![ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ের জন্য আপস : ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে বললেন আদালত](uploads/2024/02/21/1708505250.court.jpg)
দুই বছর আগে ১২ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে ৫৫ বছর বয়সের মুদি দোকানদার আনোয়ারুল ইসলাম। এ নিয়ে মামলা হয়। আসামিও গ্রেপ্তার হয়। বিচার চলমান। এরই মধ্যে ওই কিশোরী একটি মেয়েসন্তান জন্ম দেয়।
মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) ধার্যদিনে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এ উভয় পক্ষের আপসনামা দাখিল করা হয়। সকাল ১০টায় আসামির আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে আদালত কক্ষসহ সামনের বারান্দায় ভিড় জমে। আনোয়ারুলসহ তার সহযোগী আসামিদের কারাগার থেকে এনে আদালতে হাজির করা হয়। লোহার খাঁচাসংবলিত কাঠগড়ায় আসামিদের দাঁড় করানো হয়। ওই কিশোরী আসে তার বড় বোনের সঙ্গে। বেলা পৌনে ১১টায় বিচারক সাবেরা সুলতানা খানম এজলাসে বিচারকাজ শুরু করেন।
শুনানির শুরুতে ওই কিশোরী দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে বিচারকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে বড় বোন। আদালতে আপসরফার আবেদন। ৫৫ বছর বয়সের আসামি আনোয়ারুলের সঙ্গে বিয়ের মাধ্যমে উভয় পক্ষ আপসরফা চেয়েছে।
শুনানিতে আসামি পক্ষের আইনজীবী শিশুসন্তান ও সামাজিক স্বীকৃতির প্রসঙ্গ তোলেন। দুই পক্ষই বিয়ের বিষয়ে সম্মত বলে জানায়। এ সময় বিচারক কিশোরীকে বলেন, ‘ওই বয়স্ক লোকটাকে কি তুমি বিয়ে করবে?’ কোনো জবাব না দিয়ে তাকিয়ে থাকে কিশোরী। লোহার খাঁচায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা চুল–দাড়ি পাকা আনোয়ারুলের দিকে নির্দেশ করে কিশোরীকে বিচারক আবার বলেন, ‘পেছনে তাকিয়ে দেখ, ওই চুল-দাড়ি পাকা বয়স্ক লোকটাকে তুমি বিয়ে করতে চাও?’ মেয়েটি পেছনে সামান্য মাথা ঘোরালেও খাঁচার দিকে তাকায় না, পাশে থাকা বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ সময় আদালতে উপস্থিত থাকা কয়েকজন নারী মৃদু স্বরে বলেন, ‘এ রকম একটা লোকের সঙ্গে বিয়ে কী করে সম্ভব!’
বিচারক এ সময় কিশোরীকে বলেন, ‘বোনের দিকে তাকিও না। তুমি নিজে বল। বাসায় গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। তুমি কী চাও, একটা আসামিকে বিয়ে করতে? তোমার সামনে ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। তুমি ছোট মানুষ। তোমার সন্তান আছে। সে বড় হয়ে কী বলবে এমন একটি লোককে বিয়ে করলে? মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার কত মেয়ের সন্তান জন্ম হয়েছে। ওই মেয়েরা কি পাকিস্তানি ধর্ষককে বিয়ে করেছেন?’
তখনো কিশোরী নিশ্চুপই ছিল। এরপর মেয়েটির বোন, আসামি পক্ষের আইনজীবী ও রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশে বিচারক বলেন, ‘মেয়েটার পুরো ভবিষ্যৎ সামনে পড়ে আছে। সবাই মিলে কীভাবে মেয়েটিকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, সেই চেষ্টা করুন। ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েন না। এই মেয়েটি প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়াবে।’
শুনানির সময় ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহমেদ, মোহাম্মদ লিয়াকত আলী, আসামি পক্ষের আইনজীবী মো. ইসমাঈল ভূঞা উপস্থিত ছিলেন।
অ্যাডভোকেট ইসমাঈল ভূঞা সাংবাদিকদের জানান, আসামি আনোয়ারুল হকের স্ত্রী ও বড় বড় ছেলেমেয়ে আছে। তারাই পক্ষে মামলার দেখভাল করছেন। দুই বছর ধরে আসামি কারাগারে। দুই পরিবারই বিয়ের মাধ্যমে আপস চাইছে। সেসব চিন্তা করে আপসের কথা বলা হয়েছে আদালতে।
রাজধানীর মাটিকাটা এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকত ওই কিশোরী। স্থানীয় স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। বাসার কাছে আসামি মো. আনোয়ারুল হকের (৫৫) মুদি দোকান ছিল। ওই দোকান থেকে নিয়মিত কেনাকাটা করার কারণে কিশোরীর পরিবারের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। কিশোরী দোকানের সামনে দিয়ে মাটিকাটা এলাকার কোচিং সেন্টারে আসা-যাওয়া করত। ২০২২ সালের ১ এপ্রিল দোকানের কিছু পণ্য দিয়ে কিশোরীকে কাছে ডেকে নেয় আনোয়ারুল হক এবং দোকানের ভেতরে নিয়ে ধর্ষণ করে। এরপর আরও কয়েকবার ভয় দেখিয়ে কিশোরীকে ধর্ষণ করে। ভয়ে ওই কিশোরী কাউকে কিছু বলেনি। একপর্যায়ে মেয়েটির শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দিলে ওই বছরের নভেম্বর মাসে বড় বোন তাকে একটি হেলথ কেয়ার সেন্টারে নিয়ে যান। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানান, কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা। পরে জিজ্ঞাসা করলে কিশোরী সব ঘটনা জানায়। ঘটনার সাত মাস পর বড় বোন বাদী হয়ে আনোয়ারুল হককে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। এরপর কিশোরী মেয়েসন্তানের জন্ম দেয়। শিশুসন্তানকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা দত্তক নিয়েছেন বলে জানান রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহমেদ।