জীবনানন্দ দাশের ১২৫তম জন্মদিন উপলক্ষে এই লেখা যখন পাঠক পড়ছেন, ততদিনে তার মৃত্যুর পর ৭০ বছর অতিক্রম করেছে। সাধারণ বা অসামান্য যেকোনো মানুষের মৃত্যু হলে বেশির ভাগ সময়েই যা ঘটে, তার সব রকম যাপন, প্রভাব ও কর্মপ্রবাহ থেমে যায়। মৃদু বা বিপুল পরিচিতি ও প্রতিপত্তি আলগা হয়ে পড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি লুপ্ত, এমনকি বিস্মৃত হয়ে যান। চরিত্রবৈশিষ্ট্য আর কর্মজীবন বা সৃজনশীল কাজের সৌরভ নিয়ে কেউ কেউ নতুন করে বেঁচেও ওঠেন। জীবনানন্দ দাশ সেই ব্যতিক্রমদের অন্যতম। কেননা বাংলা ভাষাভাষী কবিতা-অনুরাগী, নির্মম সমালোচক আর সময়ের তীব্র ঘা সয়ে আজও তিনি তার কবিতামাধুরী, গল্পসম্ভার ও উপন্যাসের ভুবন নিয়ে ভীষণ প্রাসঙ্গিক ও জীবন্ত হয়ে আছেন। বাংলা ভাষার একজন কবির ক্ষেত্রে এটা এক বিস্ময়কর অভিযাত্রা ও সিদ্ধি।
ছাপ্পান্ন বছরের জীবন পেয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। একজন মৌলিক শিল্পীর জন্য এই আয়ুরেখা সামান্যই। কিন্তু এই সময়পর্বেই তিনি অসামান্য সব কাজ করে গেছেন। লিখেছেন অনেক, অসংখ্যও বলা যায়। তবে প্রকাশ করেছেন সামান্যই। প্রতিদিনের জীবনযাপনে যেমন, বরং প্রধানত শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আশ্চর্য রকমের খুঁতখুঁতে ও উৎকর্ষের চূড়া স্পর্শ করার প্রচেষ্টায় মগ্ন এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী। সে কারণে প্রচুর লিখছেন, ফেলে রাখছেন, কখনো ট্রাংকে তুলে রাখছেন, হয়তো নিরন্তর কাটাছেঁড়া করছেন; কিন্তু পত্রিকায় বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বই আকারে প্রকাশের আনন্দ-ভাবনা সংগোপনে ত্যাগও করছেন।
তরুণ কবিদের লিটল ম্যাগাজিন এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্রিকা থেকে যখন তাকে লেখার জন্য আমন্ত্রণ বা অনুরোধ জানানো হয়, তিনি অবলীলায় বলছেন, হাতে নতুন লেখা নেই। লিখতে পারলেই পাঠিয়ে দেব। এমনকি, কখনো এমনও ঘটেছে যে, পত্রিকার দপ্তরে লেখা পাঠিয়েও তিনি কবিতা ফিরিয়ে নিয়েছেন। পাঠানো লেখা যেন ছাপা না হয়, সেসব নিয়ে তিনি বিচলিত হয়েছেন। কখনো আড়াল ভেঙে সম্পাদককে চিঠি লিখছেন: অমুক কবিতাটি এখন ছাপবেন না। কিছু শব্দ ও বাক্য নিয়ে আমি ভাবছি। কয়েকটি জায়গায় পরিবর্তন করতে হবে। চিঠির সঙ্গে ফেরত খামসহ লিখছি, ফেরত পাঠাবেন।
কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ রূপটিই জীবনানন্দ দিতে চাইতেন। কারণ তিনি নিজেই লিখেছেন: সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। কবিতার জন্যই জীবনের সব রকম সাফল্য ও সুবিধা অনায়াসে তুচ্ছ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবেও কবিতায় নিরন্তর সেই আরশিনগর তিনি স্পর্শ করতে চেয়েছেন, যা তাকে সবার থেকে আলাদা ও অনন্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
জীবনানন্দ দাশ সারা জীবনে নানা ধরনের কবিতা লিখেছেন। প্রেমের কবিতা লিখে তিনি আশ্চর্য সিদ্ধি লাভ করেছেন, দেশভাগ ও নিছক দিনযাপনের কথাও লিখেছেন। তার কতগুলো কবিতা তো আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অনুভূতির প্রধান ভরকেন্দ্র হিসেবে চিরকালীন হয়ে গেছে। ‘বনলতা সেন’, ‘আকাশলীনা’, ‘দুজনে’, ‘কুড়ি বছর পরে’, ‘আট বছর আগের একদিন’... ইত্যাদি কবিতার কথা তো বলাই যায়।
আবার তিনি প্রকৃতির কবি হিসেবেও অসামান্য এবং অতুলনীয় মাধুরী ও জগৎ নির্মাণ করেছেন। সে কারণে তার নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে কবিতাপ্রেমী পাঠক ও সমালোচক বলতে আনন্দ লাভ করেন যে, প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ।
এর নেপথ্যে অবশ্য যৌক্তিক কারণও আছে। ‘রূপসী বাংলা’ নামে তিনি যে কবিতার বইটি লিখেছেন, যার আদি নাম ছিল ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’, এই একটি মাত্র কবিতাগ্রন্থ দিয়েই তার শিল্পপ্রচেষ্টার গভীর ও বিস্ময়কর সাফল্যের ছাপ তিনি এখানে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। সমালোচকদের তাই বিবেচনা করতে সহজ হয় যে, জীবনানন্দ দাশ আসলে প্রকৃতির কবি।
প্রকৃতপক্ষে এত বিচিত্র বিষয়, ভাবনা ও অনুভূতি নিয়ে তিনি কবিতা, গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন, নানাভাবে তাকে চিহ্নিত করা সম্ভব। যুক্তি ও প্রমাণের স্বপক্ষে তারই কবিতা, গল্প ও উপন্যাস থেকে অজস্র উদ্ধৃতিও দেওয়া যায়। কিন্তু এসব পাশ কাটিয়ে আমার মনে হয়, জীবনানন্দ দাশ এক আশ্চর্য অনুবাদক। সেটা কীভাবে?
প্রচলিত অর্থে যেভাবে ‘অনুবাদক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তিনি সেই অনুবাদক নন। তাহলে?
জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা থেকে পাঠ করি-
‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় কবি লিখছেন:
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
এই কবিতায় তিনি যে ভাব, ভাষ্য ও সময়ের অনুবাদ উপস্থান করেছেন, পড়তে পড়তে মনে হয়, তিনি গতকালই যেন কবিতাটি লিখে গেছেন আর আজ সকালে পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে। আমরা কবিতাটি পড়ছি। আবার পড়ছি। আরও একবার।
মানুষ, সময় ও সমাজের কী অদ্ভুত ও বিস্ময়কর অনুবাদ করেছেন জীবনানন্দ দাশ, পড়তে পড়তে চোয়াল ঝুলে পড়ে। ভাবনার করোটি থেমে আসে। ভাবনাকুঞ্জ স্তম্ভিত হয়ে যায়। মানুষ ও সময়ের এমন আশ্চর্য সত্য ও বিস্ময়ের অনুবাদ এভাবেও করা যায়?
জীবন ও জগতের রহস্যময় প্রকাশ খুব গাঢ়ভাবে ধারণ করেছেন তিনি, জীবনানন্দ দাশ। তিনি তো সেই মানুষ, যিনি মাটিকে সোনা ফলাতে পারেন বলে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন শিক্ষসচিব হুমায়ুন কবীরকে চিঠিতে লিখেছিলেন। এ ছাড়া ভাবতে অসুবিধা হয় না, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে এমন করে লেখা সম্ভব নয়। সেই আশ্চর্য মানুষটির নাম জীবনানন্দ দাশ, যার বরিশালে বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও কখনো ইলিশের সৌন্দর্য ও স্বাদ নিয়ে কবিতা লেখেননি, লিখেছেন সময়ের এমন ভাষ্য, যা ভাবিকালের মানুষ ও সমাজের অন্তরের কথা হয়ে উঠতে পারে। তার বহু কবিতায় এই সত্য উন্মোচিত হতে দেখি।
সময়ের এক আশ্চর্য অনুবাদক হিসেবে নিজেকে তিনি কতভাবে, কী রকমভাবে গড়েছেন, তা আমরা বলতে পারি না। তবে কিছু কবিতা ও ডায়রির পাতায় সেসবের খানিকটা আভাস তিনি রেখে গেছেন। যেমন ‘আমার অতটা তাড়া নেই’ শিরোনামের কবিতায় তিনি লিখছেন-
আমি অত তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না:
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
সময় ও সমাজের সফল অনুবাদক তো তিনি ছিলেনই, এ ছাড়া মানুষের মনের ভাষা ও দীর্ঘশ্বাসেরও সংবেদী অনুবাদক তিনি, কবি জীবনানন্দ দাশ।
জন্মদিনে এই মহান কবিকে হৃদয়ের গভীর প্রদেশ থেকে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও প্রণতি জানাই।
শুভ জন্মদিন কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক জীবনানন্দ দাশ।