১৮৭৮ সালে ঢাকায় প্রথম স্থাপিত হয় ওভারহেড পানির ট্যাংক, যা পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তর দিকে অবস্থিত। স্থানীয়দের কাছে এ ট্যাংকটি ‘বাহাদুর শাহ পার্ক পানির ট্যাংক’ বা ‘জলঘর’ নামে পরিচিত। পানির ট্যাংকটির বর্তমান চিত্র তুলে ধরেছেন সৈয়দ শিশির।
একটা সময় ছিল যখন নিয়মিত প্রতিবছর মহামারিতে ঢাকা শহরে অনেক মানুষের মৃত্যু হতো। এর কারণ ছিল বিশুদ্ধ পানির অভাব। ১৮৭৮ সালের পূর্ব-পর্যন্ত ঢাকায় খাবার পানির উৎস ছিল বুড়িগঙ্গা, বিভিন্ন পুকুর-ডোবা আর নোংরা পাতকুয়ো। তখন বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহের কাজ করত সাক্কা বা ভিস্তিওয়ালারা।
গত শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত মশকের সাহায্যে পানি সরবরাহের কাজ করত তারা। কিন্তু রোগ-শোক থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন দেখা দেয় পরিশ্রুত (যান্ত্রিকভাবে বা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে যে পানি থেকে অপদ্রব্যাদি দূর করা হয়।) পানির। মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকার টুকিটাকি’ বই থেকে জানা যায়, ১৮৭১ সালে ঢাকার নবাব আবদুল গনি সরকারকে ৫০ হাজার টাকা দান করেন শহরের কল্যাণার্থে ব্যয় করার জন্য। পরে ঠিক হয় এ টাকা ব্যয় করা হবে ঢাকায় পরিশ্রুত পানি সরবরাহের জন্য। কিন্তু ৫০ হাজার টাকা ছিল এ প্রকল্পের জন্য অপ্রতুল। ১৮৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে নবাব আবদুল গনি এজন্য শহরের গণ্যমান্যদের নিয়ে বৈঠক আহ্বান করেন। বৈঠকে কেবল শহরের বিখ্যাত দুজন বাঈজি রাজলক্ষ্মী আর আমিরজান ৫০০ টাকা করে দান করতে চাইলেন।
ফলে নবাব গনি নিজেই আরও এক লাখ টাকা দান করেন। তবে নবাব গনির শর্ত ছিল ঢাকাবাসীকে বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করতে হবে। অবশ্য পরে নবাব আহসানউল্লাহ ৫০ হাজার টাকা এবং সরকার ৯০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন প্রকল্পের জন্য। ১৮৭৪ সালে তৎকালীন ভাইসরয় চাঁদনীঘাটে ওয়াটার ওয়ার্কসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৮৭৮ সালে এর কাজ সম্পন্ন হলে ঢাকায় শুরু হয় পরিশ্রুত পানি সরবরাহ। ইতিহাস বলছে, ১৮৭৮ সালে ঢাকায় প্রথম স্থাপিত হয় ওভারহেড পানির ট্যাংক, যা পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তর দিকে অবস্থিত।
স্থানীয়দের কাছে এই ট্যাংকটি ‘বাহাদুর শাহ পার্ক পানির ট্যাংক’ বা ‘জলঘর’ নামে পরিচিত। এর লাল ইটের প্রাচীর কাঠামো, স্থাপত্যশৈলী, নির্মাণকৌশল এতই অসাধারণ এবং স্বতন্ত্র যে পথচারীদের নজর কাড়ে। কিছুটা গম্বুজের মতো দেখতে দানবীয় এ স্থাপনাটি লম্বায় প্রায় পাঁচতলা বাড়ির সমান। ১৮৭৮ সালের ২৪ মে থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ট্যাংকটি ব্যবহার করা শুরু হয়।
ট্যাংকটি বাহাদুর শাহ পার্কের সেই মোড়ের আকর্ষণীয় এক নিদর্শন। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়ে দাবার বোর্ডের মতো সাদা-কালো মেঝে আর গোলাকার ট্যাংকটির মাঝে একটি লম্বা খাম্বা। ট্যাংকটির মাথার চারদিক খেয়াল করলে চোখে পড়ে সিমেন্টের তৈরি সিংহমুখের। যা বাইরের দিকে হা করে আছে। কিছুটা মিল পাওয়া যায় সিঙ্গাপুরের লায়ন স্ট্যাচুর সঙ্গে। অনেকের মতে, বৃষ্টির পানি যেন না জমতে পারে, তাই পানি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এ ব্যবস্থা করেছিল ব্রিটিশরা।
অবশ্য তারপর ঠিক কবে এ ট্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কেউ বলেন, পাকিস্তান আমলেই এটি বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কারও মতে, ২৫ বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে। যখনই বন্ধ হোক, ১৪৬ বছর বয়সী এ পানির ট্যাংকটি বর্তমানে কেবল একটি অকেজো, জরাজীর্ণ বিশাল স্তম্ভ হয়েই দাঁড়িয়ে আছে! অবশ্য ২০২০ সালের মে মাসে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক এ ট্যাংকটিকে ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তাতেও এটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ তো নেই-ই, বরং এর ভেতরে মাজার ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, বহুদিন আগেই ট্যাংকটি চলে গেছে দখলদারের খপ্পরে। ট্যাংকের নিচের খালি জায়গায় কয়েক দশক আগে স্থাপিত হয়েছে মাজার। বর্তমানেও ট্যাংকের দেয়ালের পাশ ঘেঁষে রয়েছে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী দোকান। প্রবেশপথে একটি লোহার গেট, সে গেটের ওপরে মাজারের বিভিন্ন ব্যানার, পোস্টার, শানে নুজুল লেখা। অথচ ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি যে এক সময় ঢাকাবাসীকে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে মৃত্যু, মহামারির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, তা নিয়ে নেই কোনো স্মৃতিফলক।
ঢাকার প্রথম পানির ট্যাংকটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ঢাকাবাসীর কাছে যেন তার পুরোনো গৌরব আর ইতিহাসেরই জানান দেয়। ঢাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে ওয়াসার মোট ৩৮টি অকেজো ওভারহেড পানির ট্যাংক। বাহাদুর শাহ পার্কের সমসাময়িক আরেকটি পানির ট্যাংকের দেখা মেলে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার ভাট্টিখানা এলাকায়। যার স্থাপত্যশৈলী অনেকটা একই রকম। লাল ইট-সুরকি দিয়ে নির্মিত ট্যাংকটি। এলাকাবাসীর মতে, এটি ছিল ঢাকা শহরের দ্বিতীয় পানির ট্যাংক। হাটখোলা রোড, ফুলবাড়িয়া, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, লালমাটিয়া, মিরপুর-১০ এলাকার ওভারহেড পানির ট্যাংকগুলোরও প্রায় একই চিত্র। ফকিরাপুল আর লালমাটিয়ার ট্যাংক দুটি স্টিলের তৈরি। সাধারণ ট্যাংকগুলোর চেয়ে আকারেও বেশ বড় এগুলো। যে ট্যাংকগুলোর সঙ্গে ওয়াসার জোন অফিস অবস্থিত, সেগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও বাকি ট্যাংকগুলো পড়ে আছে অরক্ষিত।
বিশাল আকৃতির ওভারহেড ট্যাংকগুলো মূলত ব্যবহৃত হতো ওয়াসার পানি জমিয়ে রাখার কাজে। পানি শোধনাগার থেকে পরিশোধিত করে পাম্পের সাহায্য ট্যাংকে উঠিয়ে রিজার্ভ করে রাখা হতো। কোনো কারণে পাম্প নষ্ট হলে সারানোর সময়টুকুতে যেন এলাকাবাসী পানির অভাবে না থাকে, সে জন্যই ছিল এ ব্যবস্থা। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল বেশ কম। বর্তমানে এ শহরের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটির বেশি। জানা যায়, ওভারহেড পানির ট্যাংকগুলো পানিতে ভরতে সময় লাগত ১০ ঘণ্টার মতো।
বর্তমানে ঢাকার বিপুল জনগোষ্ঠীকে পানি সরবরাহ দিতে হিমশিম খেতে হয় ওয়াসাকে। তাই রিজার্ভ ট্যাংকে পানি উঠিয়ে রাখার মতো সময় আর নেই। এখন সরাসরি লাইনে পানি সাপ্লাই করা হয় বাড়িগুলোর নিজস্ব রিজার্ভ ট্যাংকে। এ ছাড়া বড় বড় পানির ট্যাংকের রক্ষণাবেক্ষণও ছিল বেশ ঝামেলাপূর্ণ। উঁচু ট্যাংক থেকে পানি সাপ্লাই করায় পানির চাপও হতো অনেক বেশি; যে কারণে অনেক বাসাবাড়ির পানির ট্যাপ ভেঙে যেত। তাই মূলত আশির দশক থেকে বন্ধ হতে শুরু করে ওভারহেড পানির ট্যাংকগুলো।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত সুবিশাল পানির ট্যাংকগুলো এখনো নজর কাড়ে পথচারীদের। কোনো কোনো জায়গায় বিশাল বিশাল অট্টালিকা এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি সেসব ট্যাংকের সামনে। কালের আবর্তে নির্দিষ্ট কিছু এলাকার নামকরণও হয়ে গেছে পানির ট্যাংকের নামে। যেমন- ‘ফকিরেরপুল পানির টাংকি’, ‘বিজয়নগর পানির টাংকি’। অথচ এসব ট্যাংকের বেশির ভাগই এখন অকেজো ও জরাজীর্ণ বিশাল স্তম্ভ হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। রাজধানীর প্রাচীন এ নিদর্শনগুলোর তালিকা করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।
কলি