মাতৃত্ব একজন নারীর সবচেয়ে বড় সার্থকতা। একজন নারী যখন প্রথমবার গর্ভধারণ করেন তখন অনেক কিছুই তার অজানা থাকে। তাই সন্তান ধারণ থেকে শুরু করে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত একজন মাকে অনেক বিষয়ে সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করতে হয়। একজন গর্ভবতী মায়ের যথাযথ যত্ন নিশ্চিতে পরিবারের সদস্য ও কাছের মানুষই প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। মায়ের সুস্থতার ওপর আগত সন্তানের সুস্থতা নির্ভরশীল। লিখেছেন স্কয়ার হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড আইভিএফ বিভাগের অ্যাসোসিয়েট কনসালট্যান্ট ডা. ফারজানা রশীদ
গর্ভকালীন একজন মাকে যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয় তা-ই গর্ভকালীন সেবা। গর্ভধারণের সময় থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত মা ও শিশুর যত্নকে গর্ভকালীন যত্ন বা Antinatal Care বলে। এই গর্ভকালীন যত্নের লক্ষ্য হলো মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং গর্ভজনিত কোনো জটিলতা দেখা দিলে তার প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করা।
একজন গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ প্রসব এবং প্রসব-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
গর্ভধারণের পরপরই একজন নারীর যত্নের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে অথবা ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। প্রথম ভিজিটের পর একজন গর্ভবতীকে সাধারণত ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি মাসে একবার, ৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত ১৫ দিনে একবার এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে একবার এই গর্ভকালীন যত্নের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। এ ছাড়া পাঁচ থেকে আট মাসের মধ্যে দুটি টিটি টিকা নিতে হয়। বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার ও প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে হয়। পাশাপাশি গর্ভকালীন ভারী কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হয়। হাসিখুশি থাকতে হয় এবং দিনে এক থেকে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম ও রাতে অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হয়।
যেকোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা ক্লিনিকে ডেলিভারি করানো নিরাপদ। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী দ্বারা ডেলিভারি করাতে হবে। তবে গর্ভকালীন কোনো ধরনের জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের নির্ধারিত গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা / চেকআপের সময়সূচি-
প্রথম: চতুর্থ মাসের মধ্যে (১৬ সপ্তাহ)
দ্বিতীয়: ষষ্ঠ মাসে (২৪ সপ্তাহ)
তৃতীয়: অষ্টম মাসে (৩২ সপ্তাহ)
চতুর্থ: নবম মাসে (৩৬ সপ্তাহ)
গর্ভকালীন সেবা/চেকআপে যা যা করা হয়-
গর্ভকালীন ইতিহাস নেওয়া হয়। শারীরিক পরীক্ষা করা। স্রাব পরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনা। মাকে পরামর্শ প্রদান করা।
স্বাস্থ্য শিক্ষা
বর্তমানে কোনো জটিলতা আছে কি না, যেমন- যমজ গর্ভ, গর্ভস্থ শিশু ও প্ল্যাসেন্টা (গর্ভফুল) এর অবস্থান, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, জন্ডিস, হৃদরোগ ইত্যাদি।
সাধারণ শারীরিক পরীক্ষা
গর্ভবতী মায়ের ওজন বাড়ছে কি না, রক্তচাপ কত, হাত-পা ফোলা আছে কি না, রক্তস্বল্পতা আছে কি না ইত্যাদি।
পেট পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুর উচ্চতা, বাচ্চার অবস্থান ও বাচ্চার হৃৎস্পন্দন ঠিক আছে কি না জানা হয়।
কীভাবে বুঝবেন গর্ভের সন্তান সুস্থ আছে-
গর্ভধারণের ১৮-২০ সপ্তাহ পর একজন মা, বাচ্চার নড়াচড়া বুঝতে পারেন। পেটে বাচ্চার নড়াচড়া বাচ্চার সুস্থতা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে। একটি সুস্থ বাচ্চা স্বাভাবিক পরিমাণ নড়াচড়া করে থাকে। এই নড়াচড়ার সংখ্যা হলো ১২ ঘণ্টায় ১০ বার।
গর্ভবতী মায়ের খাবার-
এ সময় মা ও গর্ভের শিশু দুজনের সুস্থতার জন্য একটু বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে শিশু বেড়ে ওঠার জন্য আমিষ জাতীয় খাবার যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, দুধ বেশি করে খেতে হবে।
এ ছাড়া সবুজ ও রঙিন শাকসবজি, তরকারি ও ফল ছাড়াও যেসব খাবারে আয়রন বেশি আছে যেমন- কাঁচাকলা, পালংশাক, কচু, কচুশাক, কলিজা ইত্যাদি বেশি বেশি খেতে হবে। আর বেশি পরিমাণে পানি (দিনে ৮-১০ গ্লাস) খেতে হবে এবং রান্নায় আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করতে হবে।
গর্ভে থাকাকালীন শেষ তিন মাস শিশু খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে। যে কারণে প্রসূতির পায়ে পানি আসতে পারে। এ ছাড়া শেষ তিন মাসে পেট বড় হয়ে যাওয়ার কারণে গর্ভবতী মায়ের অনেক কষ্ট হয়। এ সময়ে কিছু জটিলতাও দেখা দিতে পারে, যেমন অস্বাভাবিক পেট বড় বা ছোট হওয়া, হঠাৎ রক্ত ভাঙা, খুব বেশি জ্বর আসা, রক্তচাপ অতিরিক্ত বেশি হওয়া। এমন পরিস্থিতিতে অনতিবিলম্বে চিকিৎসককে দেখাতে হবে।
গর্ভাবস্থায় যা খাবেন, যা খাবেন না
জীবনের সব পর্যায়েই স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গর্ভাবস্থায় এটা বিশেষভাবে জরুরি। সুষম খাবার সন্তানের বেড়ে ওঠা, তার বিকশিত হওয়া এবং সঠিক ওজন বজায় রাখতে সহায়তা করবে।
একটি পুষ্টিকর খাবার তালিকা তখনই নিশ্চিত হয় যখন মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় সবগুলো খাদ্য উপাদানযুক্ত স্বাস্থ্যকর খাবার প্রতিদিনের খাবার তালিকায় থাকে। যেমন- ফলমূল, শাকসবজি, গ্রেইনস বা শস্য, আমিষ, ডেইরি, তেল।
গর্ভাবস্থায় কোন কোন ভিটামিন ও খনিজ দরকার?
গর্ভধারণের শুরু থেকেই নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজ খাদ্য উপাদান প্রয়োজন হয়। যেমন- ক্যালসিয়াম, আয়রন, আয়োডিন, কোলিন, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-বি৬, ভিটামিন-বি১২ এবং ফলিক অ্যাসিড।
গর্ভাবস্থায় কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত?
গর্ভবতীদের নির্দিষ্ট কিছু খাবার থেকে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আর তা গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি করতে পারে। যেমন- কাঁচা, পাস্তুরায়ন ছাড়া দুধ এবং ওই ধরনের দুধ থেকে তৈরি কোমল পনির। মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার। কাঁচা ও পুরোপুরি রান্না না হওয়া মাংসজাত পণ্য যেমন সসেজ ও কোল্ড কাট।
কাঁচা মাছ ও সিফুড। স্মোকড কিন্তু রান্না না করা মাছ যেমন- স্মোকড স্যামন। রান্না না করা অঙ্কুরিত বীজ, খাদ্যশস্য ও শিম। কাঁচা মুলা, শিম ও আলফালফার বীজ এবং রেডি-টু-ইট সালাদ এসব খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কাঁচা বা কম সেদ্ধ ডিম। যকৃত (লিভার) ও অন্যান্য অঙ্গের মাংস। যকৃতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকলেও এটা অন্তঃসত্ত্বাদের খেতে বলা হয় না। কারণ এতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ থাকে এবং এই মাংসে বিষক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে।
সূত্র: ইউনিসেফ
কলি