবার ঘাড় ধরে লাফালাফি করে। আমার সোনার বাবা, সোনার মা। গানের মতো সুর টেনে বলতে থাকে। ওর বাবা কান পেতে শোনে। সোনার ছেলের কণ্ঠস্বরে মধু আছে, বাবার বুক ভরিয়ে দিচ্ছে। একসময় রেজাউল থেমে যায়। বলে, আমি ঠিক করেছি হাওরে একটা বাড়ি বানাব।
- কেন এখানে বাড়ি বানাবি? গ্রামে আমাদের বাড়ি আছে না?
- আছে তো আব্বা। তবে আমি বিয়ে করে এখানে একটা বাড়ি বানাব। আমি এখানে থাকব।
- এখানে কেন থাকবি? হাওরে তোর এত নেশা কেন?
- আব্বা, আমার এখানে থাকতে বেশি ভালোলাগে। চারদিকে তাকালে মন ভরে যায়। শীতকালে বিদেশি পাখিগুলো এলে আমার মনে হয় আমাদের হাওর বিদেশ হয়েছে।
- তুই তো পাগল হয়ে যাবি দেখছি।
- আব্বা, আপনি রাগ করবেন না।
- তুই এখানে থাকলে আমি রাগ করব।
আচ্ছা, তাহলে আমি এখানে থাকব না। আমি তো আপনার সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে থাকব। আপনি রাগ করবেন না, আব্বা মোস্তফা ছেলের কথার উত্তর দেয় না। চারদিকে চোখ ঘোরায়। টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য দেখে মন ভরে যায়। ছেলের ইচ্ছা নিজের বুকের ভেতর গুমগুম করে। বুঝতে পারে ছেলের ইচ্ছার সঙ্গে নিজের ইচ্ছা মিশে গেছে, কিন্তু এখানে এসে বাস করা হবে না। ওকে বাধা দিতে হবে। পরক্ষণে নিজেকে ধমকায়- কেন এখানে বাস করা হবে না? এক শ বার হবে। ছেলে ঘর তুলুক, আমি এসে থাকব। মোস্তফা নিজেকে ছেলের বুকে মাথা ঠেকে রাখে। ছেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, বাবা, বাবা আপনি আমার প্রাণের মানুষ। তারপর গুনগুন করে গাইতে থাকে, বাবা, আমার বাবা।
- ওরে আমার সোনার ছেলে। তোর গান শুনে আমি ধন্য। তোর সঙ্গে আমিও এখানে ঘর তুলব। তুই বউ নিয়ে থাকবি। আমি মাঝেমধ্যে তোর মাকে নিয়ে এসে এক দিন থেকে যাব।
- এক দিন না আব্বা, সাত দিন থাকবেন।
মোস্তফা হা-হা করে হাসে। হাসতে হাসতে বলে, তুই আমার হাওর ছেলে।
- আব্বা, আপনি ঠিক বলেছেন। আমি আপনাকে ভালোবাসার মতো হাওরকে ভালোবাসি।
মোস্তফা ছেলের কথা শুনে হাসতে হাসতে তালি বাজায়। রেজাউল বাবার ঘাড়ে মাথা রেখে বলে, বাবা আমার টাঙ্গুয়ার হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওর আমার বাবা।
- না, তোর বাবা বলবি না। তুই এখানের কোনো মেয়েকে ভালোবাসবি না?
- হ্যাঁ, বাসব। তারপর বিয়ে করে ঘর করব।
- তাহলে হাওর বাবা হবে কেন? বলবি হাওর ভালোবাসার মাটি আর পানি।