জলঘরে জল নেই! । খবরের কাগজ
ঢাকা ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, সোমবার, ২০ মে ২০২৪

জলঘরে জল নেই!

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৪, ০৩:৪৫ পিএম
জলঘরে জল নেই!
ঢাকার প্রথম পানির ট্যাংকটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ঢাকাবাসীর কাছে যেন তার পুরনো গৌরব আর ইতিহাসেরই জানান দেয়। ছবি: শরিফ মাহমুদ

১৮৭৮ সালে ঢাকায় প্রথম স্থাপিত হয় ওভারহেড পানির ট্যাংক, যা পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তর দিকে অবস্থিত। স্থানীয়দের কাছে এ ট্যাংকটি ‘বাহাদুর শাহ পার্ক পানির ট্যাংক’ বা ‘জলঘর’ নামে পরিচিত। পানির ট্যাংকটির বর্তমান চিত্র তুলে ধরেছেন সৈয়দ শিশির।

একটা সময় ছিল যখন নিয়মিত প্রতিবছর মহামারিতে ঢাকা শহরে অনেক মানুষের মৃত্যু হতো। এর কারণ ছিল বিশুদ্ধ পানির অভাব। ১৮৭৮ সালের পূর্ব-পর্যন্ত ঢাকায় খাবার পানির উৎস ছিল বুড়িগঙ্গা, বিভিন্ন পুকুর-ডোবা আর নোংরা পাতকুয়ো। তখন বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহের কাজ করত সাক্কা বা ভিস্তিওয়ালারা।

গত শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত মশকের সাহায্যে পানি সরবরাহের কাজ করত তারা। কিন্তু রোগ-শোক থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন দেখা দেয় পরিশ্রুত (যান্ত্রিকভাবে বা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে যে পানি থেকে অপদ্রব্যাদি দূর করা হয়।) পানির। মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকার টুকিটাকি’ বই থেকে জানা যায়, ১৮৭১ সালে ঢাকার নবাব আবদুল গনি সরকারকে ৫০ হাজার টাকা দান করেন শহরের কল্যাণার্থে ব্যয় করার জন্য। পরে ঠিক হয় এ টাকা ব্যয় করা হবে ঢাকায় পরিশ্রুত পানি সরবরাহের জন্য। কিন্তু ৫০ হাজার টাকা ছিল এ প্রকল্পের জন্য অপ্রতুল। ১৮৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে নবাব আবদুল গনি এজন্য শহরের গণ্যমান্যদের নিয়ে বৈঠক আহ্বান করেন। বৈঠকে কেবল শহরের বিখ্যাত দুজন বাঈজি রাজলক্ষ্মী আর আমিরজান ৫০০ টাকা করে দান করতে চাইলেন।

ফলে নবাব গনি নিজেই আরও এক লাখ টাকা দান করেন। তবে নবাব গনির শর্ত ছিল ঢাকাবাসীকে বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করতে হবে। অবশ্য পরে নবাব আহসানউল্লাহ ৫০ হাজার টাকা এবং সরকার ৯০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন প্রকল্পের জন্য। ১৮৭৪ সালে তৎকালীন ভাইসরয় চাঁদনীঘাটে ওয়াটার ওয়ার্কসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৮৭৮ সালে এর কাজ সম্পন্ন হলে ঢাকায় শুরু হয় পরিশ্রুত পানি সরবরাহ।  ইতিহাস বলছে, ১৮৭৮ সালে ঢাকায় প্রথম স্থাপিত হয় ওভারহেড পানির ট্যাংক, যা পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তর দিকে অবস্থিত।

স্থানীয়দের কাছে এই ট্যাংকটি ‘বাহাদুর শাহ পার্ক পানির ট্যাংক’ বা ‘জলঘর’ নামে পরিচিত। এর লাল ইটের প্রাচীর কাঠামো, স্থাপত্যশৈলী, নির্মাণকৌশল এতই অসাধারণ এবং স্বতন্ত্র যে পথচারীদের নজর কাড়ে। কিছুটা গম্বুজের মতো দেখতে দানবীয় এ স্থাপনাটি লম্বায় প্রায় পাঁচতলা বাড়ির সমান। ১৮৭৮ সালের ২৪ মে থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ট্যাংকটি ব্যবহার করা শুরু হয়।

ট্যাংকটি বাহাদুর শাহ পার্কের সেই মোড়ের আকর্ষণীয় এক নিদর্শন। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়ে দাবার বোর্ডের মতো সাদা-কালো মেঝে আর গোলাকার ট্যাংকটির মাঝে একটি লম্বা খাম্বা। ট্যাংকটির মাথার চারদিক খেয়াল করলে চোখে পড়ে সিমেন্টের তৈরি সিংহমুখের। যা বাইরের দিকে হা করে আছে। কিছুটা মিল পাওয়া যায় সিঙ্গাপুরের লায়ন স্ট্যাচুর সঙ্গে। অনেকের মতে, বৃষ্টির পানি যেন না জমতে পারে, তাই পানি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এ ব্যবস্থা করেছিল ব্রিটিশরা।

অবশ্য তারপর ঠিক কবে এ ট্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কেউ বলেন, পাকিস্তান আমলেই এটি বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কারও মতে, ২৫ বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে। যখনই বন্ধ হোক, ১৪৬ বছর বয়সী এ পানির ট্যাংকটি বর্তমানে কেবল একটি অকেজো, জরাজীর্ণ বিশাল স্তম্ভ হয়েই দাঁড়িয়ে আছে! অবশ্য ২০২০ সালের মে মাসে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক এ ট্যাংকটিকে ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তাতেও এটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ তো নেই-ই, বরং এর ভেতরে মাজার ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, বহুদিন আগেই ট্যাংকটি চলে গেছে দখলদারের খপ্পরে। ট্যাংকের নিচের খালি জায়গায় কয়েক দশক আগে স্থাপিত হয়েছে মাজার। বর্তমানেও ট্যাংকের দেয়ালের পাশ ঘেঁষে রয়েছে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী দোকান। প্রবেশপথে একটি লোহার গেট, সে গেটের ওপরে মাজারের বিভিন্ন ব্যানার, পোস্টার, শানে নুজুল লেখা। অথচ ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি যে এক সময় ঢাকাবাসীকে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে মৃত্যু, মহামারির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, তা নিয়ে নেই কোনো স্মৃতিফলক।

ঢাকার প্রথম পানির ট্যাংকটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ঢাকাবাসীর কাছে যেন তার পুরোনো গৌরব আর ইতিহাসেরই জানান দেয়। ঢাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে ওয়াসার মোট ৩৮টি অকেজো ওভারহেড পানির ট্যাংক। বাহাদুর শাহ পার্কের সমসাময়িক আরেকটি পানির ট্যাংকের দেখা মেলে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার ভাট্টিখানা এলাকায়। যার স্থাপত্যশৈলী অনেকটা একই রকম। লাল ইট-সুরকি দিয়ে নির্মিত ট্যাংকটি। এলাকাবাসীর মতে, এটি ছিল ঢাকা শহরের দ্বিতীয় পানির ট্যাংক। হাটখোলা রোড, ফুলবাড়িয়া, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, লালমাটিয়া, মিরপুর-১০ এলাকার ওভারহেড পানির ট্যাংকগুলোরও প্রায় একই চিত্র। ফকিরাপুল আর লালমাটিয়ার ট্যাংক দুটি স্টিলের তৈরি। সাধারণ ট্যাংকগুলোর চেয়ে আকারেও বেশ বড় এগুলো। যে ট্যাংকগুলোর সঙ্গে ওয়াসার জোন অফিস অবস্থিত, সেগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও বাকি ট্যাংকগুলো পড়ে আছে অরক্ষিত।

বিশাল আকৃতির ওভারহেড ট্যাংকগুলো মূলত ব্যবহৃত হতো ওয়াসার পানি জমিয়ে রাখার কাজে। পানি শোধনাগার থেকে পরিশোধিত করে পাম্পের সাহায্য ট্যাংকে উঠিয়ে রিজার্ভ করে রাখা হতো। কোনো কারণে পাম্প নষ্ট হলে সারানোর সময়টুকুতে যেন এলাকাবাসী পানির অভাবে না থাকে, সে জন্যই ছিল এ ব্যবস্থা। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল বেশ কম। বর্তমানে এ শহরের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটির বেশি। জানা যায়, ওভারহেড পানির ট্যাংকগুলো পানিতে ভরতে সময় লাগত ১০ ঘণ্টার মতো।

বর্তমানে ঢাকার বিপুল জনগোষ্ঠীকে পানি সরবরাহ দিতে হিমশিম খেতে হয় ওয়াসাকে। তাই রিজার্ভ ট্যাংকে পানি উঠিয়ে রাখার মতো সময় আর নেই। এখন সরাসরি লাইনে পানি সাপ্লাই করা হয় বাড়িগুলোর নিজস্ব রিজার্ভ ট্যাংকে। এ ছাড়া বড় বড় পানির ট্যাংকের রক্ষণাবেক্ষণও ছিল বেশ ঝামেলাপূর্ণ। উঁচু ট্যাংক থেকে পানি সাপ্লাই করায় পানির চাপও হতো অনেক বেশি; যে কারণে অনেক বাসাবাড়ির পানির ট্যাপ ভেঙে যেত। তাই মূলত আশির দশক থেকে বন্ধ হতে শুরু করে ওভারহেড পানির ট্যাংকগুলো।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত সুবিশাল পানির ট্যাংকগুলো এখনো নজর কাড়ে পথচারীদের। কোনো কোনো জায়গায় বিশাল বিশাল অট্টালিকা এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি সেসব ট্যাংকের সামনে। কালের আবর্তে নির্দিষ্ট কিছু এলাকার নামকরণও হয়ে গেছে পানির ট্যাংকের নামে। যেমন- ‘ফকিরেরপুল পানির টাংকি’, ‘বিজয়নগর পানির টাংকি’। অথচ এসব ট্যাংকের বেশির ভাগই এখন অকেজো ও জরাজীর্ণ বিশাল স্তম্ভ হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। রাজধানীর প্রাচীন এ নিদর্শনগুলোর তালিকা করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।

কলি

শ্রেয়ার কথা

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ০১:৫৮ পিএম
শ্রেয়ার কথা

এখন বা এক মুহূর্ত পর কী হতে যাচ্ছে, তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই জানেন। এইতো মনে পড়ে, কিছুদিন আগে শ্রেয়াকে যখন প্রেগনেন্সি রিপোর্টটা দেখিয়ে বললাম ‘তুমি মা হতে চলেছ’, খুশিতে ওর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। আমি কোনো দিন কাউকে এত খুশি হতে দেখিনি।

কিছুদিন পর শ্রেয়াকে নিয়ে শ্রীপুরে জয়ন্তী দেবীর মন্দিরের উদ্দেশে রওনা দিই। বাসা থেকে বেশ দূরে। আমি নিজেই ড্রাইভিং করছিলাম। হঠাৎ ঝড় শুরু হলো। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। আমরা একটি বাড়িতে আশ্রয় নিই। চার দেয়ালে ঘেরা অনেক পুরোনো বাড়ি। আশপাশে গাছগাছালি ছাড়া আর কোনো বাড়িঘর ছিল না। একজন বৃদ্ধ চাচা আমাদের আশ্রয় দেন। বাড়িটিতে তিনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। খুব সম্ভবত তিনি বাড়ির কেয়ারটেকার। বললাম, ‘চাচা, আমরা বিপদে পড়েছি। ঝড় কমলেই চলে যাব। কিছুটা সময় এখানে থাকতে দিন।’ তিনি বললেন, ‘আজ রাতটা অনেক খারাপ। ভয় নেই, রাতটা এখানে থাকেন। সকালে চলে যাবেন।’

এই কথা বলে তিনি আমাদের জন্য খাবার আনতে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, ‘আজ রাতটা সুবিধার না, ভুলেও কেউ বাইরে যাবেন না। এই যে দেখেন, কিছুক্ষণ আগে ঝড় ছিল, এখন নেই। একটু পর আবার শুরু হবে।’ শ্রেয়া বলল, ‘চাচা, আজ রাতটা খারাপ বলছেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘মা, আপনারা এ যুগের মানুষ, বিশ্বাস করবেন না। এই গ্রামে জয়ন্তী দেবী মন্দির নামে একটি মন্দির আছে। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে মন্দিরের দেবী প্রতি বছর একজন করে কুমারী মেয়ে নিয়ে যেত। এখন বছরের এই রাতে একজন করে কুমারী মেয়ে বের হয়, যে মানুষের ক্ষতি করে।’ শ্রেয়া বলল, ‘আপনি কি এখন পর্যন্ত কোনো মেয়েকে মন্দির থেকে বের হতে দেখেছেন?’

’না, আমি দেখেনি। তবে অনেকেই দেখেছে।’

অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। দরজার ওপাশ থেকে একটি মেয়ে ডাকছে, ‘কেউ আছেন? দয়া করে দরজাটা খুলুন। আমি অনেক বিপদে পড়েছি।’ আমি দরজাটা খুলতে গেলে চাচা আমার সামনে দাঁড়ান। আমাকে বাধা দিয়ে বলেন, ‘বাবা, আপনার পায়ে ধরি, দরজাটা খুলবেন না। খুললে আমরা সবাই বিপদে পড়ব।’

‘কী বলেন! একটা মানুষ বিপদে পড়ে ডাকছে। আর আমরা দরজা খুলব না?’

চাচাকে ধাক্কা দিয়ে আমি দরজাটা খুলে দিই। আধ ভেজা হয়ে ১৭-১৮ বছরের মেয়েটি কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকেই বলল- ‘দয়া করে আজ রাতটা আমাকে থাকতে দিন। আমি ট্রেনে যাচ্ছিলাম। পাশের রেলস্টেশনে ট্রেনটা থামল। আমি কিছু খাবার কেনার জন্য নামলাম। আর তখনই ট্রেনটা আমাকে রেখে চলে গেল। এর মধ্যে ঝড় শুরু হলো। অনেকটা সময় ছোটাছুটি করার পর এ বাড়িটি দেখতে পাই। প্লিজ, রাতটা আমাকে এখানে থাকতে দিন। সকালে ভোরের ট্রেনে চলে যাব।’

থাকার জন্য চাচা মেয়েটিকে একটি রুম দেখিয়ে দিলেন।

ঝড় আবার থেমে গেল। আমি আর শ্রেয়া শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ খেয়াল করি, শ্রেয়া ভীষণ কাঁপছে। ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘শ্রেয়া, তোমার কি খারাপ লাগছে?’

‘আমার অনেক ভয় হচ্ছে। দেবীটা তোমাকে মেরে ফেলবে। চল আমরা চলে যাই।’

আমি হেসে বললাম, ‘কী সব উলটাপালটা বলছ? দেবী আবার আসল কোথা থেকে?’

‘দেখোনি, দেবীর মতো মেয়েটি কেমন করে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটি মানুষ না, মানুষরূপী দেবী। ও আমাদের পিছে পিছে ওই জয়ন্তী দেবী মন্দির থেকে এসেছে।’ বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ও ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ঘুম থেকে উঠে মেয়েটাকে আর দেখা গেল না। দরজা খোলা ছিল। খুব সম্ভবত ভোরের ট্রেনে মেয়েটি চলে গেছে।

ওই রাতের পর থেকে শ্রেয়া অস্বাভাবিক সব আচরণ করতে শুরু করে। শ্রেয়ার অস্বাভাবিক আচরণ আমাকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়। শুধু ভাবতাম, আর কয়েকটা দিন। মা হলেই ও ভালো হয়ে যাবে। একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানসহ আমি আমার পুরোনো শ্রেয়াকে ফিরে পাব। প্রার্থনাই শেষ সম্বল।

আমি আবার ছুটে চলি জয়ন্তী দেবী মন্দিরে। যাওয়ার পথে ওই চার দেয়াল ঘেরা পুরোনো বাড়িটি দেখে কেয়ারটেকার চাচাকে খুঁজতে যাই। যা জানতে পারি, তার সারমর্ম হচ্ছে ‘সেদিনের ওই ঝড়ের রাতের পর একটি মেয়ের লাশ পাওয়া যায় বাড়িটির পুকুরপাড়ে। তার জন্য কেয়ারটেকারকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেননি বলে হাজতবাস করছেন।’

তারপর নিম্ন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে, অনেক কষ্টে নিজেকে অপরাধী এবং চাচাকে মুক্ত করি। কারণ, সেই রাতে আমার জীবননাশের আশঙ্কার কথা ভেবে মেয়েটাকে শ্রেয়াই পুকুরে ফেলে দিয়েছিল, পরে জানতে পেরেছিলাম। আজ আমার হাজতবাসের তৃতীয় দিন। খুব অস্থির অনুভব করছিলাম। এই অস্থিরতার মধ্যে শ্রেয়ার দুই বাক্যের একটি চিঠি আসে।

‘আমি এবং তোমার মেয়ে দুজনই ভালো আছি। আর আমি তোমার মেয়ের নাম রেখেছি জয়ন্তী।’ 
-তোমার শ্রেয়া


ইঙ্গোলস্ট্যাড, জার্মানি

 কলি 

দেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ০১:৫৫ পিএম
দেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম
পাসিংপাড়া পরিচ্ছন্ন একটি গ্রাম। এ গ্রামের বাসিন্দারা খুব সহজ-সরল এবং পরিশ্রমী। ছবি: সংগৃহীত

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৭০০ ফুট উঁচুতে মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ানো একটি গ্রাম। গ্রামটির নাম পাসিংপাড়া। বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় কেওক্রাডং চূড়ার পাশেই এর অবস্থান। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম। এর অবস্থান এত উঁচুতে যে, মেঘ এই গ্রামের নিচ দিয়ে নদীর মতো বয়ে চলে। আবার গ্রামের মধ্য দিয়ে মেঘের অবারিত যাওয়া-আসা। ঘরের ভেতরে মেঘ ঢুকে যায় যখন-তখন। দরজা খুলে হাত বাড়ালেই মেঘের স্পর্শ পাওয়া যায়। পুরো শরীরে শীতল আবেশ ছড়িয়ে দিয়ে যায় মেঘের দল। দেখলে মনে হবে যেন গ্রামটি মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছে। সারা বছরই মেঘের সঙ্গে নিবিড় সান্নিধ্য থাকে এই গ্রামের।

রুমা থেকে চাঁদের গাড়িতে সরাসরি পৌঁছে যাওয়া যায় কেওক্রাডংয়ে। সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। কেওক্রাডং থেকে মাত্র ১০০ ফুট নিচে নামলেই দেখা মিলবে এই অনিন্দ্য সুন্দর গ্রামের। পাহাড়ের গ্রাম বা পাড়াগুলোয় একজন পাড়াপ্রধান অর্থাৎ কারবারি থাকেন। পাসিংপাড়ার কারবারির নাম পাসিং ম্রো। তার নামেই গ্রামটির নামকরণ করা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের স্মার্ট কারবারির মধ্যে তিনি অন্যতম। তার সুঠাম দেহ, সুদর্শন মুখাবয়ব জুড়ে যেন ঠিকড়ে পড়ে তার ব্যক্তিত্ব। এ গ্রামের বাসিন্দারা ম্রো এবং বম সম্প্রদায়ের। ৫০-৬০টি পরিবার বাস করে এখানে। যোগাযোগের সহজলভ্যতার দরুণ এ গ্রামে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়, যা বেশির ভাগ পাহাড়ি গ্রামেই থাকে না।

পাসিংপাড়া খুব পরিচ্ছন্ন একটি গ্রাম। গ্রামে প্রবেশের জন্য বানানো আছে একটি ফটক। প্রবেশদ্বারটি কাঠ-বাঁশ ও বেড়া দিয়ে আটকানো। এ গ্রামের ঘরগুলো বাঁশ, কাঠ এবং টিনের তৈরি। সাধারণত বাঁশ বা কাঠ ব্যবহৃত হয় বেড়া হিসেবে। আর টিন ব্যবহার করা হয় চালা দেওয়ার জন্য। গ্রামটির অবস্থান বেশি ওপরে হওয়ার জন্য এখানে বাতাসের তাণ্ডবও থাকে বেশি। বাতাসের তোড়ে যেন টিনের চালা উড়ে না যায়, তাই ওপরে বাঁশ আড়াআড়ি করে বাঁধা হয়।

এ গ্রামের বাসিন্দারা খুব সহজ-সরল এবং পরিশ্রমী। জীবন ধারণের জন্য এখানকার বাসিন্দারা জুম পদ্ধতিতে চাষ করে থাকেন। এ ছাড়া কেউ কেউ শিকারও করে থাকেন। যখন জুম চাষের মৌসুম শেষ হয়ে যায়, তখন তাদের হাতে অনেক অবসর সময় থাকে। সেই সময় গ্রামের বৃদ্ধ মানুষ শিশু, কিশোর ও তরুণদের বিভিন্ন ধরনের গল্প শুনিয়ে থাকেন। সেসব গল্পে তাদের সমাজের রীতিনীতি ও সংস্কৃতির কথা মিশে থাকে।

উচ্চতা বেশি হওয়ার দরুণ এ গ্রামের বাসিন্দারা পানির সংকটে ভোগেন। পানির জন্য তাদের প্রায় দুই হাজার ফুট নিচে নামতে হয়। সেখানের ঝিরি থেকে পানি সংগ্রহ করে থাকেন তারা। আসলে পাহাড়ি জীবন প্রাকৃতিকভাবে যত সুন্দর, জীবন ধারণের জন্য তা ততটাই কঠিন।

এ গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে একটি রাস্তা। তার দুই পাশ জুড়ে রয়েছে ঘরবাড়ি। পাড়ায় দুটি চার্চ আছে। একটি চার্চ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। আরেকটি চার্চে প্রতি রবিবার ধর্মীয় সমাবেশ ও প্রতি সন্ধ্যায় প্রার্থনা হয়। পাড়ায় বোর্ডিংসহ একটি স্কুল আছে। স্কুলটির নাম ‘মডার্ন স্কুল’। স্কুলটিতে ১০০-এর বেশি শিশু পড়াশোনা করে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে। দূরের পাহাড় থেকে শিশুরা এসে বোর্ডিংয়ে থেকে পড়াশোনা করে।

স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য পাহাড়ি গ্রামের মতো তাদের ওখানেও কোনো হাসপাতাল বা চিকিৎসাব্যবস্থা নেই। চিকিৎসার প্রয়োজনে তাদের যেতে হয় রুমা বাজারে। এ গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। তবে সব ঘরেই সোলার আছে। গ্রামের বাসিন্দারা বাংলা ভালো বোঝে, এমনকি বাংলা ভাষায় কথাও বলতে পারে। পাহাড়ের অনেক গ্রামেই পর্যটক বা বাঙালিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। কিন্তু পাসিংপাড়ায় যাওয়ার অনুমতি সহজেই রুমা গ্যারিসন থেকে পাওয়া যায়। তবে কখনো কখনো নিরাপত্তার কারণে সেখানে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

কলি

আত্মভোলা ছিলেন আইনস্টাইন

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ০১:৫১ পিএম
আত্মভোলা ছিলেন আইনস্টাইন

১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ, জার্মানির ছোট শহর উল্মে জন্মগ্রহণ করেন নোবেল পুরস্কার জয়ী পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন। তার বাবার নাম হারম্যান এবং মায়ের নাম পাউলিন। সে সময় আলবার্টের বাবা হারম্যান একটা চাকরি করতেন, কিন্তু অচিরেই চাকরি খুইয়ে তাদের চলে যেতে হয় মিউনিখ শহরে, যেখানে আইনস্টাইনের একমাত্র ছোট বোন মারিয়ার জন্ম। মিউনিখেই কেটেছে আইনস্টাইনের ছোটবেলা।

ছয় বছর বয়সে মিউনিখে একটি স্কুলে যেতে শুরু করেন আলবার্ট। ঠিকমতো কথা বলতে না পারার কারণে ক্লাসে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে থাকেন তিনি।

বলাই বাহুল্য, বিশ্বজুড়ে সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য নাম হিসেবে আইনস্টাইনের তুলনা নেই। খুব কম মানুষই আছেন যারা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র ও ভর-শক্তি সমতুল্যতার সূত্র (ই=এমসি স্কয়ার) সম্পর্কে জানেন না। তবে আইনস্টাইন প্রতিভাবান হলেও তিনি ছিলেন আত্মভোলা। উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা বলা যায়। এক দিন আইনস্টাইন ট্রেনে করে যাচ্ছেন। টিকিট চেকার এসে সবার কাছে টিকিট চাইছেন। আইনস্টাইন ভড়কে গেলেন, এ পকেট হাতড়ান-ও পকেট হাতড়ান, কিন্তু কিছুতেই টিকিট খুঁজে পাচ্ছেন না। কী বিতিকিচ্ছি অবস্থা। টিকিট চেকার তার অবস্থা বুঝে হেসে বললেন, স্যার, আপনাকে আমরা সবাই চিনি, কোনো চিন্তা করবেন না, আপনাকে টিকিট দেখাতে হবে না, আপনি টিকিট কিনে তবেই ট্রেনে উঠবেন তা আমরা সবাই জানি। নিশ্চিন্ত থাকুন, স্যার। আইনস্টাইন কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, তা তো সমস্যা না ভাই, সমস্যাটা হলো অন্য জায়গায়। আমি কোন স্টেশনে যাচ্ছি তাই তো ভুলে গেছি, ওটা তো টিকিটে লেখা ছিল।

ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন আইনস্টাইন
আইনস্টাইন ইসরায়েলের নাগরিক না হওয়া সত্ত্বেও দেশটির প্রথম নেতা চেইম ওয়েজমানের মৃত্যুর পর তাকে এ পদে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তিনি এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ হিসেবে জানান, তার এই পদ ধারণের যোগ্যতা, ইচ্ছা কিংবা ধৈর্য— কোনোটিই নেই।

এফবিআইয়ের নজরদারিতে ছিলেন আইনস্টাইন
বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে সমর্থনের কারণে ১৯৩২ সালের ডিসেম্বর থেকে আইনস্টাইনকে নজরদারিতে রাখে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে আইনস্টাইন ছিলেন সোচ্চার। আর তাই তারা বিশ্বাস করতেন আইনস্টাইন একজন সমাজতান্ত্রিক অথবা বিদ্রোহী মানসিকতার মানুষ। ফলে তাকে এফবিআই বিপজ্জনক মানুষ হিসেবে বিবেচনা করত। আইনস্টাইনের নামে তৈরি করা প্রতিবেদনে পৃষ্ঠার সংখ্যা ১ হাজার ৪০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল ৭৬ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে এই মহাপ্রতিভাবান ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেন।

সূত্র: উইকিপিডিয়া, রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট

কলি 

কাজী নজরুল ইসলামের মজার ঘটনা

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ০১:৪৩ পিএম
কাজী নজরুল ইসলামের মজার ঘটনা

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কবি, সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। ২৪ মে ১৮৯৯ সালে তিনি ভারতের চুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। কবি ছিলেন অনেকটাই মজার মানুষ। তার জীবদ্দশায় তিনি অনেক মজার ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন। সেগুলোর কিছু অংশ নিচে তুলে ধরা হলো-

একবার কবি নজরুল গেছেন সিরাজগঞ্জে সাহিত্যিক আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর বাসায়। খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে দই দেওয়া হলো। কিন্তু সে দই খানিকটা নষ্ট হয়ে টক হয়ে গিয়েছিল। হয়তো দই একটু আগেভাগেই নিয়ে আসাতে এরকম হয়েছিল। তো সেই দই খেয়ে নজরুল আসাদউদ্দৌলার দিকে তাকিয়ে চোখে-মুখে অদ্ভুত ভঙ্গি করে বললেন, ‘তুমি কি এই দই তেঁতুল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি?’ কবির এমন কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসেই খুন!

নজরুলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল কিছু হিউমার ছিল। তিনি Aristocrate-এর বাংলা করেছিলেন, ‘আড়ষ্টকাক!’ যারা বক্তৃতা দিতে ভালোবাসতেন তাদের বলতেন, ‘বখতিয়ার খিলজী’, কোনো কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে তিনি বলতেন, ‘জানে দেও কন্ডাক্টর’। কবি নজরুল fun এবং পান-এ সমান অভ্যস্ত ছিলেন। তার একটি বিখ্যাত পানপাত্র ছিল (যেটাকে তিনি নিজেই ‘পানের সিন্দুক’ আখ্যা দিয়েছিলেন)। এই পানপাত্রে এক শ পান থাকত। লিখতে লিখতে মাঝে মাঝে একসঙ্গে তিন-চারটা পান মুখে পুরতেন আর পিকদানিতে পানের পিক ফেলতেন। এই পান নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। একবার এক ভদ্রমহিলা নজরুলের পান খাওয়া দেখে তাকে খুব স্মার্টলি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা আপনি কি পানাসক্ত?’ নজরুল বললেন, ‘জি না, আমি বেশ্যাসক্ত!’ নজরুলের এমন উত্তর শুনে ভদ্রমহিলার মুখ কালো হয়ে গেল। পরে নজরুল ব্যাখ্যা করলেন, ‘পান একটু বেশি খাই তাই বেশ্যাসক্ত, অর্থাৎ বেশি+আসক্ত=বেশ্যাসক্ত!’

একবার গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ডে গান দিতে এলেন এক লোক। লোকটিকে নজরুলের কাছে পাঠানো হলো তার গানের দৌড় পরীক্ষা করার জন্য। লোকটি হারমোনিয়াম নিয়ে কবির সামনে বসলেন এবং গান শুরু না করে কথা শুরু করলেন। কার কাছে গান শিখেছেন, কবে তার গান শুনে কে প্রশংসা করেছে, তিনি কতখানি পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইত্যাদি। মাঝে একবার কবিকে জিজ্ঞাসা করেই বসলেন, ‘আপনি কি ধানশ্রী ভৈরবী রাগের গান শুনেছেন? শোনেননি বোধহয়। খুব রেয়ার। কেবল আমার কাছেই আছে।’ এভাবে লোকটি গান না গেয়ে বকবক করেই যাচ্ছিল। নজরুল তখন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি তো দেখছি একটি জানোয়ার লোক।’ ‘কী বললেন?’ ভদ্রলোকটি নজরুলের কথায় বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। নজরুল বললেন, “না না অন্য কিছু মনে করবেন না, দেখলাম আপনি অনেক কিছু জানেন, তাই আপনার সম্বন্ধে ‘জানোয়ার’ শব্দটি প্রয়োগ করেছি!” লোকটি হাঁ করে বসে রইল।

প্রতিবেশীর মেয়ের আকিকা। বিশাল আয়োজন। বাড়িভর্তি লোকজনের আনাগোনা, আনন্দ-ফুর্তি। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি দেখে তিনি অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন। প্রতিবেশীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন রোগা-পটকা এক ঘোড়ার পিঠে বিদঘুটে চেহারার এক লোককে বসিয়ে। লোকটি দেখতেই শুধু বিদঘুটে নয়, তার পোশাকও অদ্ভুত— শতেক ছেঁড়া, ধুলাবালু মাখা। মুখভর্তি গোঁফদাড়ির জঙ্গল। 

নজরুল বাড়ির গিন্নিকে ডেকে বললেন, ‘মাইজি, তোমার মেয়ের জন্য বর এনেছি। পছন্দ হয়নি?’

বাড়ির গিন্নি নজরুলের এমন রসিকতার কারণ বুঝতে পেরে বললেন, ‘আমি তো বাপু ভেবে রেখেছি তোমার সঙ্গেই আমার মেয়ের বিয়ে দেব।’

বাড়িভর্তি মানুষের সামনে হঠাৎ উল্টো প্রস্তাব পেয়ে কিশোর নজরুলের চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ঘোড়াসহ ওই বিদঘুটে লোকটিকে রেখেই দ্রুত চম্পট দিলেন সেখান থেকে।

অসামান্য প্রতিভাবান কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন ইসলামি হামদ, নাত, গজল রচনা শুরু করলেন, তখনকার একটি ঘটনা। শিল্পী আব্বাসউদ্দিন এক দিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে নজরুলকে না পেয়ে সকালে তার বাসায় চলে গেলেন। বাসায় গিয়ে দেখলেন নজরুল গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছেন। নজরুল ইশারায় আব্বাসউদ্দিনকে বসতে বললেন। আব্বাসউদ্দিন অনেকক্ষণ বসে থাকার পর জোহরের নামাজের সময় হলে তিনি উসখুস করতে লাগলেন। 

নজরুল বললেন, ‘কী, তাড়া আছে, যেতে হবে?’ আব্বাসউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক তাড়া নেই, তবে আমার জোহরের নামাজ পড়তে হবে। আর এসেছি একটা ইসলামি গজল নেবার জন্য। গজল না নিয়ে আজ যাওয়া হচ্ছে না।’ (নজরুলকে যেহেতু বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে পাওয়া যেত না, তাই সবাই এইভাবে লেখা আদায় করত!)

নামাজ পড়ার কথা শুনে নজরুল তাড়াতাড়ি একটি পরিষ্কার চাদর তার ঘরের আলমারি থেকে বের করে বিছিয়ে দিলেন। এরপর আব্বাসউদ্দিন যথারীতি জোহরের নামাজ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল তার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও তোমার গজল।’ এই গজলটিই হলো—‘হে নামাজি আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ/ দিলাম তোমার চরণ তলে হৃদয় জায়নামাজ...’

সুফিয়া কামাল কাজী নজরুল ইসলামকে ডাকতেন দাদু বলে। কবি আবার প্রায়ই সুফিয়া কামালের বাড়ি যেতেন। সেখানে গানের আসর বসত। সে আসরে সাহিত্য অনুরাগী অনেকেই থাকতেন। এ সময় নজরুলের পেছনে গোয়েন্দা লাগে। সাহিত্য অনুরাগীদের সঙ্গে মিশে কয়েকজন গোয়েন্দাও আসতেন। এক দিন এক ভদ্রলোকের মুখের ওপর নজরুল কবিতা আওড়ালেন, ‘তুমি টিকটিকি জানি ঠিকঠিকই।’ কবিতার ধরন শুনে লোকটি মুখ লাল করে উঠে যেতেই কিশোরী সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে বললেন, ‘দাদু। তুমি একে চিনলে কী করে?’‘গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে।’ নজরুলের উত্তর।

কাজী নজরুল ইসলাম একবার ট্রেনে যাচ্ছিলেন। পাশে সমবয়সী এক ভদ্রলোক হঠাৎ তার উদ্দেশে বললেন, ‘এই শালা, তোর কাছে দিয়াশলাই আছে?’অপরিচিত এক লোকের এমন সম্ভাষণে কবি প্রথমে চমকে উঠলেন, তারপর বিরক্ত। কিন্তু পরক্ষণেই পরিস্থিতি সামলে নিয়ে হেসে পকেট থেকে দিয়াশলাইয়ের বাক্সটা তার মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘লে বে শালা।’

ইটের বদলে পাটকেল খেয়ে অপরিচিত ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘পরিচয়ের একটু পরেই আমরা এই সম্ভাষণেই পৌঁছাতাম। তাই অনেক ভেবে ওখান থেকেই শুরু করেছি। কী, ঠিক করিনি?’

কবি নজরুল তখন থাকেন কৃষ্ণ নগরে। তার বন্ধু মঈনুদ্দীন থাকেন বেচু ঠাকুরের গলিতে কারমাইকেল কলেজের হোস্টেলের পেছনে। তিনি এক দিন দাওয়াত করলেন কবি নজরুলকে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কবিবন্ধু মইনুদ্দীনের বাসায় আয়োজন। খুব আহামরি কিছু নয়, তবে অন্যদিনের চেয়ে ভালো। নজরুল এলেন। সোজা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলেন মঈনুদ্দীনের ঘর।

কবি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিরে?

বন্ধুর উত্তর, রান্নাঘর।

-আর ওটা?

-ওটা হলো পায়খানা।

কবি বলে উঠলেন, ধুর শয়তান! পায়খানা কিরে? বল ‘যায়খানা’। খানা তো ওখান দিয়েই যায় রে!!’ এটুকু বলেই হাসি। সে কী বিরাট প্রাণখোলা হাসি কবির। তার হাসির আওয়াজে জানালার কার্নিশের আড়ালে বসে থাকা কবুতর পাখা মেলে ঝটপট করে উড়ে গেল।

অনেকের হয়তো জানা নেই যে, আমাদের প্রিয় কবি নজরুল কিন্তু নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন। অবাক হলেও কিছু করার নেই, কারণ তিনি ওই নির্বাচনে জয়লাভ করেননি।

১৯২৬ সাল। মাসের নাম নভেম্বর। পূর্ববঙ্গের নির্বাচনে কবি নজরুল কেন্দ্রীয় আইনসভার সভ্যপদপ্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন। শুধু কি তাই, এ নির্বাচনি প্রচারের জন্য তিনি এসেছিলেন ঢাকা, ফরিদপুরসহ কয়েক জায়গায়।

সূত্র: ইন্টারনেট অবলম্বনে

কলি

 

তালা-চাবিতেই জীবন

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪, ০১:৪০ পিএম
তালা-চাবিতেই জীবন
ইচ্ছা থাকলে যেকোনো কাজেই সফলতা সম্ভব। সেই কথাটিই যেন প্রমাণ করেছেন ওমর ফারুক ছবি: লেখক

বাড়ি-গাড়ি, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, দোকানপাটসহ সবকিছুই নিরাপদ রাখার অন্যতম মাধ্যম তালা। তালা নষ্ট হলে কিংবা চাবি হারিয়ে গেলে মানুষকে পড়তে হয় চরম বিড়ম্বনায়। প্রয়োজন পড়ে তালা মেরামত কিংবা নতুন চাবি তৈরির। তালা মেরামত আর নতুন চাবি বানানোর কাজ শিখেই সংসার চালাতেন একশ্রেণির কারিগর। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়নে হারিয়ে যাচ্ছে চাবি তৈরি ও তালা মেরামতের কাজ। তাই ভালো নেই তালা-চাবির কারিগররা। অনেকেই এ পেশা পরিবর্তন করেছেন। তবে ওমর ফারুক অন্যদের মতো হারিয়ে যাননি। প্রযুক্তির কল্যাণে নিজেকেও করেছেন পরিবর্তন। প্যাড তালা মেরামতের মাধ্যমে এ পেশায় এলেও বর্তমানে ওমর ফারুক বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোবাসের তালা মেরামত করেন। সেখানে তিনি ডিজিটাল মেশিন ও সফটওয়্যারের মাধ্যমেই বেশির ভাগ কাজ করেন।

গ্রাম থেকে ১৯৯৮ সালে পরিবারের সঙ্গে ঢাকার খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকায় আসেন ওমর ফারুক। সংসার চালানোর জন্য পরিবারের অন্য সদস্যরা চাকরি বা কোনো কাজ করা শুরু করেন। ঢাকায় আসার পর দূরসম্পর্কের এক মামার সঙ্গে পরিচয় হয় ওমর ফারুকের। এরপর ২০০১ সালে তাদের তালা-চাবি মেরামতের দোকানে কাজে যুক্ত হন। কিশোর বয়সেই পড়াশোনার পাশাপাশি তালা-চাবি মেরামতের কাজ শিখতেন তিনি। এরপর কয়েক বছর কাজ শেখার পর তিনি গ্রামে ফিরে যান। মাঝখানে বিরতি দিয়ে ২০১২ সালের দিকে ঢাকায় ফিরে অন্যজনের দোকানে আবারও তালা-চাবি মেরামতের কাজে যুক্ত হন। সেই দোকানে কাজ শেখার অবস্থায় তিনি চিন্তা করেন, নিজের একটা দোকান হলে অনেক ভালো হতো।

সেই চিন্তা থেকে ২০১৪ সালের দিকে নিজেই একটা দোকান দেন। সেই সময়ে তিনি প্যাড তালা মেরামতের কাজ দিয়ে দোকান চালু করেন। তবে কয়েক বছর কাজ করার পর দেখেন, উন্নত প্রযুক্তির ডিজিটালসহ বিভিন্ন ধরনের তালা-চাবি বাজারে এসেছে। এগুলো বেশ টেকসই। ফলে পুরাতন তালা-চাবি মেরামত করতে তেমন কেউ আর আসেন না। এতে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। এসব দেখে ওমর হতাশ হলেও ভেঙে না পড়ে তিনিও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছু করার চিন্তা করেন। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তালা-চাবি মেরামতের প্রযুক্তিভিত্তিক কাজ শেখার বিদেশি অনলাইন কোর্সের খোঁজ পান তিনি। যেখানে তারা ডিজিটাল মেশিন ও সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোবাসের তালা-চাবি মেরামতের কাজ শেখান। তিনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব কাজ শিখে নেন। তবে এ কাজ শিখতে ওমরকে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হয়েছে।

এরপর ডিজিটাল মেশিন ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মাইক্রো-মাইক্রোবাসের তালা-চাবি মেরামতের কাজ শুরু করেন ওমর। ধীরে ধীরে তার সেই কাজের সুফল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বাড়তে থাকে তার কাজ। বর্তমানে শুধু ওমর নিজের দোকানেই নয়, ঢাকার বিভিন্ন গাড়ির শোরুম ও গ্যারেজে গিয়ে কাজ করে থাকেন। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েও এসব কাজ করেন। এতে বর্তমানে এ কাজের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা আয় করেন ওমর। মা-বাবা, ভাইবোন ও স্ত্রী এবং দুই সন্তানসহ ১০ সদস্যের পরিবার তার। এ উপার্জন দিয়ে বর্তমানে সচ্ছলভাবে চলছে ওমরের সংসার।

অন্যদিকে, আরও একটি নতুন দোকান দিয়েছেন ওমর ফারুক। যেখানে দুজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। সেই দোকানে তারা প্যাড তালা-চাবি মেরামতের কাজ করেন। একই সঙ্গে তাদেরকেও মাইক্রোবাসের তালা-চাবি মেরামতের কাজও শেখাচ্ছেন ওমর ফারুক।

হতাশা নিয়ে অনেকেই এ পেশা থেকে দিন দিন সরে যাচ্ছেন এবং এর মাঝে কীভাবে আপনি টিকে আছেন?- এমন প্রশ্নের জবাবে ওমর ফারুক বলেন, বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে সব তালা-চাবির ধরন বদলেছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট, কি-কার্ডস, কোড সংমিশ্রণ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সব তালা-চাবি ব্যবহৃত হচ্ছে শহরের প্রতিটি বাড়িতে। তাই কদর কমেছে এসব এনালগ তালা-চাবির মিস্ত্রিদের। তার ওপর আবার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সব মিলিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হয় এ পেশার মানুষকে। তাই অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন।

এ পরিস্থিতি দেখে আমি একদম হতাশ হয়ে যাই। কিন্তু হেরে না গিয়ে এ পেশাতেই নতুন কিছু করার চিন্তা করি। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদেশি অনলাইন কোর্সের খোঁজ পাই। তারা ডিজিটাল মেশিন ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোবাসের তালা মেরামতের কাজ শেখায়। আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব কাজ শিখি।

ওমর ফারুক বলেন, বর্তমানে প্রযুক্তিভিত্তিক কাজ শিখে প্রতি মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা ইনকাম করছি। কাজ বেশি হলে ইনকামও বেশি হয়। আল্লাহর রহমতে পরিবার নিয়ে বর্তমানে ভালোভাবেই চলতে পারছি।