‘ধাত্রী’ শব্দটি সবারই পরিচিত। প্রসবের দিন যত এগিয়ে আসে, ততই দুশ্চিন্তা বাড়ে প্রসূতি নারীদের। অনেকে সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা জন্ম দিতে চাইলেও বহু নারী ধাত্রীকেই একমাত্র ভরসা হিসেবে মনে করেন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ প্রসূতি নারী স্বাভাবিক প্রসবে বাচ্চা জন্ম দিচ্ছেন। এতে সুনাম কুড়াচ্ছেন এসব ধাত্রীরা। তবে প্রশিক্ষিত ধাত্রীর অভাবে প্রসূতি নারীসহ বাচ্চা ঝুঁকিতে থাকছেন বলে মনে করেন সচেতন মহল।
ময়মনসিংহে অনেক ধাত্রী রয়েছেন। এদের বেশির ভাগেরই নেই প্রশিক্ষণ। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্মের কাজ করছেন। তবে এর বিনিময়ে নিচ্ছে না কোনো টাকা। যে যা খুশি হয়ে দেন, ধাত্রীরা তাই নেন।
সদরের চর কালিবাড়ি গ্রামের পারু খাতুন (৬৫) অন্তত তিন দশক ধরে স্বাভাবিক প্রসবে বাচ্চার জন্ম দেওয়াচ্ছেন। তার নেই কোনো প্রশিক্ষণ। তবু নিজের অভিজ্ঞতায় এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তবে জটিল মুহূর্তে প্রসূতিকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন তিনি।
পারু খাতুন বলেন, ‘আমাদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের আওতায় আনলে আরও ভালোভাবে নরমাল ডেলিভারি করানো যেত।’
চর কালিবাড়ি গ্রামের বেলি আক্তার বলেন, ‘পারু খাতুনকে আমরা চাচি হিসেবে ডাকি। আমার নরমাল ডেলিভারিতে তিনটি সুস্থ ছেলে সন্তানের জন্ম হয়েছে তার হাত দিয়েই।’
নগরীর দিঘারকান্দা এলাকার জাহানারা বেগমও (৬৭) ধাত্রী হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘কেউ ডাকলে প্রসূতি নারীদের কাছে গিয়ে নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা করা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে অনেক নারীর ডেলিভারি সফলভাবে সম্পন্ন হলেও অনেকের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। তখন সময় ক্ষেপণ না করে দ্রুত সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।’
জেলার নান্দাইল উপজেলার পালাহার গ্রামের ধাত্রী সাফিয়া আক্তার (৬৯)। তিনি একজন প্রশিক্ষিত ধাত্রী। তিন যুগের বেশি সময় ধরে গ্রামের নারীদের সন্তান প্রসবে সহায়তা করেন। এ জন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিক নেন না।
সাফিয়া আক্তার জানান, তিন যুগ আগে মুশুলী ইউনিয়ন পরিষদে তিন মাস ধাত্রীবিদ্যায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। পরে জেলা শহরে একটি এনজিওর উদ্যোগে ১৫ দিনের আরেকটি প্রশিক্ষণ নেন তিনি। তখন থেকেই নিজের এলাকায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সহায়তা করতে থাকেন। এখনো তিনি সেই কাজ করে চলেছেন। তার হাতে ১২ শতাধিক নবজাতকের জন্ম হয়েছে। প্রসূতি নারীদের সঙ্গে সাফিয়ার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। সন্তান জন্মের সময় সহায়তা করার কারণে সাফিয়ার সঙ্গে এসব নারীর আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, ‘নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সন্তান প্রসবে সহায়তা করি। তবে কোনো জটিলতা দেখা দিলে প্রসূতিকে সরাসরি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই।’
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক শাহরিয়ার মেহেদী মোল্লা বলেন, ‘আমাদের সমাজে ধাত্রীদের অনেক অবদান রয়েছে। এ ধরনের মানুষ সমাজের নিঃস্বার্থ উদাহরণ। এসব নারীকে জয়িতা পুরস্কারের আওতায় আনা প্রয়োজন। তবে এর আগে সব ধাত্রীকে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা উচিত।’
এ বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগের যে প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছেন তারা হয়তো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেলিভারি করাতে অভ্যস্ত না। তবে ধাত্রীদের কাছে যদি মাতৃমৃত্যু বা শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে, তাহলে এটা অপরাধের শামিল। কিন্তু তারা ভালোভাবে ডেলিভারি করাতে পেরেছেন বলেই সুনাম অর্জন করেছেন। তারা যদি প্রশিক্ষণ নিতে চান, তাহলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।’