মমি নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। হাজার হাজার বছর পেরিয়ে এসেও মিসরীয়দের এই বিচিত্র ও আশ্চর্যজনক রীতি আজও মানুষকে ভাবায়। বিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা করছে মমি নিয়ে। ফলে মমি নিয়ে একাধিক রহস্যের পরত খুলছে ধীরে ধীরে।
অবাক শোনা গেলেও সত্যি যে, মিসরে একটা সময় মমি বিক্রি করা হতো ফুটপাতে। খ্রিষ্টীয় উনিশ শতকে ধনী ইউরোপিয়ান এবং আমেরিকান ভ্রমণার্থীদের কাছে ‘ভ্রমণ স্মারক’ (tourist souvenir) রূপে ‘মমি’ বিক্রি মিসরের প্রায় সব জায়গায় হতো এবং এটি খুবই সাধারণ বিষয় ছিল। ফুটপাতে বা খোলা বাজারে মমি বিক্রি করা হতো মিসর ভ্রমণকারীদের জন্য, যাতে তারা এগুলো নিজেদের দেশে, নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন।
ভিক্টোরিয়ান যুগে, ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের মিসর বিজয়, ইউরোপ ও ইউরোপিয়ানদের কাছে মিসর এবং মিসরের ইতিহাসের বন্ধ থাকা দরজা খুলে দিয়েছিল। সেই সময়ে ইউরোপিয়ান এলিট সমাজে মমিকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হতো না।
উনিশ শতকে ধনীরা মিসরের বাজার থেকে মমি কিনে নিয়ে গিয়ে রীতিমতো পার্টির আয়োজন করতেন। তার নাম ছিল ‘মমি আনর্যাপিং পার্টি’। কী হতো সেই পার্টিতে? উৎসুক জনতা উপস্থিত থাকতেন। তাদের সামনে খুলে ফেলা হতো মমিতে জড়ানো রাসায়নিক মেশানো কাপড়।
লোকজন হামলে পড়ে দেখতেন, কী রয়েছে সেই মোড়কের আড়ালে। হাততালিতে ফেটে পড়তেন। অনেকেই আশা করতেন, যদি দামি ধাতু বা পাথর উদ্ধার হয়। এর সঙ্গে চলত খাওয়া-দাওয়া এবং তুমুল হইহুল্লোড়।
মমি নিয়ে আরও কাণ্ড হতো সে সময়। নানা কাজেও ব্যবহার করা হতো মমি। উনিশ শতকে পিরামিড খুঁড়ে প্রায়ই এক-আধটা মমি বার করতেন মিসরীয়রা। সেই মমি গুঁড়া করা হতো। সেই গুঁড়া ওষুধ হিসেবে খাওয়ার রীতি ছিল।
এই মমি গুঁড়ার ব্যবসা গজিয়ে উঠেছিল অষ্টাদশ, উনিশ শতকে। শোনা যায়, বিদেশেও নাকি রপ্তানি করা হতো মমি গুঁড়া। মানুষের ধারণা ছিল, এই গুঁড়া খেলে শরীরের সব রোগ চলে যাবে। একটা সময় মমি গুঁড়ার চাহিদা এতটাই বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে, জোগান কমে যাচ্ছিল। কিছু অসাধু লোক এই সুযোগে ব্যবসা শুরু করেন। ভবঘুরেদের মেরে সেই মাংস শুকিয়েও মমির গুঁড়া বলে বিক্রি করতেন বলে শোনা যায়।
ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে মিসর থেকে কিনে নিয়ে যাওয়া মমির অন্য ব্যবহার হওয়াও শুরু হলো। মিসর থেকে জাহাজ ভরে মানুষ ও পশুর মমি ব্রিটেন ও জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া হতো, সেখানে সেগুলো জমির সার রূপে ব্যবহার করা হতো। মমির শরীর থেকে ব্যান্ডেজ খুলে, সেই ব্যান্ডেজ আমেরিকায় পাঠানো হতো, সেখানে সেগুলো কাগজ তৈরির জন্য ব্যবহৃত হতো। বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়াইন তার মিসর ভ্রমণের ডায়েরিতে লিখে গেছেন যে, মিসরে মমিকে লোকোমোটিভের জ্বালানি রূপেও ব্যবহার করা হতো।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষে একদল মানুষ বুঝতে পারেন এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব। আর তখন থেকেই ভাগ্য বদলাতে শুরু করে মমিদের। তবে তার আগেই অবশ্য মমি সাম্রাজ্য প্রায় উজাড় হয়ে গেছে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষে ইউরোপ, আমেরিকার গণ্যমান্যরা মিসর থেকে মমি কিনতে শুরু করেন। তারপর সেগুলোকে দেশে নিয়ে গিয়ে সাজিয়ে রাখতেন নিজেদের বসার ঘরে। এতে সামাজিক মানমর্যাদা বাড়ত তাদের। যারা আবার একটা আস্ত মমি কিনতে পারতেন না বা পেতেন না, তারা চোরা বাজার থেকে মমির শরীরের বিভিন্ন অংশ যেমন- মাথা বা পা বা হাত কিনে নিয়ে নিজের দেশে নিয়ে যেতেন।
মমির জন্য মিসরের ছোট-বড় কোনো পিরামিডই ধনী ইউরোপীয় এবং মার্কিনদের লোভের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। কেবলমাত্র যে পিরামিডগুলোর দরজা কোনোভাবেই খোলা সম্ভব হয়নি বা যে পিরামিডগুলোয় অজানা মৃত্যু ফাঁদ ছিল, সেগুলোই লুটের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এটাও উল্লেখ্য যে, মমির সঙ্গে পিরামিডের ভেতরে থাকা বিপুল ঐশ্বর্য এবং জিনিসপত্রও যথেচ্ছভাবে লুট করে ইউরোপ ও মার্কিন মুলুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এই ব্যবসাতেও অবশ্য জালিয়াতি ছিল। ছিল জাল মমির উৎপাত। বিচারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামির দেহ, বয়স্ক মানুষের মরদেহ, গরিব মানুষের দেহ এবং যারা কোনো জটিল রোগে মারা গেছেন তাদের দেহ ক্রয় করে, সেই দেহ একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মরুভূমির তপ্ত বালুতে পুঁতে রেখে বা বিটুমিন দিয়ে স্টাফ করে, সেগুলোকে ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়িয়ে তারপর আবার চড়া রোদে শুকিয়ে প্রাচীন মমি বলে ধনী বিদেশিদের কাছে চড়া মূল্যে বিক্রি করা হতো।
কৃত্রিমভাবে তৈরি এই মমির রং হতো খয়েরি রঙের। এগুলোকে মমি ব্রাউনও বলা হতো। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুনিয়ার সংগ্রহশালায় থাকা অনেক মমিই আসলে ষোড়শ, সপ্তদশ শতকে বা তারও পরে তৈরি করা হয়েছে।
বিশ শতকে এসে এই মমি তৈরি বন্ধ করে কালোবাজারিরা। কারণ তত দিনে মিসরে মমির ভাণ্ডার প্রায় শেষ। ফলে লোক ঠকিয়ে আর কৃত্রিম মমি বিক্রি করা যাচ্ছিল না।
সূত্র: রেয়ার হিস্টোরিক্যাল ফটোজ ও স্মিথসোনিয়ান
কলি