পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড উৎপাদন শুরু করেছে। এর ফলে ইউনিক হোটেলের আয় অনেক বাড়বে বলে জানিয়েছে ইউনিক হোটেল কর্তৃপক্ষ।
দেশে চলমান তীব্র গ্যাসসংকটের মধ্যেও বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র ইউনিক বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। দেশের বৃহত্তম কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট, মেঘনাঘাট পাওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাস বা আমদানি করা রি-গ্যাসিফাইড তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (আর-এলএনজি) ব্যবহার করছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পেমেন্ট অপরিহার্য। এজন্য লোকসানের কোনো সুযোগ নেই। ক্যাপাসিটি চার্জ এর কথা বিবেচনা করে এই ধরনের পাওয়ার প্ল্যান্টের অপারেশন মডেল ডিজাইন করা হয়।
জানা গেছে, গ্যাসভিত্তিক ৫৮৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মেঘনাঘাট পাওয়ার ১১ মার্চ বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে অবস্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গ্যাস ও আর-এলএনজি মাধ্যমে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ প্রতিষ্ঠানে মোট শেয়ারের ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের শেয়ার রয়েছে ৩৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনিক হোটেলের কোম্পানি সেক্রেটারি মো. শরীফ হাসান খবরের কাগজকে বলেন, মেঘনাঘাট পাওয়ার প্ল্যান্ট উৎপাদন শুরু করায় তাদের আয় বাড়বে। এ প্রতিষ্ঠানে শেয়ারের বড় অংশ রয়েছে ইউনিক হোটেলের দখলে।
তিনি দাবি করেন পাওয়ার প্ল্যান্টটি নির্মাণে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এতে একই ক্ষমতার অন্যান্য পাওয়ার প্ল্যান্টের তুলনায় প্রয়োজনীয় গ্যাসের অর্ধেক ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে ১৮ দশমিক ৭৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ মূল্য ৫০ কোটি ৭৫ লাখ মার্কির ডলার হলেও এর চেয়ে বেশি ঋণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠিানটির মোট বিনিয়োগের ৭৫ শতাংশ এসেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে।
তথ্যে দেখা যায়, ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার বিনিয়োগের ৪৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পেয়েছে। এক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ১১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, জার্মানির প্রতিষ্ঠান ডয়েচে ইনভেস্টিশানসন্ড (ডিইজি) ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়নের জন্য ওপিইসি ফান্ড ৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
মেঘনাঘাট পাওয়ার প্ল্যান্টের শুরু থেকেই ইউনিক হোটেল বিনিয়োগ করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটিতে মোট শেয়ারের বড় একটি অংশ রয়েছে ইউনিক হোটেলের। এজন্য মেঘনাঘাট পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে আয়ের বড় একটি অংশ পাবে ইউনিক হোটেল। চুক্তি অনুসারে মেঘনাঘাট পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদিতে বিদ্যুৎ আগামী ২২ বছর ধরে কিনবে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি)।
সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী মেঘনাঘাট পাওয়ার ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে, এর অর্থ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনের বাইরে থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ পেতে থাকবে। এতে বৈদেশিক ঋণের বোঝার কিছু অংশ পূরণ করতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে কাতারভিত্তিক বিনিয়োগ কোম্পানি নেব্রাস পাওয়ার ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট বিভি-এর কাছে মেঘনাঘাট পাওয়ারের ৪৪০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে বড় অঙ্কের আয় হয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড এবং ইউনিক হোটেলের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ৩৬ মাসের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার কথা ছিল; কিন্তু করোনা মহামারির কারণে নির্ধারিত সময়ে উৎপাদনে যেতে পারেনি।
এদিকে ইউনিক হোটেলের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস পিএলসি বিনিয়োগকারীদের ২০ শতাংশ নগদ অর্থাৎ ২ টাকা করে লভ্যাংশ প্রদান করেছে। এতে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারীরা পেয়েছেন ৫৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এ সময় কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৬ টাকা ৪২ পয়সা।
২০১২ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি ২০২২ সালে ১৫ শতাংশ, ২০২০ ও ২০২১ সালে ১০ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। তবে তার আগের বছর ২০১৯ সালে ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। কোম্পানিটির বর্তমান শেয়ার সংখ্যা ২৯ কোটি ৪৪ লাখ।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ভ্রমণ ও পর্যটন (ট্র্যাভেল অ্যান্ড লেইজার) খাতের কোম্পানি ইউনিক হোটেল এর দ্বিতীয় প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ সময় কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৫১ পয়সা। গত বছরের একই সময় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছিল ১ টাকা ২ পয়সা।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৮৭ পয়সা। গত বছরের একই সময় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছিল ১ টাকা ৫৪ পয়সা। সূত্রে জানা গেছে, আলোচ্য সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) হয়েছে ৮৭ টাকা ৩৯ পয়সা।
এদিকে সাম্প্রতিক সময় বেসরকারি খাতের ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডের ১১ কোটি টাকার স্ট্যাম্প ডিউটি মওকুফ করেছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)। আর্থিক দলিল ও চুক্তির বিপরীতে আরোপ করা স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ মওকুফ করা হয়। এর মধ্যে আছে ভূমিসংক্রান্ত মালিকানা, ভূমি লিজ ও বিমাসংক্রান্ত স্ট্যাম্প।
১৮৯৯ সালের স্ট্যাম্প অ্যাক্ট অনুসারে প্রদত্ত ক্ষমতায় এ মওকুফ করা। অবশ্য কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠানের স্ট্যাম্প ডিউটি মওকুফ করার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে একাধিক প্রতিষ্ঠানকে এভাবে স্ট্যাম্প ডিউটি মওকুফ করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো আবেদন করলে আইআরডি তা যাচাই-বাছাই করে মওকুফ করে থাকে।
আইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় স্বার্থে বিদ্যুৎ খাতের বড় বড় প্রকল্পে এই ধরনের স্ট্যাম্প ডিউটি মওকুফ করা হয়। এর আগেও এভাবে স্ট্যাম্প ডিউটি মওকুফ করা হয়েছে।
২০২২ সালের আগপর্যন্ত নিয়ম ছিল, স্ট্যাম্প ডিউটি পুরোটাই আরোপ করতে হবে। বহু প্রতিষ্ঠানের স্ট্যাম্প ডিউটির পরিমাণ শত শত কোটি টাকা হয়ে যেত। এ জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তা মওকুফের আবেদন করত এবং মওকুফ পেয়ে যেত। এমন প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালে স্ট্যাম্প আইন সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর স্ট্যাম্প ডিউটি যাই আরোপযোগ্য হোক না কেন, এর পরিমাণ কোনোভাবেই ১০ কোটি টাকার বেশি হবে না। এর চেয়ে বেশি হলে প্রতিষ্ঠান আবেদন করলে তা মওকুফ করা হয়।