![শিউলি ফুল](uploads/2024/04/20/1713603184.b-ja-vgk.jpg)
শীতের শুরুর দিকের কথা। বিজয় সরণির সিগন্যালে আমাদের গাড়ি থামল। ঠিক এ সময় এক কিশোরী হাতে ফুলের মালা নিয়ে এসে দাঁড়াল। জানালা নামাতেই বলল, ‘স্যার একটা মালা নেন না, খুব ভালো গন্ধ।’
কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘না, লাগবে না।’
লক্ষ করলাম, মেয়েটি এত শীতেও কোনো শীতের পোশাক পরেনি। মুখটা মলিন, চুল উশকোখুশকো। গালে, ঠোঁটে শীতের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
মেয়েটির বয়স বড়জোর ১২/১৩। গায়ের জামা মলিন আর ছেঁড়া।
মেয়েটি অনুনয়-বিনয় করতে লাগল। বলল, ‘স্যার নেন, এই টাকা দিয়া ওষুধ কিনব, মায়ের খুব অসুখ।’
প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইনি, পরে বারবার বলাতে মায়া হতে লাগল। কথায় কথায় জানলাম, ওর মায়ের কিছুদিন ধরে জ্বর। ওদের বাসা রাস্তার ওপারেই বস্তিতে। কী মনে করে গাড়ি থেকে নেমে ওর বাসায় গেলাম। লক্ষ করলাম, একটা মানুষ চৌকিতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। বুঝলাম তিনি বেশ অসুস্থ।
জানলাম, মেয়েটির নাম শিউলি। তার অনেক পড়াশোনার ইচ্ছে। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে পড়তে পারে না। ফুল বিক্রি করেই তাকে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা আর সংসারের খরচ চালাতে হয়।
মেয়েটির মাকে কথা দিলাম, ওর পড়াশোনার দায়িত্ব আমি নেব। এখন থেকে প্রতি মাসে ড্রাইভারকে দিয়ে টাকা পাঠিয়ে দেব, যা দিয়ে ওর পড়াশোনা আর সংসারের যাবতীয় খরচ চলবে।
পরে সময়মতো টাকা পাঠিয়েছি, মাঝে মাঝে পড়ালেখার খবর নিয়েছি ফোন করে। এভাবেই চলছিল। পরে ব্যস্ততায় খুব একটা খোঁজ নিতে পারিনি। কিন্তু টাকা যেন নিয়মমাফিক পায়, তার বন্দোবস্ত করে রেখেছিলাম।
এরই মাঝে কয়েকটা বছর পার হয়ে গেছে। সময়-পরিক্রমায় শিউলির স্মৃতি বিস্মৃতপ্রায়। কারণ এতগুলো বছর তো আর কম সময় নয়, একটা মানুষকে ভুলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেদিন সন্ধ্যার আগে চন্দ্রিমা উদ্যানে হাঁটতে বেরিয়েছি। হাঁটা শেষে যখন ফিরছি, চন্দ্রিমা উদ্যানের শেষ মাথায় আলো-আঁধারির মাঝে ১৬/১৭ বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই নিবি?’ বোকার মতো বললাম, ‘আমাকে বলছেন?’
মেয়েটি বলল-‘তোকে না তো কাকে?’ মেয়েটির দিকে ভালোভাবে চাইলাম, কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। হঠাৎ অস্ফুটে বলে উঠলাম, ‘তুমি শিউলি না?’ আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটির হাসি থেমে গেল। রাগত স্বরে বলল, ‘আমি শিউলি না, শেফালি তাতে তোর কী? লাগবে কি না বল?’ অবাক হয়ে বললাম, ‘তুমি আর পড়ালেখা চালিয়ে যাওনি? তোমার মা কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছিলেন!’
মেয়েটি মনে হলো এবার আমাকে চিনতে পেরেছে। ঝাঁজের সঙ্গে বলল- ‘কীসের মা, কীসের পড়ালেখা! ওই বেটি আমার মা ছিল না, আমারে খালি পালছে আর বিক্রি কইরা দিছে।’ হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘তাই বলে তুমি এসব করছো?’ সে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আমাকে বলল, ‘স্যার, আমাগো কোনো পড়ালেখা নাই, কোনো সমাজ নাই, কোনো নাম নাই। ভাতের লাইগা আমরা কোনোদিন শেফালি, শিউলি; আবার কোনোদিন টগর হইয়া যাই। আমরা যে মানুষ, হেইডাই তো কেউ মনে করে না, আপনারাও না।’
অদূরে দাঁড়ানো একটি ছেলে সিটি দিয়ে শিউলিকে ইশারায় ডাকল। অমনি মুখ বেঁকিয়ে সেই ছেলেটির দিকে সে এগিয়ে যেতে লাগল আর আমি নিথর হয়ে ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। রাষ্ট্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না করতে পারায় কত শিউলি অকালে ঝরে যায় তার ইয়ত্তা নেই, ঠিক যেন শিউলি ফুলের মতো ক্ষণজন্মা হয়ে জন্মে এরা। শিউলিদের জন্য কারও মাথাব্যথা নেই- এরা মরে গেলেই কী, বেঁচে থাকলেই বা কী? এতে পৃথিবীর বিন্দুমাত্র কিছু যায়-আসে না। পৃথিবীর কাছে এরা শুধুই একটা সংখ্যামাত্র, আর কিছুই না!
আদাবর, ঢাকা
কলি