আগের চাইতে এখন অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে ফাতেমার। আগের মতো আর অন্ধকারাচ্ছন্ন বস্তিতে থাকতে হচ্ছে না। এখন দুই রুমের আধাপাকা টিনশেডের ঘর, নিচটা সিমেন্টের। ঘরলাগোয়া একটা টিনের ঘের দেওয়া জায়গা আছে গোসলটোসল করার জন্য। কিছুটা দূরে বারোয়ারি একটা জলের কল আর পায়খানা আছে। আশপাশের পনেরো-বিশটা ঘরের মানুষের জন্য চলে যায়। তেমন অসুবিধা হয় না। তাছাড়া সামনের গলির মাথায়ও একটা জলের কল আছে, সেখানেও যায় অনেকে।
আগে যেখানে থাকত ফাতেমা, সেটা ছিল ছোটলোকদের বস্তি। নানা কিসিমের চোর-ছ্যাচ্চোর, নেশাখোর আর হারামিদের আস্তানা। ফাতেমা তাদের ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ ভয়ে তটস্থ থাকত। স্বামী শহীদকেও দু-একবার বলেছে সে তার ভয়ের কথা। কিন্তু অটোচালক শহীদ সারা দিন আর বেশ রাত পর্যন্ত অটো চালানোর ধকল শেষ করে ফাতেমার কথার অত গুরুত্ব দিতে পারত না। দু-একদিন কিছু ঝগড়াঝাটি করে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছিল ফাতেমাও। ক্লান্ত স্বামীকে আর বিরক্ত করতে চায়নি।
কিন্তু হঠাৎ একদিন শহীদ রাতে ফিরে নিজেই বস্তির এই ঘর ছেড়ে অন্য এক জায়গায় যাওয়ার কথা বলে। আর চার-পাঁচ দিন পরেই ভাসানটেকের এই আধাবস্তির একেবারে শেষ দিকের একটা ঘরে এসে ওঠে।
এখানে আসার পরে একদিন রাতে ফাতেমাকে কাছে টেনে নিয়ে শহীদ বলে, অহন ঠিক আছে তো। অহন কি আর ভয় লাগে? দু’বার প্রশ্ন করার পর ফাতেমা মৃদুস্বরে উত্তর দেয়: না।
এ ব্যবস্থায় ফাতেমা যে খুশি হয়েছে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারে শহীদ। ফাতেমাও খুশিমনে এখানকার পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকে। ইতোমধ্যে মাসখানেক যেতে না যেতেই পাশের ঘরের রোকেয়ার সঙ্গেও আলাপ পরিচয় করে ফেলেছে। রোকেয়ার বছর পাঁচেকের ছেলে জামাল, সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে। ফাতেমা তাকেও বেশ বশ করে ফেলেছে। এখন সে প্রায় সময়ই ঘুরঘুর করে ফাতেমার চারপাশে। সারা দিন শহীদকে কাছে পায় না ফাতেমা। পায় শুধু রাতে। কিন্তু তখনো খুব বেশি কথা হয় না, শহীদ এত ক্লান্ত থাকে যে শুয়েই প্রায় রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে দু-একদিন যদিও শহীদ তার শরীরের চাহিদা মেটাতে কাছে টেনে নেয়। কিন্তু ফাতেমার প্রস্তুতির আগেই যেন দ্রুত কাজ শেষ করে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। এতে ফাতেমা আনন্দের চাইতে কষ্ট পায় বেশি। কিছুদিন থেকে ফাতেমা লক্ষ্য করছে শহীদের মধ্যে কিছুটা যেন পরিবর্তন এসেছে। মেজাজটাও একটু চড়েছে। ধীরস্থির ভাবটাও অনেকটা কমে গেছে।
গতরাতে বিছানায় শুতে এসেই শহীদের মুখ থেকে মদের নাকি অন্য কিছুর একটা ঝাঁঝালো গন্ধ পেয়ে চমকে ওঠে ফাতেমা। পরে মুখ ফিরিয়ে বলে, তুমি আইজ কী খাইয়া আইছো, কও দেহি-
ফাতেমার কথাটা যেন শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে অনেকটা জোর করেই ফাতেমার শরীরটাকে কাছে টেনে নিতে চায় শহীদ। দুই হাতে জোর খাটায়।
উঁহু, আগে কও, কী খাইছ- ফাতেমা শহীদের হাতটাকে তার বুকের ওপর থেকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। শহীদ একটু থমকায়। তারপর কিছুটা রাগের সঙ্গেই বলে ওঠে, এসব ফাও কথা কওয়ার আর সময় পাও না!
না, আগে কও- ফাতেমার কণ্ঠেও কিছুটা জেদের আভাস ফোটে। এরকম তো আগে ছিল না-
এই তো গ্যাঞ্জাম কর- শহীদ এবার রীতিমতো রেগে যায়, মাইয়ামানুষ চুপচাপ থাকবা। বেশি জানোনের দরকার নাই-
ফাতোমা অবাক হয়। কিছুটা লেখাপড়া জানা ফাতেমা ভালোমন্দটা মোটামুটি বুঝতে পারে। কেন যেন তার মনে হতে থাকে শহীদ খারাপ লাইনে ঢুকেছে, খারাপ মানুষের সঙ্গে মিশে নেশা ধরেছে। তাছাড়া কিছুদিন ধরে সে দেখছে শহীদের হাতে বেশ টাকা আসছে যেন কোথা থেকে। আগে এমন ছিল না। ফাতেমা কষ্ট বুঝতে পারে, এসব টাকাই ওর মাথাটা গরম করে তুলছে। ফাতেমা অস্ফুটস্বরে বলতে থাকে- বুঝতে পারছি, হঠাৎ অ্যাতো ক্ষ্যাপছ ক্যান-
মানে, কী কইতে চাও তুমি, শহীদের ভ্রু কুঁচকে তাকানোটা ফাতেমা অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারে না।
কওয়ার আর কী আছে, সত্য কতা কইলেই তো দোষ-
সত্য কতাটা কী? শহীদ পাশ ফিরে সরাসরি তাকায় ফাতেমার দিকে। একটু থামে, তারপর বলে, হোন, একটা কতা কই, বেশি চালাকি আমার সহ্য অয় না।...
সোজা কতা, মাইয়া মানুষ মাইয়া মানুষের মতো থাকবা, বেশি বাড়বা না- তাইলে খবর আছে- রাগে অন্য পাশে ফেরে শহীদ। একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ে।
স্বভাবতই একটু রগচটা শহীদ, এটা জানে ফাতেমা। কিন্তু আজকের রাতের ব্যবহারটা এবং কথা বলার ধরন দেখে রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে ওঠে। পারতপক্ষে ওর সঙ্গে এমন ব্যবহারের কোনো কারণই খুঁজে পায় না ফাতেমা। যদিও মনের মধ্যে একটা দুর্বলতা বাসা বেঁধেই আছে। বিয়ের পর প্রায় পাঁচ বছর হয়ে এল, এখনো কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি ফাতেমার। চেষ্টার ক্রুটি নেই, তারপরও হয়নি। কেন হয়নি সেটা বোঝার ক্ষমতা ফাতেমার নেই, বলতে পারে কোনো ডাক্তার। কিন্তু তার কাছে কখনো যাওয়া হয়নি। সবাই ধরে নিয়েছে ফাতেমার কোনো শারীরিক সমস্যার কারণেই এটা ঘটেছে। এ ব্যাপারটা নিয়ে শহীদ যে খুব কিছু বলেছে, তেমনটা না হলেও ফাতেমার মনের মধ্যে যখন তখন কাঁটার মতো খচ খচ করে বিধতে থাকে এই অক্ষমতার বিষয়টা।
সময়টা আসলে ভালো যাচ্ছে না ফাতেমার। এসব ঝামেলার মধ্যে আরেকটা উৎপাত জুটেছে। এই ঘরের মালিকের কে এক আত্মীয় মনির মিয়া এখানে সাত-আটটা ঘরের ভাড়া নিতে আসে। একদিন দেখেই ফাতেমার দিকে সে অন্য রকমভাবে তাকাতে শুরু করেছে। একদিন এসে সে জেনে গেছে সপ্তাহের শুধু শুক্রবার ছাড়া শহীদ অন্য দিনগুলোতে দিনের বেলা ঘরে থাকে না। সেজন্য তাকে শুক্রবার আসতে বলেছিল ফাতেমা। কিন্তু সে অহেতুকভাবে এলো বুধবার। তারপর ভাবী ডেকে নানা ধানাইপানাই গল্পজুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ফাতেমা অন্য কাজের কথা বলে তাকে কিছুক্ষণ পরেই বিদায় করে দেয়। তবে ফাতেমা বুঝতে পারে এবারেই শেষ হলো না। আবার আসবে এই উৎপাত। গায়ের রংটা একটু চাপা হলেও আটসাঁট বাঁধনে টানটান লম্বাটে শরীর ফাতেমার। চোখেও একটু টানা ভাব আছে। একটু ভালো করে দেখলেই ঘোর লাগে। বাচ্চাটাচ্চা না হওয়ার জন্য এতদিনেও বুক আর শরীরের ভাঁজ ঢিলে হয়নি কোথাও।
এই শরীরটাই এখন তার শত্রু হয়ে উঠেছে। ফাতেমা ভেবেছিল রাতে মনির মিয়ার কথাটা বলবে শহীদকে। কিন্তু তা আর হলো না। শুরু করার আগেই ঝামেলা বেঁধে গেল। এরপর আর সহজে ঘুম এল না ফাতেমার। শুয়ে শুয়ে ঘরের পেছনে বেশ কিছুটা দূরের ঝিলের পাড়ের ব্যাঙের ডাক শুনতে লাগল। সন্ধ্যার পরে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। সেই বৃষ্টিতে চারদিক থেকে মজে যাওয়া ঝিলটার পাড়ের ঝোপঝাড় আর ছোট ছোট গাছপালার ভেতরে ব্যাঙ আর নানারকম পোকামাকড়ের বসতি গড়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে হচ্ছে মশার বংশবিস্তার। আশপাশে এখনো কিছু খোলা জমি পড়ে আছে, তাতে আবর্জনার স্তূপ। পুব আর দক্ষিণ দিকে বেশ কতগুলো বড় বড় বিল্ডিং উঠেছে। এদিকটা তার পেছনে বলে ও দিকের মানুষের এটা চোখে পড়ে না। ঝিলটা এখন একটা বড় নালার অবয়ব নিয়ে এঁকেবেঁকে কিছু দূর দিয়ে ফাতেমাদের সামনের রাস্তাটা ঘেঁষে পশ্চিম দিকে চলে গেছে। রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে তারপর আর কিছু দেখা যায় না। বাঁকের পরেই বিশাল বিল্ডিং উঠছে একটা। দিনরাত কাজ চলছে সেখানে। নানা রকম শব্দ পাওয়া যায় সর্বক্ষণ। পাঁচতলা পর্যন্ত ওঠা বিল্ডিংটার ইটকাঠের ফাঁকে ফাঁকে সারা দিন মানুষের চলমান চেহারা দেখা যায় দূর থেকে। সন্ধ্যার দিকে কাজ বন্ধ হলেই সব অন্ধকারে ডুবে থাকে।
এর মধ্যে মাত্র দুই দিন গেছে, তিন দিনের দিন শেষ বিকেলের আলো ফুরাতেই মনির এসে হাজির। এই ভয়টাই করছিল ফাতেমা। তার শরীরের নেশায় পেয়েছে মনিরকে, এটা বুঝতে আর সময় লাগেনি ফাতেমার। ভাবী ভাবী ডাকতে ডাকতে সে আজও একেবারে ঘরের ভেতরে ঢোকার মুখেই পাশের বাসার রোকেয়া ভাবীর কাছে জরুরি কাজ আছে বলে একরকম জোর করেই পালিয়ে বাঁচে ফাতেমা। কিন্তু সে বুঝতে পারে কাল পরশু আবার আসবে মনির। বুকের ভেতরের ভয়টা যেন বিপর্যস্ত করে দেয় ফাতেমাকে।
বেশ রাত করে ফেরে আজকাল শহীদ। এত কী কাজ কে জানে! আগে এত রাত হতো না। মেজাজও বেশ ঠান্ডা থাকত, এখন প্রায় সময়ই মেজাজ গরম থাকে, আর চুপচাপ কী যেন ভাবনাচিন্তায় ডুবে থাকে। ডাকলেও তেমনভাবে সাড়া পাওয়া যায় না। তবু আজ রাতে শোয়ার আগেই ফাতেমা শহীদের কাছে মনিরের ব্যাপারটা বলে ফেলল। চুপচাপ সবটা শুনে শহীদ কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল। তারপর তাকাল ফাতেমার দিকে, মনির কখন আহে?
ঠিক নাই, ফাতেমা বলে, আমার খুব ডর লাগে-
মনিররে চিনি আমি, এহানেই দেখছি দুই দিন, রাস্তার মোড়ের রশিদ সাইবের লগে গোলমাল করছিল একেবারেই হারে হারামজাদা, হেই দিন কিছু কই নাই-
একটু থামে শহীদ। তারপর আস্তে করে বলে, তোর আবার সায় নাই তো, ফাতু-
ফাতেমা অবাক চোখে তাকায় শহীদের দিকে। বলে, এই চিনছ তুমি আমারে! হায় আল্লাহ-
শহীদ ফাতেমাকে কাছে টেনে নেয়। শুয়ে পাশ ফিরতে ফিরতে বলে, চিন্তা করিস না, দাওয়াই আছে, সুতার মতো সোজা অইয়া যাইব-
শহীদের কথা শুনে বুকের ভেতরের ভয়টা একটু যেন চাপা পড়ে। নিজেকে বিনা বাধায় সপে দেয় শহীদের বুকের নিচে।
সকালে শহীদ কাজে বেরোবার আগে শুধু বলে, এরপর যেদিন আইবে, বলবা, দুই দিন পরে যেন রাইত ১১টার পরে আহে, বুঝছ?
কী কও তুমি! ভয় পেয়ে যায় ফাতেমা, তারপর আমি কী করুম!
তোমার কিছু করন লাগব না, দ্যাখবা আহে কি না, দরজা আটকাইয়া ঘরের মধ্যে থাকবা। দরজা খোলবা না। ফাতেমা শহীদের কথাবার্তার কোনো আগামাথা পায় না। তার ভয়টা অন্য জায়গায়, যদি একবার তাকে বাগে পায় মনির মিয়া তাহলে কী হবে সেটা ভাবতেও বারবার শিউরে ওঠে ফাতেমা। মনির ওকে হাতে পেলে তো ছিঁড়েখুড়ে খেয়ে ফেলবে রাক্ষসের মতো। তবু মৃদু প্রতিবাদ করেও শেষাবধি রাজি হয় সে-
দেখা যাক, কী হয় শেষ পর্যন্ত। এই উৎপাত শেষ হওয়া দরকার। এক দিন দুই দিন যায়, তিন দিনের দিন সেই শেষ বিকেলেই আবার যথারীতি হাজির হয় মনির। আজ পালায় না ফাতেমা। দুরুদুরু বুক নিয়ে সে দরজা খোলে। দরজার ওপাশে মনির দাঁড়ায়। মুখে হাসি ঝুলিয়ে ফাতেমাকে দেখেই বলে ওঠে, ভালো আছ নি ভাবি?
দুই হাতে খোলা দরজাজুড়ে দাঁড়ানো ফাতেমা মৃদু স্বরে বলে, কী ব্যাপার, বলেন-
এট্টু বইস্যাই না হয় কতা কই, মনির ঘরে ঢুকতে চায়, খাড়াইয়া কি সব কতা কওন যায়-
আইজ না, আরেকদিন আইয়েন, আস্তে করে বলে ফাতেমা। আইজ কাম আছে অহন, বওয়ার সোমায় নাই- আরেক দিন না হয় কতা হইব-
এট্টু সময় দেও ভাবি, তোমার লগে তো কতাই হইল না, খালি আই আর যাই-। মনির হাল ছাড়ে না। তুমি না-
না, ভাইজান, আইজ না, আপনে, আইজ তো বুধবার, একটু থেমে ফাতেমা তারপর আস্তে করে বলে, আপনে শনিবার রাইতে আইয়েন, মনির তাকিয়ে থাকে ফাতেমার দিকে। একটু পরে বলে, আপনে কইছেন?
ফাতেমা মাথা নাড়ে।
কখন আমু?
রাইতে, ১১টার পর-
থমকে দাঁড়ায় মনির। কী ভেবে কিছুক্ষণ পরে বলে, ঠিকাছে, তুমি যহন কইছ। মনির চলে যায়।
মনির চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে খাটের ওপর বসে পড়ে, দম ছাড়ে ফাতেমা। এতক্ষণ যেন দম বন্ধ করে ছিল। বুকের ভেতরের দুপদুপ শব্দ পরিষ্কার শুনতে পায় কানের ভেতরে। রাতে শহীদ ফিরলে তাকে বিস্তারিত জানায় ফাতেমা। শহীদ খুব মনোযোগসহকারে শোনে ফাতেমার কথা। শেষে একসময় অস্ফুটস্বরে শুধু বলে, শনিবার রাইত ১১টা!
গভীর রাতে শহীদের স্বগতোক্তির মতো কথাটা ভীতিকর হয়ে কানে বাজে ফাতেমার। বুকের ভেতরের দুপদুপ শব্দটা আবার যেন পরিষ্কার শুনতে পায়।
পরের দিন সারাটা সকাল কোনো কাজে মন বসাতে পারে না ফাতেমা। শহীদ কাজে চলে যাওয়ার পরে একটা ভয়ের আবহ এসে ঘিরে ধরে তাকে। কাউকে কিছু বলতেও পারে না। কমবেশি ভয়ের মধ্যেই সময় চলে যায়। আসে শনিবার। ভেতরে ভেতরে আরও অস্থির হয়ে ওঠে ফাতেমা।
শহীদ সকালে কাজে যাওয়ার আগে ফাতেমা সামনে এসে দাঁড়ায়।
কি ভয় পাইলানি? শহীদের কথা শুনে যেন চমকে ওঠে ফাতেমা, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সব ঠিক অইয়া যাইব- চিন্তা কইর না-
শহীদের কথা শুনে কিছুই বোঝে না ফাতেমা। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
সন্ধ্যার পরে রাত যত বাড়তে থাকে ফাতেমার উৎকণ্ঠাও বাড়তে থাকে। যত ভয়ংকর সব ঘটনা কল্পনায় ভর করে মনের মধ্যে এসে ধাক্কা দেয়। এর মধ্যে আবার সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয়েছে টিপ টিপ বৃষ্টি। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন বৃষ্টিও বাড়তে থাকে, ঝিলের ওদিক থেকে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে শুধু। ঘরের মধ্যে একা ফাতেমা। শুধু ভাবছে কখন আসবে শহীদ। শহীদ না এলে কী করবে ফাতেমা! মনির এসে পড়লে কোথায় যাবে, কীভাবে পালাবে!
এসব ভাবতেই উত্তেজনা আর ভয়ে একেবারে অস্থির হয়ে ওঠে। এক সময় ঘরের আলোটা নিভিয়ে দেয়। জানালাটা বন্ধ বিকেল থেকে। দরজাটা তো আগে থেকেই বন্ধ আছে। তবু আবার গিয়ে দেখে ঠিকভাবে বন্ধ আছে কি না সব। ফাতেমাকে যেন বাতিকে পেয়েছে।
বেশ জোরে বাতাস বইছে। বৃষ্টিও চলছে। সামনের গলিটায় এতক্ষণে পানি জমে গেছে। শহীদের তো এতক্ষণে চলে আসার কথা। ফাতেমা জানে, মনির ঠিকই আসবে। বৃষ্টি বাদলে শয়তানদের আরও সুবিধা হয়।
এর মধ্যে হঠাৎ মনে হলো, আসলে বোকা সে, তার উচিত ছিল সন্ধ্যার পরপরই রোকেয়া ভাবীর কাছে চলে যাওয়া। শহীদ ফিরলে পরে সে ঘরে ফিরতে পারত। কেন যে সে শহীদের কথার ওপর ভরসা করে ঘরেই বসে রইল! কিন্তু এখন তো কোনো পথই নেই। বুকের ভেতর থেকে ভয়ের আবহ যেন কান্না হয়ে ফিরে এল এবার ফাতেমার চোখ ছাপিয়ে।
বাতাসের চাপে দরজা জানালায় একটু শব্দ উঠলেই বারবার চমকে উঠতে লাগল ফাতেমা। খাটের এক কোনোয় অন্ধকারে ভয়ের কাঁথা জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে নিশ্চল বসে থাকে সে।
মাথা ঝুঁকে একটা বালিশ খামচে ধরে ওইভাবে চোখবন্ধ করে কতক্ষণ বসেছিল ফাতেমা বলতে পারবে না।
হঠাৎ ঘোর কাটল দরজা ধাক্কানোর শব্দে। বাইরে এখন আর বৃষ্টি নেই। ধরমড়িয়ে উঠে বসে ফাতেমা। বুকের ভেতরে শ্বাসটা যেন আটকে আছে। ঠিক শুনল তো শব্দটা! ভ্রু কুঁচকে খাট থেকে পা নামিয়ে সোজা তাকিয়ে থাকে সে দরজার দিকে। রাত ক’টা বাজে, কে জানে! ১১টা কি বেজে গেছে!
এবারে শব্দটা আরেকটু জোরে হয়। কেউ কি ডাকছে তার নাম ধরে! কেউ এসেছে দরজার সামনে! শহীদ না কি মনির! শহীদের কথা মনে হতেই একটু যেন সাহস বাড়ে। মাটিতে পা রেখে উঠে দাঁড়ায়, তারপর আস্তে আস্তে যায় দরজার কাছে। অন্ধকারের মধ্যে ভয়ে আলো জ্বালার কথা মনেই আসে না।
দরজায় আবার শব্দ হয়। এবার কান পাতে ফাতেমা। চারদিকে ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়াও হঠাৎ শহীদের চাপা কণ্ঠ শুনতে পায়- ফাতেমা, ফাতু কপাট খোল-
কেডা! ভয়ার্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে ফাতেমা।
আরে আমি, কপাট খোল- ফাতু-
অন্ধকারের মধ্যেই দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়ায় ফাতেমা। তুই কই? বলতে বলতে শহীদ অন্ধকারের মধ্যে হাত বাড়ায় ফাতেমার দিকে, লাইট নাই! থাউক, লাইটের দরকার নাই। ছায়ামূর্তির মতো ভেতরে ঢুকলে শহীদকে ধরে ফাতেমা কেঁদে ফ্যালে। অ্যাতো দেরি করলা ক্যান-
ভয় নাই। এই তো আমি- শহীদ জড়িয়ে ধরে ফাতেমাকে।
কয়ডা বাজে? ভয়ে ভয়ে জানতে চায় ফাতেমা।
আড়াইটার বেশি। এট্টু দেরি হইল কাজকাম সাইরা... মনির আইছিল?
না।
আর আইব না, ওপারে চইল্যা গ্যাছে-
শহীদের এই ভাষাটার অর্থ জানে ফাতেমা। অন্ধকারের মধ্যে ফাতেমার শিরদাড়া বেয়ে ভয়ের একটা শীতল অনুভূতি নিচের দিকে নেমে যেতে থাকে।