বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে ৮০ লাখের বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দ্বিগুণ আকার ধারণ করবে। বড় সমস্যা হলো, আক্রান্ত রোগীদের ৫০ শতাংশই জানে না যে তারা ডায়াবেটিসে ভুগছে। তাদের ৬৫ শতাংশ পরবর্তী সময়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। জটিলতা দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে জানতে পারে ডায়াবেটিসে ভোগার কথা।
ডায়াবেটিস কী?
ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ। মানবদেহে যখন ইনসুলিন নামের হরমোনের ঘাটতি হয় অথবা ইনসুলিন কার্যকরভাবে শরীরে ব্যবহৃত হয় না কিংবা নিষ্ক্রিয় থাকে, তখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। সেই গ্লুকোজ পরবর্তী সময়ে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। এ অবস্থার নামই হলো ডায়াবেটিস।
প্রকারভেদ
ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের, টাইপ-১ ও টাইপ-২। এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় এক ধরনের ডায়াবেটিস হয়। সাধারণত ৩০ বছরের কম বয়সীদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস দেখা যায়। এ ধরনের রোগীর দেহে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হয় না। তাই সারা জীবন ইনসুলিন নিতে হয়। এ ধরনের রোগীর সংখ্যা দেশে কম। বেশি রোগী হলো টাইপ-২ ডায়াবেটিসের (প্রায় ৯০-৯৫ শতাংশ)।
উপসর্গ
কারও ডায়াবেটিস হয়েছে কি না, তা বোঝা যায় রোগীর কিছু উপসর্গ দেখে। যেমন- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া। এ ছাড়া অধিক তৃষ্ণা লাগা এবং মুখ শুকিয়ে যাওয়া, কোনো ক্ষত, ঘা থাকলে সহজে না শুকানো। পাশাপাশি চোখে ঝাপসা দেখা। অল্প পরিশ্রমেই দুর্বল হয়ে পড়া। স্বল্প সময়ের মধ্যে বা হঠাৎ ওজন বেশ কমে যাওয়া বা অত্যধিক বেড়ে যাওয়া। হাত-পা অথবা হাত-পায়ের কোনো আঙুল অবশ অনুভব হওয়া ইত্যাদি।
জটিলতা
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যদক্ষতা হ্রাস পেয়ে হার্ট অ্যাটাক, কিডনি বিকল, চোখের সমস্যা বা অন্ধত্ববরণ, পায়ে পচন ধরা ইত্যাদি হতে পারে। তাই ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।
কারণ
ডায়াবেটিস হওয়ার পেছনে নানা কারণ থাকে। যেমন—
বংশগত: বিভিন্ন কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে। এর মধ্যে বংশগত কারণ অন্যতম। বিশেষ করে মা-বাবা, খালা, ফুফু— এমন কারও ডায়াবেটিস হলে তাদের বংশধরদের মধ্যে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তবে হবেই যে এমন কথা নয়।
শৃঙ্খলা মেনে না চলা: জীবনের নিয়ম-শৃঙ্খলা ঠিকমতো মেনে না চললে যে কারও ডায়াবেটিস হতে পারে।
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন: নগরায়ণের ফলে দিন দিন মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হচ্ছে। ফাস্ট ফুডের দিকে মানুষ বেশি ঝুঁকছে। এটি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
কায়িক পরিশ্রম না করা: খেলাধুলার মাঠের অভাব, নিয়মিত ব্যায়াম না করা, শরীরের ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ব্লাড সুগার টেস্ট: খালি পেটে ও খাবার দুই ঘণ্টা পর এই পরীক্ষা করালে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কত, তা জানা যায় বা ডায়াবেটিস আছে কি না, তা জানা যায়।
এইচবিএওয়ানসি: এই পরীক্ষায় গত তিন মাসের গড় সুগারের মাত্রা পাওয়া যায়।
অন্যান্য পরীক্ষা: এ ছাড়া কিছু ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত, যেমন— চোখের পরীক্ষা, সিরাম ক্রিয়েটিনিন, সিরাম ইলেকট্রোলাইটস, ইউরিন ফর মাইক্রো অ্যালবুমিন, ইউরিন আরএমই ইত্যাদি।
চিকিৎসা
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। ওষুধ খেয়েও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়। খাবার ওষুধে কাজ না হলে তখন ইনসুলিন নিতে হয়।
ডায়াবেটিস হলে করণীয়
যারা এরই মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে ডায়াবেটিস নিয়েও সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। যেমন—
ডায়াবেটিস চার্ট মানুন
নিয়মিত ডায়াবেটিস চার্ট মেনে চলুন। দিনে চার থেকে পাঁচ-ছয়বার ব্লাড সুগার পরিমাপ করুন। শর্করা সুনিয়ন্ত্রিত থাকলে তিন-চার দিন পরপর অথবা কম নিয়ন্ত্রিত থাকলে এক দিন পরপর ব্লাড সুগার পরিমাপ করুন। খালি পেটে এবং খাবার খাওয়ার দু-তিন ঘণ্টা পরপর পরিমাপ করুন। প্রত্যেক ডায়াবেটিস রোগীর উচিত একটি গ্লুকোমিটার কিনে ঘরে রাখা। আমার মতে, একজন ডায়াবেটিস রোগীর একটি সেলফোন কেনার চেয়ে গ্লুকোমিটার কেনা বেশি জরুরি। প্রয়োজনে সেলফোন বিক্রি করে হলেও গ্লুকোমিটার কিনে নিন।
সুনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করুন
প্রতিদিন একই সময় ঘুমানো, ঘুম থেকে ওঠা, নিয়ম মেনে ব্যায়াম অথবা কায়িক পরিশ্রম করুন। মনে রাখবেন, সুস্বাস্থ্য হচ্ছে সুন্দর জীবনের বনিয়াদ। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে সবকিছুই ভালো চলে। এ জন্য ডায়াবেটিস হোক বা না হোক, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনের কোনো বিকল্প নেই।
ডায়েট চার্ট মেনে চলুন
রোগীর বয়স, উচ্চতা, বর্তমান ওজন ও প্রাত্যহিক পরিশ্রমের ধরন বুঝে নির্দিষ্ট খাদ্যতালিকা তৈরি করুন। এটি মেনে চলা খুব জরুরি। চিকিৎসকের দেওয়া রুটিনের একটু হেরফের হলে বরং অসুখটি বেড়ে যেতে পারে।
বিশেষ করে প্রতিদিন তিন বেলা ভারী খাবারের মাঝখানে তিনবার হালকা খাবার খান। এটি খুব জরুরি। এ জন্য বেলা ১১টা, বিকেল ও রাতে ঘুমানোর আগে হালকা খাবার খান। খাবারের সময় ও পরিমাণ একই রাখুন। এতে শর্করা লেভেল ঠিক থাকবে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে করণীয়
ডায়াবেটিস অনেকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য। এ জন্য কিছু করণীয় হলো:
কায়িক পরিশ্রম করুন: প্রতিদিন কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। অথবা নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। দেহকে সুস্থ রাখতে হলে প্রত্যহ ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন, সপ্তাহে কমপক্ষে পাঁচ দিন।
সঠিক ওজন বজায় রাখুন: যেভাবেই হোক, ওজন নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ডায়াবেটিসের অন্যতম একটি কারণ দেহের অতিরিক্ত ওজন। মনে রাখবেন, বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন যত বেশি হবে, ততই বাড়বে ডায়াবেটিসের বিপদ। বরং হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ ডায়াবেটিসকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে।
পরিবর্তন আনুন খাদ্যাভ্যাসে: পরিবর্তন আনুন দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে। চিনিজাতীয় খাবার, ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন। স্বাস্থ্যকর সুষম খাবার খান। প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন।
সকালের নাশতায় অবহেলা নয়: ডায়াবেটিস এড়াতে হলে কখনোই বাদ দেওয়া চলবে না সকালের নাশতা। সকালে ঘুম থেকে ওঠার দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেই সকালের নাশতা খেয়ে নেওয়া ভালো।
দরকার নিয়মিত শরীরচর্চা
ডায়াবেটিস থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। এতে ওজন যেমন নিয়ন্ত্রণে থাকে, তেমনি শরীরে ইনসুলিন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়। ফলে ডায়াবেটিসের আশঙ্কা অনেকটাই কম থাকে।
অন্যান্য
নগরায়ণ ও পরিবর্তিত জীবনধারণের কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে জীবনযাপনের ধরন পাল্টাতে হবে। অনুলিখন: হৃদয় জাহান
লেখক: পরিচালক, বারডেম একাডেমি
এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ডায়াবেটোলজি বিভাগ
বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা।
জাহ্নবী