তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চায় ভারত। চীনও তাই চায়। যুক্তরাষ্ট্র চায়, চীনের বেল্ড অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ও গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে নয় (জিডিআই), তার ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) ও কোয়াডে যোগ দিক বাংলাদেশ। বেইজিংয়ের চাওয়া, ঢাকা তার সঙ্গে থাকুক। এ ছাড়া কিছু ইস্যুতে আবার ২-১-এ বিভক্ত এই তিন পরাশক্তি। এ অবস্থায় এই বৃহৎ তিন শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাই এখন বাংলাদেশের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
ভারত ও প্রশান্তমহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট। আবার যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে সরাসরি উপস্থিতি চীন ও ভারত চায় না। এই একটি ইস্যু ছাড়া ভারত-চীনের মধ্যে আর কোনো ঐকমত্য নেই। যদিও এই অঞ্চলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র লড়াইয়ে ভারতের স্বার্থ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্র ইস্যুতে আবার দেশ দুটির মতবিরোধ রয়েছে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় যে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ থাকে, সেটি এক রকম রাখঢাক ছাড়াই সম্প্রতি খোলাসা করেছেন ওয়াশিংটনের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। ঢাকা সফরকালে একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড লু বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অলোচনায় মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটান প্রসঙ্গ থাকে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গও থাকে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারত মহাসাগরে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু তফাৎ থাকা সম্ভব। কারণ ভারত মহাসাগরে ভারত চাইবে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের অ্যালাইন হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক সেটা না-ও চাইতে পারে। আর কোয়াড তো পুরোপুরিই একটি চীনবিরোধী জোট।’
তিস্তা প্রকল্প নিয়ে নয়াদিল্লি-বেইজিং দ্বৈরথ
ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি শেষ পর্যন্ত না হওয়ায় বাংলাদেশ চাইছে উত্তরাঞ্চলের বিশাল অংশের মরূকরণ ঠেকাতে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হলো বর্ষার পানি ধরে রেখে সারা বছর সেচকাজ করা। যেহেতু ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তির সুরাহা হচ্ছিল না, তাই প্রকল্পে অর্থায়ন করতে এগিয়ে আসে চীন।
চীন ইতোমধ্যে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। বেইজিংয়ের অভিযোগ, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর থেকেই ঢাকা তার মনোভাব বদলাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে তখন ক্ষোভও প্রকাশ করেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিনি একরকম হুমকি দিয়ে ঢাকা ছেড়েছিলেন এই বলে যে, ভূরাজনীতির দোহাই দিয়ে বা তৃতীয় কোনো দেশের চাপে যদি বাংলাদেশ তিস্তা প্রকল্প থেকে সরে আসে তা হলে তা ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তারপর থেকেই তিস্তা চুক্তি নিয়ে এক ধরনের নীরবতাই দেখাচ্ছিল ঢাকা। চীন আশা করে আছে, তারা চুক্তিটি বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু সম্প্রতি চীনের জন্য একটি হতাশাজনক ঘটনা ঘটেছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা ঢাকায় এসে তিস্তা প্রকল্পে ভারতের অর্থায়নের প্রস্তাব দেন। এর পরপরই ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রথম প্রতিবেদনটি ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সফরের ঠিক আগে, অন্যটি সফরের পরে।
প্রথম প্রতিবেদনের শিরোনাম-‘কার কোর্টে যাবে বল? তিস্তা ঘিরে বাংলাদেশের প্রজেক্ট প্রাপ্তির দৌড়ে ভারত-চীন, টক্কর জোরদার।’ এরপর ঢাকা-দিল্লি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর পত্রিকাটি ‘তিস্তা প্রজেক্টে আগ্রহী ভারত, লোলুপ দৃষ্টি চীনের! তারই মাঝে দিল্লি-ঢাকা বৈঠক, কী উঠে এল?’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে চীনের প্রস্তাবের কী হবে এমন প্রশ্ন করা হলে কৌশলী জবাব দিয়ে বলেন, ‘বৈঠকে ভারতের প্রস্তাব নিয়ে কথা হয়েছে। অন্য কোনো বিষয় নয়।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চীন সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। কিন্তু এখানে চীনের সঙ্গে ভারত বা অন্য যেকেউ তিস্তা প্রকল্পে যুক্ত হতে পারে। আসল বিষয় হলো তিস্তা প্রকল্পটি হওয়া দরকার।’
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীন ও ভারতের মুখোমুখি অবস্থান বেশ আগে থেকেই। চীন আশা করেছিল নির্বাচনের পরে তিস্তার প্রকল্পের কাজ শুরু করবে। সেটা এখনো হয়নি।’
চীনের বিআরআই-জিডিআইয়ের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের কোয়াড-আইপিএস
চীন বিশ্বব্যাপী দুটি উদ্যোগ নিয়ে এগোচ্ছে-বিআরআই ও জিডিআই। চীন তার বাণিজ্য সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে বিআরআই উদ্যোগ শুরু করেছে। ওই উদ্যোগের সঙ্গে বিভিন্ন দেশকে যুক্ত করছে দেশটি। আর জিডিআই হলো চীনের আরেকটি উদ্যোগ যেটি করোনার পরে নেওয়া হয়। জিডিআইতে চীন অন্য দেশগুলোর উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা ও তা বাস্তবায়নে সম্ভাব্য সহযোগিতার সুযোগকে স্বীকৃতি দেয়।
শতাধিক দেশ ও সংস্থা এরই মধ্যে চীনের জিডিআই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। চীন চায় বাংলাদেশও জিডিআইতে যোগ দিক। এ জন্য গত বছরের মাঝামাঝিতে চীনের ভাইস মিনিস্টার সান ওয়াইডং ঢাকায় আসেন এবং তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে প্রস্তাবও দেন। বৈঠক শেষে ড. মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনারা এ-সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র দিয়ে গেছেন। আমরা বলেছি এগুলো আগে আমরা পড়ি। তারপর তোমাদের সঙ্গে কথা বলব।’
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ আইপিএসে যোগ দিক। আইপিএস হলো যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তাবিষয়ক কৌশল। আরেকটি হলো কোয়াড। কোয়াড অর্থ চতুর্ভুজ এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান এই জোটের সদস্য। কোয়াডকে এশিয়ার ন্যাটো বলা হয় এবং এতে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের ওপর ব্যাপক চাপ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
এমন অবস্থায় চীন রীতিমতো হুমকি দিয়ে ঢাকাকে বলেছিল, কোয়াডে যোগ দিলে ভালো হবে না। তখন ঢাকাও কোয়াডে যোগ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বেইজংকে ‘প্রকাশ্যে এভাবে কথা না বলে জেনে নিতে পারত’ বলে এক ধরনের ভর্ৎসনাও করে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশ কখনোই বলেনি যে তারা কোয়াডে যোগদান করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চাইছিল আমরা যেন যোগদান করি। সেখানে চীন তার মনোভাব ব্যক্ত করেছিল যে, যদি বাংলাদেশ কোয়াডে যোগদান করে তাহলে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে তাদের এভাবে বলা উচিত হয়েছে কি না সেটা একটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু বক্তব্যের ব্যাপারে তো দ্বিমত করার সুযোগ নেই।’
বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরিবর্তন
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বরাবরই বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে ভারতকে দিয়ে তার নীতি বাস্তবায়ন করে। এই অঞ্চলকে তারা ভারতের চোখে দেখে। তবে এবার মনে হয় পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এই অঞ্চলে সম্পৃক্ত হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরে এসে বলেন, ভারতের চোখ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেখে না। এর আগে মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক ও আইপিএস অফিসার মাক্সওয়েল মার্টিনও একই কথা বলেন।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইতে পারে যে প্যাসিফিকের মতোই ভারত মহাসাগর যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কাজেই তারাও এখানে তাদের খুব শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করতে চাইতে পারে, যেটা ভারত সম্ভবত পছন্দ করবে না। এই হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত তো আছেই, তার সঙ্গে আরও মিত্র খুঁজছে এখানে এবং সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা। কারণ ভারত মহাসাগরের এই অংশে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো বড় দেশ নেই।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কখনোই স্বীকার করবে না যে তারা ভারতের চোখে বাংলাদেশকে দেখে। আর ভারতও কখনো স্বীকার করবে না যে সে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করে। এগুলো অন্তরালের সমঝোতা। তবে এই সমঝোতার বাইরে গিয়ে আমরা দেখলাম বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।’