বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। লিখে গেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, যার চোখে নারী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ নেই। তিনিই যদি ফুটবল নিয়ে কোনো পদ্য কিংবা গদ্য লিখতেন, হয়তো বলে যেতেন- ফুটবলে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে মেসি, অর্ধেক তার রোনালদো। আপাতত ফুটবল মজেছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোয়, যার পায়ে পর্তুগালের হাতে ধরা দিয়েছে আরও একটি শিরোপা।
কিছুদিন আগেই সরল স্বীকারোক্তি দেন ৪০ বছর বয়সী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, এখন আর আগের মতো নন তিনি। ফুটবলে টিকে থাকতে আগের তুলনায় বেশি ঘুমান এবং রিকোভারিতে বেশি সময় ব্যয় করেন। বুঝার অপেক্ষা ছিল না, বয়সের ভারে তিনি পা বাড়াচ্ছেন গুনে গুনে। সেই পা জোড়া পর্তুগিজ যুবরাজকে তুলল আরও ওপরে, পর্তুগালকে নেশন্স লিগ জিতিয়ে। স্পেনের বিপক্ষে ফাইনালে মহানায়ক ছিলেন সিআরসেভেন। ফুটবলে বিস্ময়কর কীর্তিতে দ্বিতীয়বার নেশন্স লিগের ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছেন তিনি।
গত ৭ জুন অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনায় নাটকীয় টাইব্রেকারে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে পর্তুগাল। মিউনিখের আইকনিক স্টেডিয়ামে একপর্যায়ে ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল স্পেন। ৬১ মিনিটে গোল করে দলকে জয়ের মঞ্চ গড়ে দেন রোনালদো। পাঁচবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী সেমিফাইনালেও জার্মানির বিপক্ষে জয়সূচক গোল করেছিলেন। ৪০ বছর বয়সেও তিনি টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। তার পায়ের জাদুতে আসে ৮ গোল। ফাইনালে সমতাসূচক গোলেই বিস্ময়কর এক কীর্তি গড়েছেন সৌদি ফুটবলের অ্যাম্বাসেডর।
ফাইনালের রাতে রোনালদোর বয়স ছিল ৪০ বছর ১২৩ দিন। আন্তর্জাতিক কোনো ফাইনালে তিনিই এখন বয়োজ্যেষ্ঠ গোলদাতা। ৫৭ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙেছেন পর্তুগিজ যুবরাজ। ১৯৬৮ আফ্রিকা কাপের ফাইনালে ঘানার বিপক্ষে গোল করেছিলেন কঙ্গোর পিয়েরি কালালা মুকেন্দি। তখন তার বয়স ছিল ৩৭ বছর। এতদিন তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বয়স্ক গোলদাতা। তাকেই পেছেনে ফেলে রোনালদো। ৪০ বছর বয়সে তিনি ছাড়া আর কোনো ফুটবলার আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে জালের দেখা পাননি।
আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে বয়োজ্যেষ্ঠ গোলদাতা
নাম |
দল |
প্রতিপক্ষ |
বয়স |
টুর্নামেন্ট |
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো |
পর্তুগাল |
স্পেন |
৪০ |
নেশন্স লিগ-২০২৫ |
পিয়েরি কালালা মুকেন্দি |
কঙ্গো |
ঘানা |
৩৭ |
আফ্রিকান কাপ-১৯৬৮ |
লিনস লিয়েডহোলম |
সুইডেন |
ব্রাজিল |
৩৫ |
ফিফা বিশ্বকাপ- ১৯৫৮ |
- করিম বেনজেমার (৩৩ বছর ২৯৫ দিন) রেকর্ড ভেঙে নেশনস লিগে গোল করা সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় রোনালদো। ২০২১ সালে মিলানের সান সিরোতে ফ্রান্সের স্পেনের বিরুদ্ধে ফাইনাল ম্যাচে ফ্রান্সের জয়ে এই ফরাসি তারকা গোল করেছিলেন
- সেমিফাইনালে তার গোলের মাধ্যমে, রোনালদো ৪০ বছর বয়সে নেশন্স লিগে (যেকোনো বয়সে) গোল করা ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। এর আগে, টুর্নামেন্টে গোল করা সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় ছিলেন রয় চিপোলিনা (৩৯ বছর ২৪৬ দিন) জিব্রাল্টারের হয়ে ২০২২ সালে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে
- রোনালদোর আটটি গোলের সংখ্যাও নেশন্স লিগের শীর্ষ বিভাগের (লিগ ‘এ’) একক সংস্করণে সর্বাধিক। সুইডেনের ভিক্টর গিওক্রেস ২০২৪-২৫ সংস্করণে নয়টি গোল করলেও, এটি তৃতীয় বিভাগে (লিগ ‘সি’) এসেছিল
- রোনালদো প্রথম অধিনায়ক যিনি দুবার নেশন্স লিগের ট্রফি তুলেছেন। যুবরাজের নেতৃত্বে পর্তুগাল ২০১৯ সালে উদ্বোধনী সংস্করণেও শিরোপা উল্লাস করেছিল
দেখা হবে বিশ্বকাপে?
ফুটবলে গ্রেট খেলোয়াড়দের মধ্যে যুগ, দেশ এবং রেকর্ড অতিক্রম করে এসেছেন দুটি নাম: ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এবং লিওনেল মেসি। দুই দশকের ক্যারিয়ারের পর, উভয় আইকন ক্লাব এবং আন্তর্জাতিক উভয় স্তরেই তাদের নিরলস শ্রেষ্ঠত্বের সাধনার মাধ্যমে খেলায় অমোচনীয় ছাপ রেখে গেছেন। তাদের মধ্যে কে বেশি উচ্চতায় তা নিয়ে বিতর্ক প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকবে। তুলনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো তাদের নিজ নিজ জাতীয় দলের সঙ্গে সাফল্য- রোনালদোর জন্য পর্তুগাল এবং মেসির জন্য আর্জেন্টিনা।
দুই আইকন এখন পর্যন্ত দেশের হয়ে ৩টি করে টুর্নামেন্ট জিতেছেন। রোনালদো ২০১৬ ইউরো, ২০১৯ ও ২০২৫ নেশন্স লিগ। মেসি ২০২১ ও ২০২৪ কোপা আমেরিকা এবং ২০২২ বিশ্বকাপ। তা ছাড়া এক ম্যাচের ফিনালিসিমা ট্রফিও আছে আর্জেন্টাইনের ঝুলিতে। তার লকারে যে বিশ্বকাপ আছে সেটা এখন পর্যন্ত রোনালাদোকে এড়িয়ে গেছে। সোনার হরিণ ছুঁয়ে দেখার আরেকটি সুযোগ পাচ্ছেন পর্তুগিজ যুবরাজ, কারণ সামনের বছর পর্দা উঠছে ফিফা বিশ্বকাপের। ফুটবলের সবচেয়ে রঙিন মঞ্চে দেখা যাবে রোনালদোকে?
সর্বশেষ ট্রফি জয়ের পর রোনালদো খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। আবেগ সামলে কথা বলেন নিজ ভবিষ্যৎ নিয়ে। বলা বাহুল্য, ২০২৬ বিশ্বকাপের জয় তিনি ৪১ বছর বয়সে পা দেবেন। তাই বড় মঞ্চে তার ফেরা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। এমনকি এ নিয়ে রোনালদো নিজেও নিশ্চিত কিছু বলতে পারছেন না। তার কথায়, ‘আপনারা জানেন আমার বয়স কত হয়েছে। শুরুর তুলনায় আমি শেষের কাছাকাছি, কিন্তু আমাকে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে হবে। যদি আমি গুরুতর আহত না হই, তাহলে খেলা চালিয়ে যাব।’
সেই চোট নিয়ে ভয়, সেটাই ফাইনালের আগে সঙ্গী হয়েছিল রোনালদোর। তিনি বলেন, ‘আমি ওয়ার্মআপের সময় এটি (চোট) অনুভব করেছিলাম, আমি কিছুক্ষণ ধরে এটি অনুভব করছিলাম, কিন্তু জাতীয় দলের জন্য, যদি আমার পা ভেঙে যেত, তাহলে আমি এটি ভেঙে ফেলতাম। একটি ট্রফির জন্য আমাকে খেলতে হয়েছিল এবং আমার সর্বস্ব উৎসর্গ করতে হয়েছিল। আমি অনেক দেশে বাস করেছি, আমি অনেক ক্লাবের হয়ে খেলেছি, কিন্তু যখন পর্তুগালের কথা আসে, তখন এটি সর্বদা একটি বিশেষ অনুভূতি।’