![শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার](uploads/2024/01/12/1705038250.uponash.jpg)
বড় দিঘির মোড়ে এসে দাঁড়ান কবি হাসান আলী। এখানে বোয়ালভাসা নদী নিপুণ বাঁক নিয়ে দিঘিতে এসে মিশেছে। যখন চৈত্র মাসে দিঘির পানি কমে আসে, তখন নদীর স্রোতের টানে মাছের জো লাগে। দূরদূরান্ত থেকে শৌখিন জেলেরা মাছ ধরতে আসে। কিন্তু এই রাতে কী হয়েছে কে জানে। উদ্বিগ্ন চোখে ভিড়ের দিকে এগিয়ে যান কবি হাসান আলী।
কবি দেখেন নদীতে পাওয়া এক বাঘা আইড় মাছ কেটে ভাগা বসানো হয়েছে। প্রতি ভাগার দাম রাখা হয়েছে এক হাজার টাকা মাত্র। কবিকে দেখে জেলে বললেন, এক ভাগা নিয়ে যান, এই মাছ সহজে পাওয়া যায় না।
পকেটে দুটি মাত্র টাকা আছে জেনেও অজানিতে পাঞ্জাবির পকেটে হাতড়ান কবি হাসান আলী। তারপর নিজেকেই বুঝি-বা নিজে সান্ত্বনা দেন- অত বড় দেও মাছ দেখতে ঘেন্না আসে, খাওয়া তো পরের কথা।
সামনে এগিয়ে গেলে রাজা মিয়ার চায়ের দোকান। ওখানে কবি কখনো পত্রিকা পড়ার জন্য বসেন। কিন্তু চা-না-খাওয়া কাস্টমারের পত্রিকা পাঠ ভালো ঠেকে না রাজা মিয়ার। এলাকার মানুষ বলে যদিও মুখের ওপর কিছুই বলে না, হাসান আলী তার অসহিষ্ণু চোখের কম্পন ঠিকই টের পান। কিন্তু যার চা খাওয়ার গাঁট নেই, তার পত্রিকা পাঠের খায়েশ কেন হয় তিনি নিজেই বুঝে উঠতে পারেন না।
এরকম অঙ্ক না মেলা হাজারো প্রশ্ন মাথায় তিনি নীল-আকাশের নিচে বোয়ালভাসা নদী ডাইনে রেখে আকন্দ-বাসক-লতায় ভারী গ্রাম্য পথ বেয়ে বাড়ির রাস্তায় এসে পৌঁছান। বাড়ির মোড়ের পদ্মপুকুর, তার ওপর ভাসা নীলাভ রঙের ফুলগুলো শীত-গ্রীষ্ম সারাক্ষণ চেয়ে থাকে, কিছুই বলে না। কবি জানেন, এই পুকুর, পুকুরের নীরব জল, জলের ওপর ভাসা নীলপদ্ম অনন্ত নক্ষত্রের নিচে হেঁটে যাওয়া একাকী এ মানুষটির সুখদুঃখের নিত্যসঙ্গী। কখনো পথচলতি দুপাশের অজানা বনফুলের তিক্ত মধুর গন্ধ তাকে দুঃখ ভুলানোর ব্যাকুল প্রয়াসে তার চারপাশ ঘিরে বয়ে যায়। তিনি কবি। প্রকৃতির এই আনন্দ-বেদনার সঙ্গে তার নীরব সংলাপ চলে প্রতিদিন, কথা বলে না কেউ। তিনি ভাবেন, যদি তারা কথা বলতে পারত, তাদের আহাজারিতে জগতের সব আনন্দ-উচ্ছ্বাস মরাবাড়ি, মরাঘরের মতো এতদিনে নিস্তব্ধ হয়ে যেত।
এদিকে বাবার আসতে দেরি হওয়ায় মেয়ে আবার রোয়াকে এসে বসেছে। শজনে গাছের চিরল পাতার ফাঁক দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো এসে খেলছে তার অলক চিকুরে। তার সৌন্দর্যের কথা জানে এ উঠোনে উপস্থিত প্রতিটি প্রাণী, জানে আদর্শ-কলেজের চেংড়া শিক্ষকরা আর জানে, বলা ভালো, জানত একজন- আমেনা বিবি- রুকুর মা। কিন্তু বাপ-বেটি দুজনই এ স্বর্গীয় সৌন্দর্যে নির্বিকার।
তারা জানে না, যখন বসন্তের আগমনে আদর্শ কলেজের ছায়াঢাকা পথে জারুলের পাতাগুলো হাওয়ায় উড়তে থাকে, তখন সেই পাতাঝরা পথে বাড়ি ফেরা রুকুর স্বর্গছেঁড়া গায়ে বিকেলি সূর্যের নরম আলো বৈদূর্যমণির মতো ঝরতে থাকে।
স্বর্গের সেই রূপ নিয়ে রুকু অবশ্য কলেজে কী গ্রামে কারও সঙ্গে কথা বলে না, বলতে পারে না। গরিবের মেয়ে সে। নিজের রূপ নিয়ে বেখেয়াল হলেও বাবার গরিবি তাকে সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত করে রাখে। তবে বাড়ির ছায়া সুনিবিড় উঠোনে যখন বিকেলের আলো ম্লান হয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, যখন ডানার রোদের গন্ধ মুছে ফেলে চিল নেমে আসে শজনের চিরল পাতায়, ডানাভাঙা কাকটি নড়েচড়ে ওঠে জগডুমুরের ডালে, তখন তার সারা দিনের না-বলা কথা একসঙ্গে বেরিয়ে আসে।
সে ভাবে, এসব তার একান্ত আপন। এই ডানাভাঙা কাক, এই উঠোনের ফুলপাখি, পুকুর থেকে ভেসে আসা সোঁদা গন্ধ, জলের গভীরে শোল মাছের ঘাই- এসব নিয়েই তার জীবন, জীবনে বেঁচে থাকা। তাই দিনমান মানুষের সামনে নির্বাক তার কলকণ্ঠ বোবা প্রকৃতির সাগরে তরঙ্গিয়া ওঠে সোনার সন্ধ্যাবেলা।
আজ সন্ধ্যার প্রথম সংলাপটি ছাড়ল সে ডানাভাঙা কাকের উদ্দেশে- আজকে তোমার ভাগ্য খারাপ। তোমাকে দেওয়ার মতো কোনো চাল নেই। বিলিম্বি ধোয়া জলে ভিজিয়ে রেখেছি সব চাল। বাবা এলে খিচুড়ি হবে। আমার বহুদিনের চর্চা করা রেসিপি দিয়ে। আমার সেরা রাঁধুনি হওয়ার প্রথম পরীক্ষা আজ।
নিজের মনে বকতে বকতে হঠাৎ রুকুর খেয়াল হয়, কাকটি এবং কাকের সঙ্গে উঠোনের গাছ-পাখি সবাই, এমনকি তার পায়ের কাছে এসে বসা নোরা নামের বিড়ালটি পর্যন্ত কান পেতে তার কথা শুনে যাচ্ছে। বন্ধ হয়ে গেছে শজনের চিরল পাতার শিহরণ, জলে ভাসা শোল মাছের ঘাই। এক অজানিত বিস্ময়ে বোবা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে আসে।
কতক্ষণ থম মেরে বসে ছিল রুকু জানে না। যেন-বা বহুদিন পরে, বহুদূর থেকে তার বাবার ‘মা রুকু’ বলা ডাক তাকে ঘুমের গহিন থেকে জাগিয়ে তোলে। ধুকপুক বুকে উঠে এসে বাবাকে এগিয়ে নেয়।
-আর বলিস নে। সবাই শুধু আমার দিকে তাকিয়ে, তোর হারাধন কাকু আর হালিম চাচার নিত্যদিন নিত্যনতুন কবিতা চাই। আচ্ছা সবাই কি তাদের বলা শায়েরগুলো, টিয়ার ঠোঁটে তোলা খামবন্দি কবিতাগুলো মুখস্থ করে রাখে? আর প্রতিদিন নতুন কবিতা কি মাথায় আসে? তুই বল।
মেয়ে কী বলবে ভেবে পায় না। নিরালা প্রকৃতি তার গাছপালা, ফুলপাখি নিয়ে বাপ-মেয়ের দিকে নীরব তাকিয়ে থাকে। বাড়ির রাস্তা ধরে ঘরে ঢুকবার পথে একটি বকুল ফুল ঝরে পড়ে। পুকুর থেকে শোল মাছের ঘাই ভেসে আসে। কবিতার এই পাঠশালায় ক্লান্ত কবির মনে শায়েরির আবেদন জাগে। মনে জাগে গোধূলিবেলার রাগ তিলককামোদ। মেয়েকে কিছুই বলেন না, কিন্তু মন কথা কয় অজানিতে- পিয়া তোসে নয়না লাগে রে
নয়না লাগে রে...।
আর কিছু নেই, জগৎজুড়ে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। শুধু ওপর আকাশে হাসি হাসি কামিনী চাঁদ। শুধু নিচে এক বিভোল কন্যার কাঁধে হাত রেখে কোজাগরি পূর্ণিমা রাতে এক নিশি পাওয়া পিতার গমকে গমকে হেঁটে যাওয়া-
চলবে...