মাইকেল জর্ডান, লেব্রন জেমস কিংবা কোবে ব্রায়ান্ট, নামগুলো শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের বাস্কেটবলের দৃশ্য। অন্যদিকে বাবে রুথ, রজার ক্লেমেন্স কিংবা হাঙ্ক অ্যারোনের নাম উঠে আসতেই মনে পড়ে বেসবলের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খেলাধুলার ক্ষেত্রে এই দুটি ইভেন্ট বেশ জনপ্রিয়। সাম্প্রতিককালে ফুটবলও বেশ এগিয়ে। বিশেষ করে লিওনেল মেসির আবির্ভাবের পর। কারো কারো মতে, বাস্কেটবল কিংবা বেসবলের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল। মার্কিনীরা যাকে ভালোবেসে ডাকে সকার বলে। সেই দেশে আগামী একমাস কাঁপবে ক্রিকেট জ্বরে।
বৈশ্বিক কোন আসরে আমেরিকা ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে এই প্রথম। তাও আয়োজক হওয়ার সুবাদে। কারণ বাছাই পর্ব দলটির জন্য রীতিমতো কঠিনসাধ্য একটা ব্যাপার। ইতিহাস তেমনই স্বাক্ষ্য দেয়। ২০০৭ থেকে ২০২২, টানা আট আসরে বাছাই পর্বে অংশ নিলেও টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের টিকিট মেলেনি তাদের। এবার সহ-আয়োজক হওয়ার সুবাদে মিলেছে সেই টিকিট। যা নিয়ে মার্কিনিদের মধ্যে কাজ করছে আলাদা রোমাঞ্চ। ফ্লোরিডা, নিউইয়র্ক ও টেক্সাসের তিন ভেন্যুতে মাসখানেক চলবে ক্রিকেট লড়াই।
যে দেশটিতে বাস্কেটবল, বেসবল কিংবা সকারের রোমাঞ্চে ভেসে যায় সবাই, সেখানে ক্রিকেট কতটা মনে দাগ কাটতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে হারিয়ে দেশটিতে নতুন করে ক্রিকেট উন্মাদনা তৈরি করেছে মার্কিন দল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অনেকে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ক্রিকেট একেবারেই নতুন ইভেন্ট। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট প্রথম পা রেখেছিল সেই ১৮৪৪ সালে ম্যানহ্যাটনে। যেখানে কানাডার সঙ্গে হেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তথ্য অনুসারে, আমেরিকায় প্রথম ক্রিকেট খেলা হয়েছিল ১৭৩৭ সালে জর্জিয়ায়। সেই হিসাব ধরলে ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচয় ২৩৫ বছরের! এতদিনের পরিচয় থাকলে কেন ক্রিকেটের প্রসার ঘটেনি সেখানে। কেন অনেকটা ক্রিকেট সাদৃশ্য খেলা বেসবল সেখানে অনেক জনপ্রিয়? এর পেছনেও রয়েছে ইতিহাস।
১৭৩৭ সালে জর্জিয়ায় যে ক্রিকেট খেলা হতো সে কথা ‘দ্য টেনটেড ফিল্ড’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন টম মেলভিল নামের এক ভদ্রলোক। ক্রিকেটের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসাবে তিনি লিখেছেন, ‘গৃহযুদ্ধের সময় ক্রিকেট খেলা কঠিন ছিল। ক্রিকেটে একটি মসৃণ ব্যাটিং পিচের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বেসবলে তার দরকার হয় না। আরও একটি কারণ, বেসবল অনেক কম সময়ে খেলা সম্পন্ন করা যায়।’ এ ছাড়াও তিনি লিখেছেন, ‘আমেরিকার মানুষের চরিত্রের সঙ্গে ক্রিকেটের চরিত্র মিলত না সে সময়।’
ক্রিকেট খেলতে দরকার হয় দীর্ঘ সময়। টেস্ট ক্রিকেটে পাঁচদিন। ওয়ানডের ক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে সাত ঘন্টা, টি টোয়েন্টিতে সাড়ে তিন ঘন্টা। তবু কেন বাড়ছে এই ইভেন্টের প্রতি আগ্রহ। এর অন্যতম কারণ হিসাবে উঠে এসেছে বেসবলের তুলনায় ক্রিকেটের উত্তেজনা অনেক বেশি। যে খেলায় উত্তেজনা যত বেশি সেই খেলা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের তত পছন্দের। ক্রিকেট সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের ধারণা বদলের প্রধানতম কারণ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। ২০০৮ সালে আইপিএল শুরু হওয়ার পর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আসল উন্মাদনা ও উত্তেজনা দর্শকদের কাছে টেনেছে। ফলে ধীরে ধীরে সব দেশেই শুরু হয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি লিগ। ক্রিকেট সম্পর্কে ‘বিরক্তিকর’ ধারণা বদলে দিয়েছে আইপিএল এবং অন্য লিগগুলি। ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণের সুবাদেই পরিবর্তন হয়েছে ক্রীড়াপ্রেমীদের মনোভাব।
ক্রিকেটের এই বিবর্তনই অটুট রেখেছে আকর্ষণ ও জনপ্রিয়তা। খেলার চরিত্র বদলের সঙ্গে রঙিন পোশাক, রাতে খেলাও বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। ব্রিটিশ ক্রীড়া সাংবাদিক টিম উইগমোর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন, ‘আইপিএল ভারতীয় ক্রিকেটকে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের মতো করে তুলেছে। একটা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা। বিশ্বের সেরা ক্রিকেটাররা খেলে থাকেন এখানে। অথচ চ্যাম্পিয়ন হয় সব সময় ভারতের একটি দলই।’
আইপিএলের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে পরিচিত চিয়ার লিডারদের নিয়ে আসা হত। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের এই পদক্ষেপও ক্রিকেট সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের আগ্রহ তৈরি করেছিল। আইপিএলের ধারণা থেকেই এখন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছে মেজর ক্রিকেট লিগ। গত বছর প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় এই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। আগামী মৌসুমে তো এই লিগে খেলবেন বাংলাদেশের তারকা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানও।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটারদের সংখ্যা লজ্জায় ফেলে দিতে পারে অনেক টেস্ট খেলুড়ে দেশকেও, প্রায় দুই লাখ। যাঁদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ছাড়া কেউই আদতে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ নন। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট দল এক কথা বলা যায় পরবাসী টিম। আসন্ন বিশ্বকাপেই যেমন যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেবেন উন্মুক্ত চাঁদ। যার নেতৃত্বে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। আইপিএলে বিভিন্ন দলে খেলা সানি সোহাল, সিদ্ধার্থ ত্রিবেদীরাও এখন স্বপ্নের দেশের ক্রিকেটার। যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্রিকেট খেলার জন্য সেখানে গিয়েছেন ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার লিয়াম প্লাঙ্কেট। তাঁর স্ত্রীর জন্ম আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায়। তাদের হয়েই খেলবেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটার শ্যাডলি ভ্যান শালউইকও এখন মার্কিন মুলকের ক্রিকেটার। নিউজিল্যান্ডের বা হাতি হার্ড হিটার ব্যাটিং অলরাউন্ডার কোরি অ্যান্ডারসন তো এখন যুক্তরাষ্ট্র টিমের মূল আকর্ষণ।
আমেরিকায় মাঝারি মাপের ক্রিকেট প্রতিযোগিতাতেও এখন গ্যালারিতে দর্শক দেখা যায়। আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ৪০০ ছোট ছোট ক্রিকেট লিগ হয়। খেলোয়াড়দের প্রায় সকলেরই শিকড় দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা বা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। আমেরিকার অনূর্ধ্ব-১৯ পুরুষ এবং মহিলা দলের সদস্যদের সকলেই আদতে ভিন্দেশি।
অদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেটকে ভালোমতো গ্রহণ করলে ফলাফল ইতিবাচকই হবে। ক্রীড়া বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, আমেরিকা গুরুত্ব দিলে আরও অনেক দেশ গুরুত্ব দেবে। সেটা আমেরিকার প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ হিসাবেই হোক বা ক্রীড়া ক্ষেত্রে দাপট দেখানোর জন্যই হোক, আখেরে লাভ ক্রিকেটেরই।
নেদারল্যান্ডস, স্কটল্যান্ডের মতো ইউরোপের অন্য দেশ থেকেও আমেরিকায় আসছেন ক্রিকেটাররা। আমেরিকার ক্রিকেট কর্তারা এখন সেই সব প্রতিভাবান এবং দক্ষ ক্রিকেটারের খোঁজ করছেন, যাঁদের নিজের দেশের জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। উন্নত জীবন এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নপূরণের আশ্বাস দিচ্ছেন তাঁরা। টাকার অভাবে ২০২১ সালে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক টি-টোয়েন্টি সিরিজ় বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেট সংস্থা। সাফল্য এলে অর্থসঙ্কট হবে না বলেই বিশ্বাস দেশটির ক্রিকেট কর্তাদের। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তানের মতো প্রথম সারির ক্রিকেট খেলিয়ে দেশগুলির সঙ্গে এখনই কুলিয়ে উঠতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র। কর্তাদের আশা, একবার জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটকে আটকানো কঠিন হবে। অদূর ভবিষ্যতে ২২ গজের লড়াইয়ে সমীহ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
যুক্তরাষ্ট্রে অধিকাংশ মানুষের আগ্রহ না থাকলেও প্রায় ৭০ লাখ নাগরিকের আবার প্রবল আগ্রহ ক্রিকেট ঘিরে। এই ৭০ লাখ মানুষের প্রায় ৪২ লক্ষ সে দেশে গিয়েছেন ভারত থেকে। প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষ গিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশ থেকে। আরও ১৫ লক্ষ মানুষ আমেরিকায় গিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিভিন্ন দেশ থেকে বা ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল এমন কোনও দেশ থেকে। আদতে ব্রিটেনের কিছু মানুষও আছেন যাঁরা ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহী। এই ৭০ লক্ষের ৬৮ শতাংশের জন্ম আমেরিকায় নয়। এদের আগ্রহ, ভালবাসায় ভর করেই বেসবল, ফুটবলের দেশে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে ক্রিকেট।