লম্বা আকৃতির নৌকা। জলজীবিকার শ্রমজীবীরা বালু-পাথর পরিবহন করেন এই বাহনে। সিলেট অঞ্চলে বালু-পাথর-জলমহালে ‘বারকি নাও’ নামের বাহনটির সঙ্গে শ্রমজীবীরাও আলাদা করে সমাদৃত। তাদেরকে বলা হয় বারকি শ্রমিক। আর বারকি বাওয়া কাজটিও তাদের জন্য বাড়তি শ্রম।
বাড়তি শ্রমের ‘বারকি নাও’ ঠিক কোন সময় থেকে জলজীবিকার বাহন হয়ে উঠেছিল? তথ্য-তালাশে জানা যায়, আঠারো শতকের গোড়ার দিকে চুনশিল্প প্রসারের যুগে একটি ছোট্ট ঘটনা বাহনটিকে এই অঞ্চলের শ্রমজীবিকায় অনিবার্য হাতিয়ার করে তুলেছে। শ্রম-দুনিয়ায় বহুল পরিচিত মার্কিন লোকগাথা জন হেনরির কাহিনির মতো না হলেও উদ্ভাবনচিন্তায় গল্পটি অনুপ্রেরণার।
তখন চুনশিল্প বাণিজ্যের স্বর্ণযুগ। ব্রিটিশ শাসনের অধীন এই বাংলায় ব্যবসার সূত্রে দলে দলে ব্রিটিশ নাগরিকরাও আসছিলেন। নানা পেশা, নানা ব্যবসার তালাশ চলে। এর মধ্যে চুনশিল্প বেশ লাভজনক। সিলেটের নৌপথে বড় বড় মালবাহী নৌযান চলত চুন নিয়ে। একজন খুদে ব্যবসায়ীর নাম ছিল জন বারকি। তার কোনো নৌযান ছিল না। বড় বড় নৌযানে অনেক খরচ, সাশ্রয় করতে গিয়ে নিজেই তৈরি করেন সাদাসিধে লম্বাটে নৌকাটি। নদীপথে চুনাপাথর পরিবহন করে নতুন এ নৌকা। এটি নির্মাণের প্রথম কারিগর জন বারকি, প্রথম চালকও তিনি। তার নামেই নৌকাটির নাম হয়ে যায়।
ব্রিটিশ আমলের প্রথম ভাগে ইংরেজরা যখন প্রশাসন সাজায়, তখন বাংলার জলমহাল এলাকায় নৌযানের জন্য একদল নৌ-কারিগর নিয়ে আসেন তারা। সেই দলে ছিলেন সেই কারিগর, জন বারকি। ব্রিটিশ হয়েও ইংরেজ প্রশাসন দলে কাজ করতে অনীহা ছিল তার। শাসকদের হয়ে নয়, সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করতে চান তিনি। স্বাধীনচেতা নৌ-কারিগর জন বারকি পালিয়ে সুনামগঞ্জের লাউড়ের গড় এলাকায় আশ্রয় নেন। জলপথে ঘুরে ঘুরে চুনাপাথর পরিবহনে জাহাজের বিকল্প হিসেবে ছোট্ট একটি নৌকা তৈরি করেন। সেই নৌকাটিই পরবর্তীকালে জলজীবিকার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। সিলেট অঞ্চলে একে ডাকা হয় ‘বারকি নাও’।
জলপথে সেই নৌকার কর্তৃত্ব নিতে জন বারকিকে তাড়িয়ে দেয় শাসকদলের চর-অনুচরের দেশীয় কিছু কুচক্রী। জন বারকি লা-পাত্তা। জলমহাল এলাকা ছেড়ে তিনি চলে গেলেও নৌকাটি টিকে আছে। চলছে প্রায় আড়াই শ বছর ধরে। চাপা পড়া সেই ইতিহাস প্রকাশ পেয়েছে লেখক-সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদীর অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকতায়।
প্রায় ২৫ বছর আগে বারকি নৌকা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনের সূত্র ধরে একটানা ১১ মাসের চেষ্টায় গ্রন্থিত হয়েছে ‘বারকি’-কাহিনি। সিলেট অঞ্চলের জলমহাল তখন লোকমুখে ‘জলতল্লাট’ হিসেবে প্রচারিত ছিল। সেই কথাগাথা উপস্থাপন করে পুরো কাহিনি জলোপাখ্যান হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে সিলেটের প্রথম ‘কালেক্টরেট’ সূত্রপাতের সময়কে বিবেচনায় বারকি নৌকা নিয়ে বিভিন্ন স্থান ও স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে বের হয়েছে বারকি কাহিনি। ‘জলজীবিকার জলোপাখ্যান: বারকি, জন বারকি’ নামে সেই ইতিহাস প্রকাশ করেছে চৈতন্য প্রকাশন।
বইটির আখ্যানে বলা হয়েছে, জন বারকির গল্প সূত্রে হিসাব করলে আড়াই শ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান বারকি নৌকা। প্রথম নির্মাণস্থল ছিল ব্রিটিশ আমলে শিল্পশহর খ্যাত সুরমা নদী তীরের সুনামগঞ্জের ছাতক। নৌকাটি প্রথম চলেছে সুরমা নদী দিয়ে ইছাকলস হয়ে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ ধলাই নদে। এরপর ঝাঁকে ঝাঁকে বারকি চলেছে এবং চলে আসছে লোভাছড়া-জাফলং-ধলাই-চলতি-জাদুকাটা হয়ে সমগ্র সিলেট অঞ্চলে।
জলতল্লাট নামের সিলেট অঞ্চলের জলমহাল এলাকার নিজস্ব সংস্কৃতির একটি অংশ বারকি। নাও-নদীর ঐতিহ্যের সঙ্গী এই বাহনটি সবচেয়ে বেশি চলে সিলেটের গোয়াইনঘাট-কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। বর্ষাকালে লক্ষাধিক বারকি নৌকায় কয়েক লাখ শ্রমিকের জীবিকার সংস্থান হয় এতে।
বারকি-কাহিনি প্রসঙ্গে উজ্জ্বল মেহেদী বলেন, ইঞ্জিনের সঙ্গে লড়ে পৃথিবীর বুকে ইতিহাস হয়ে আছেন জন হেনরি। গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের সেই গল্পের মতো না হলেও বুদ্ধি ও কৌশলের জোরে ব্রিটিশ শ্রমিক-নাগরিক জন বারকির উদ্ভাবনে বারকি নৌকা আমাদের জলজীবিকার নতুন এক কর্ম সূত্রপাতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বহন করছে। এই দেশে যতদিন নদী-জলাভূমি থাকবে, যতদিন শ্রম ও জীবিকা থাকবে, ততদিন টিকে থাকবে বাড়তি শ্রমের বারকি নাও।
সিলেটের মাটি-প্রকৃতি-মানুষ ও শেকড়-ঐতিহ্যে চোখ রাখা স্থপতি রাজন দাশ বারকি-কাহিনি নিয়ে একটি স্থাপত্য-ভাবনা প্রকাশ করেছেন। স্বপ্রণোদিত হয়ে বারকি-স্থাপত্য তৈরি করেছেন তিনি। স্থপতি রাজন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বারকি স্থাপত্যকর্মটির স্থাপনে দরকার উদ্যোক্তার।’ এই স্থাপত্য ভাবনার বাস্তবায়ন করে পর্যটন আকর্ষণে সিলেটে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে একটি ‘নৌকোর জাদুঘর’।