ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

শামখোল ও ইরিধান

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১১:২৯ এএম
আপডেট: ০৩ মে ২০২৪, ১১:৩০ এএম
শামখোল ও ইরিধান
ছবি : লেখক

বাংলাদেশের হাওর-বিলে শামখোল পাখির সংখ্যা বাড়ছে জেনে আপনি হয়তো বিস্মিত হবেন। কিন্তু বিগত তিন দশক ধরে জলচর পাখি গণনার ফলাফল দেখে আমরা নিশ্চিত, এ দেশে শামখোলের সংখ্যা সত্যই বেড়েছে। পাখি ও প্রকৃতি নিয়ে দুঃসংবাদ-ভারাক্রান্ত এই দিনে এ এক বিরল সুখবর। সত্তর বছর আগে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, বিশ্বের সব শামখোল অচিরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

বাংলার নদী-চরে ও বাদাভুঁইয়ে দল বেঁধে হেঁটে বেড়ানো বিশাল এই পাখি শামখোল, শামুকখোল ও শামুক-ভাঙা ইত্যাদি নামে পরিচিত। ‘মানিকজোড়’ বা ‘স্টর্ক’ পরিবারের যে ছয় প্রজাতির পাখি আজও বাংলাদেশে টিকে আছে, তার মধ্যে শামখোল সবচেয়ে বেশি সুপরিচিত ও বিস্তৃত। এ পরিবারের অপর পরিচিত পাখি ‘মদনটাক’ এখন বেশ বিরল এবং বাদবাকি সবাই অতিবিরল হয়ে গেছে।

শামখোলও কিন্তু আর সব মানিকজোড়ের মতোই বিশালাকার পাখি এবং এর আহার ও বাসস্থানের চাহিদাটাও বড়। জনাকীর্ণ এই দেশে আর সব বড় পাখির মতো শামখোলের সংখ্যাও কমে যাওয়ারই তো কথা। বিশেষ করে গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে ক্ষতিকর কীটনাশক ‘ডিডিটি’ ব্যবহারের ফলে এ দেশের অন্যান্য বড় পাখির সঙ্গে শামখোলেরও বিলুপ্ত হওয়াটা প্রায় নিশ্চিতই ছিল।

শামখোল পাখির ইংরেজি নাম ‘ওপেন বিল’ বা খোলা-চঞ্চু। দুই পাটি চঞ্চুর মাঝে একটা ফাঁকা জায়গা থাকে বলেই এ পাখির এই নাম। চঞ্চুর এই আজব ফাঁকটির জন্যই এর বৈজ্ঞানিক নামকরণ হয়েছে ‘অ্যানাস্টোমাস অসিটান্স’, যার অর্থ হাই তোলা মুখ। শামখোল যেন আজীবন মুখ হাঁ করে আছে, দুনিয়ার আর সব পাখির মতো সে কখনো দুই চঞ্চু এক করতে পারে না।

বাংলার মানুষ কিন্তু এ পাখির চঞ্চুর বিশেষত্বকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং খাদ্যাভ্যাসের ভিত্তিতে এর নাম দিয়েছে শামুক-ভাঙা অথবা শামুকখোল এবং সংক্ষেপে শামখোল। শামখোল পাখির নাতিদীর্ঘ খাদ্যতালিকায় প্রথমেই আছে শামুক ও ঝিনুক। শামুক-ঝিনুকের শক্ত খোলস খুলে ফেলার জন্যই শামখোলের চঞ্চুর ওই আজব আর্কিটেকচার, যা আর কোনো পাখির নেই।

শামখোলের অদ্ভুত চঞ্চু নিয়ে প্রাচীন পাখি বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের অন্ত ছিল না। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার জুলিয়ান হাক্সলি ভেবেছিলেন, হয়তো দুই চঞ্চুর ফাঁকে ফেলেই পাখিটি শামুক ভাঙে। কিন্তু তার ধারণা ভুল ছিল। শামখোল তার চঞ্চুর চোখা প্রান্ত দিয়েই শামুক ভাঙে। পানির মধ্যে চঞ্চুর প্রান্ত ডুবিয়েই সে শামুকের খোলস ভেঙে মাংস বের করে নেয়। পানির তলে পড়ে থাকে শামুকের খোলস।

শামুক ভাঙার কাজে শামখোলের দক্ষতা তুলনাহীন। পাখিবিদ ড. জার্ডন একটা শামখোলের চোখ বেঁধে তার সামনে পানিতে শামুক দিয়ে প্রমাণ পেয়েছিলেন যে, কিছু দেখতে না পেলেও পাখিটি অনায়াসে শামুক ভেঙে খেতে পারে। তবে একই পদ্ধতিতে সে ঝিনুক ভাঙতে পারে না। শামখোল পাখি ঝিনুক তুলে এনে রোদে রাখে। কিছুক্ষণ রোদে থাকলে ঝিনুক আপনি খুলে গিয়ে শামখোলের সুইট-ডিশ হয়ে যায়।

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্ল্যান্ট-প্রোটেকশন নামে এক অদূরদর্শী প্রকল্প এ দেশের বিল-বাঁওড়ে বিমান উড়িয়ে ডিডিটি ছিটিয়েছিল। তার ফলে কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ, উভচর, পাখি ও মাছের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। শামুক-ঝিনুকও বিষাক্ত হয়ে পড়ে এবং শামখোল মরতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে ডিডিটির প্রভাব নিয়ে ‘নীরব বসন্ত’ শিরোনামে অবিস্মরণীয় এক বই লেখেন বিজ্ঞানী র‌্যাচেল কার্সন। এর ফলে ডিডিটি-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং ভয়ংকর কীটনাশকটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।

ডিডিটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর ব্যবহার কমে গেলেও এ দেশে ব্যবহৃত ক্ষতিকর কীটনাশকের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। স্টর্ক, ক্রেইন, র‌্যাপ্টর ইত্যাদি পরিবারের অনেক প্রজাতির বড় আকারের পাখির সংখ্যা ক্রমাগত কমে গেছে, আজও কমেই চলেছে। এর একমাত্র ব্যতিক্রম শামখোল পাখি। বিলুপ্তির স্টিম রোলারের সামনে থেকে এই একটি পাখি সরে আসতে সক্ষম হয়েছে।

এ দেশের অনেক ধানখেতেই আমরা এখন শামখোলের ঝাঁক দেখতে পাই। ইরি ধানের খেতে পানি জমা থাকে বলে এখানে শামুকের বাড়বাড়ন্ত হয় এবং তা নিয়ন্ত্রণ করতে নেমে পড়ে শামুকভুক এই পাখির দল। অনুমান করি, বিলুপ্তির দ্বার থেকে শামখোল পাখিকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে দেশব্যাপী ইরি চাষেরও কিঞ্চিৎ অবদান রয়েছে।

টিয়াঠুঁটির রূপের বাহার

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:০৮ এএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:০৯ এএম
টিয়াঠুঁটির রূপের বাহার
মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ফুটেছে টিয়াঠুঁটি ফুল। ছবি: লেখক

একটানা বর্ষা না হলেও হচ্ছে থেমে থেমে। মাঝে মাঝেই হচ্ছে। আর এতেই যেন হয়েছে টিয়াঠুঁটি গাছের পোয়া বারো। লকলক করে বেড়ে উঠছে। ঝোপঝাড় করে ঝাঁপিয়ে দিচ্ছে বাগানগুলো। বর্ষাকালে টিয়াঠুঁটির আলো ঝরঝর ফুলে ফুলে ভরা গাছগুলোর রূপ যেন ‘অধরা দিয়েছে ধরা ধূলির ধরণীতে’। প্রগাঢ় সবুজের মাঝে লম্বা চিকন ডাঁটির মাথায় ফোটা ফুল আর ফুলের মঞ্জরিপত্র, পুরো পুষ্পমঞ্জরিটি যেন এক আলোকবর্তিকা। 

শ্রাবণের এক দিনে মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ভেতরে টিয়াঠুঁটির এই রূপ দেখা গেল, প্রশাসনিক ভবনের পিছনে একফালি বাগানে। ডাঁটির আগায় ফুটে আছে অসংখ্য ফুল। কিন্তু এ ফুলগুলোর চেহারা একটু অন্য রকম। মনে করার চেষ্টা করলাম, এরকম ফুল কি আর দেখেছি কোথাও? দেখেছি তো বটেই, কিন্তু সে টিয়াঠুঁটি ফুলের সঙ্গে এগুলো তো মিলছে না, পাতাও না। গত বছর গ্রীষ্মে দেখেছিলাম সাভারে ডিসি নার্সারিতে। এ বছর বর্ষায় দেখলাম ফার্মগেটে তুলা ভবনের সামনে। 

সারি করে লাগানো সেসব টিয়াঠুঁটি গাছের ফুলের রং কমলা বা উজ্জ্বল কমলা, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার উদ্যানে ফোটা টিয়াঠুঁটির ফুলগুলো হলদে আর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ফোটা ফুলগুলো ঘিয়া থেকে হলুদাভ। সব টিয়াঠুঁটি গাছের পাতাই একহারা সবুজ। কিন্তু গাজীপুরের কালীগঞ্জের ফুলদি গ্রামে তাসমিয়া রিসোর্টে দেখা পেয়েছিলাম আবার অন্য আরেক রকম টিয়াঠুঁটি গাছের। সে গাছগুলোর পাতা সবুজ ও সাদাটে ছোপায় বিচিত্রিত। এ জন্য ওগুলোর নাম হয়েছে বিচিত্র টিয়াঠুঁটি বা ভেরিগেটেড প্যারাকিট ফ্লাওয়ার। 

সেখানে শুধু গাছই দেখেছিলাম, ফুল দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এবারের বৃক্ষমেলায় সে সুযোগ হয়েছিল। বিচিত্র টিয়াঠুঁটির কিছু ফুলসহ গাছের দেখা পেয়েছিলাম এবার বৃক্ষমেলায় বৃক্ষায়ন গার্ডেনিং নার্সারিতে। ফুলগুলোর রঙ ছিল প্রায় সাদা। এসব দেখে মনে হলো, টিয়াঠুঁটির এত রূপের বাহার হয়েছে তার একাধিক জাত-বৈচিত্র্যের কারণে। ঠিক কতগুলো জাত আমাদের দেশে আছে তার কোনো তথ্য নেই। কোন জাতের কি নাম, তাও জানা নেই। টিয়াঠুঁটির ইংরেজি নাম প্যারাকিট ফ্লাওয়ার বা প্যারটস ফ্লাওয়ার। 

টিয়াঠুঁটি গাছ হেলিকোনিয়েসি গোত্রের হেলিকোনিয়া গণের একটি গাছ। বার্ড অব প্যারাডাইস বা স্বর্গের বুলবুলিও এ গণের একটি গাছ, যা সচরাচর দেখা যায় না। এ দেশে হেলিকোনিয়া গণের সাতটি প্রজাতির গাছ আছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় Heliconia psittacornum I Heliconia rostrata প্রজাতির গাছ। টিয়াঠুঁটি প্রথমোক্ত গণের গাছ। দ্বিতীয় প্রজাতির গাছকে বাংলায় বলে চিংড়িনমি ফুল, ইংরেজি নাম হ্যাঙ্গিং লবস্টার ক্ল। ফুলের অদ্ভুত গড়নের জন্য এটিও বাহারি গাছ হিসেবে এখন বাগানে লাগানো হচ্ছে।

টিয়াঠুঁটি গাছ বর্ষজীবী বিরুৎ স্বভাবের, এক বছরের বেশি বাঁচে না। গাছের গোড়ায় মাটির নিচে কন্দ থাকে, সেখান থেকে গাছ জন্মে। গাছ প্রায় এক থেকে দেড় মিটার লম্বা হয়, জাতভেদে খাটো গাছও দেখা যায়। পাতা সরল ও দেখতে অনেকটা কলাপাতার মতো। তবে কলাপাতার চেয়ে শক্ত ও ছোট। কলাপাতার মতো এ পাতার বোঁটার সঙ্গে একটি পত্রখোল থাকে। 

পাতা মসৃণ ও চকচকে। একটি গাছ থেকে একটি শক্ত নলের মতো পুষ্পদণ্ডের মাথায় বৃশ্চিকাকার বা বিছার মতো মঞ্জরিতে ফুল ফোটে। ফুলের বৃতি বা মঞ্জরিপত্র দেখতে অনেকটা নৌকার খোলের মতো, ঠিক কলার মোচায় যে রকম খোল থাকে, সে রকম। খোলের মধ্য থেকে ৬টি লম্বা কাঠির মতো ফুল বেরিয়ে আসে। খোল বা মঞ্জরিপত্র একটির পর আর একটি প্রায় ২ সেন্টিমিটার ব্যবধানে বিপরীতমুখীভাবে থাকে। প্রতিটি ফুলে থাকে ৫টি পুরুষ কেশর ও একটি স্ত্রী কেশর। ফুলে পরাগায়নের পর ফল হয়। 

বসন্তকাল থেকে শুরু করে বর্ষাকাল পর্যন্ত ফুল ফুটতে থাকে। কিছু কিছু জাতের গাছে প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে। সিলেটের জঙ্গলে দেখেছি এ গণের গাছকে বন্যভাবে জন্মাতে। তবে অধিকাংশ সময়ে এসব গাছ টবে ও বাগানে লাগানো হয় শোভাবর্ধক হিসেবে। বর্ষার প্রকৃতিতে অন্যান্য ফুলের সঙ্গে টিয়াঠুঁটিও তার রূপের বাহার ছড়িয়ে দেয়। ছায়া ও স্যাঁতসেঁতে জায়গায় এ গাছ ভালো জন্মে। 

আদি নিবাস ব্রাজিলের বাদল বন। বিশেষ করে আমাজনের উত্তরাংশ থেকে এ গাছ এখন পৃথিবীর অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থায়িত্বকাল বেশি হওয়ায় এখন ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখার ফুল হিসেবে টিয়াঠুঁটির কদর বাড়ছে। কাটা ফুল ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত ফুলদানিতে সতেজ থাকে। গোড়ার মোথা কেটে ভাগ করে মাটিতে পুঁতে দিলে সহজেই তা থেকে এর গাছ জন্মে। গাছ বেশ কষ্ট সইতে পারে।

দেশি নীল রবিন

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৯ পিএম
আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৪, ০১:৫২ পিএম
দেশি নীল রবিন
ছবি: লেখক

খুব ভোরে পাখি দেখতে বেরিয়েছি ঢাকার জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। এক পুকুরের ধারে জারুল বনের এক পাশে থাকা শীতলপাটি গাছের ঝোপে এ পাখি অনিয়মতিভাবে আসে। কোনো বছর দেখা যায়, আবার কোনো বছর দেখা যায় না। হিমালয়সহ দক্ষিণ এশিয়ার ছোট পাখি নীল রবিন। মেয়েপাখির রং শুকনো পাতার মতো হালকা বাদামি। তাই সহজে চোখে পড়ে না।

সেদিন দেখা গেল, মেয়েপাখিটি খুব সাবধানে শীতলপাটির ঝোপ থেকে বের হয়ে শুকনো জারুল পাতা উল্টিয়ে খুঁটে খুঁটে পোকা খাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক পাখিটি দেখলাম। সে ঝোপের আড়ালেই বেশি থাকতে ভালোবাসে। সেদিন ছেলেপাখির দেখা পাইনি।

দেশি নীল রবিন আমাদের দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে বছরে দুবার। কখনো কখনো এরা বাংলাদেশে যাত্রাবিরতি করে। যাত্রাবিরতির সময় এরা জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে আশ্রয় নেয়। থাকে সপ্তাহখানেক।

অন্য একদিন জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে গিয়েছি। পিচঢালা পথের ওপর পড়ে থাকা একটি পাইপের ওপর বসা পুরুষ নীল রবিন দেখতে পাই। তার ছবি তুলে নিই কয়েকটা। ফুলবাগানের ভেতর দিয়ে উড়ে এসে সবে বসেছে। খানিক বাদেই সে চলে গেল ফুলবাগানে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তার শিকার ধরার কৌশল ও চালচলন পর্যবেক্ষণ করলাম। 

প্রায়ই সে পানি জমে থাকা জায়গাতে আসে পোকা ধরতে। ফুলের টবেও যায়। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই ব্যস লাফিয়ে অথবা উড়ে গিয়ে ঝোপ বা পাতার আড়ালে চুপ করে বসে থাকে। নড়াচড়া করে না একটুও। পোকা ধরা এবং হাঁটার সময় লেজ নাড়ায় ঘন ঘন। দুই ডানা ঝাপটায়। যার ফলে ডানার নীল রং আরও ভালোভাবে দেখা যায়। এই দৃশ্য খুবই উপভোগ্য।

নীল রবিন সাধারণত মিশ্র ও পাতাঝরা বনের তলে, ফুলবাগানে ও চিরসবুজ বনে বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুমে ভূমিতে শেওলা, শুকনো ঘাস, লাইকেন, পশম ও পালক দিয়ে বাটির মতো বাসা বানায়। ডিম পাড়ে। ডিম দেখতে নীল। সংখ্যায় তিন থেকে পাঁচটি। ছেলেপাখির পিঠের দিক নীল, নিচের দিকে কমলা, ভ্রূরেখা সাদা। কানঢাকনি কালো। গলা ও বুক উজ্জ্বল তামাটে। মেয়েপাখির পিঠ জলপাই বাদামি। গলা সাদা, দেহতল পীতাভ। নেপাল, মায়ানমার ও হিমালয়ে এরা বাসা করে জুলাই মাসের দিকে। ছানারা উড়তে শিখলে আবার পরিযায়ী হয়। এ পাখির বৈজ্ঞানিক নাম Larvivora brunnea; ইংরেজি নাম Indian blue Robin।

হারিয়ে যাচ্ছে চালমুগরা

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৪, ০১:৩৪ পিএম
আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৪, ০১:৩৯ পিএম
হারিয়ে যাচ্ছে চালমুগরা
মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে চালমুগরা গাছে ফল ধরেছে। ছবি: লেখক

প্রচণ্ড খরতাপে যখন গায়ে জ্বালা ধরে, তখন ইচ্ছে করে জাদুমন্ত্রে বৃষ্টি নামিয়ে দিই, না পারলে কোনো গাছের ছায়ায় ছুটে যাই। দাহদিনে শান্তির এক পরম জায়গা খুঁজে পেয়েছিলাম কমলগঞ্জে লাউয়াছড়া বনের ভেতরে। বনের পথে গাছের ঘন ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, এ যেন অন্য দেশ, অন্য কোথাও। এমন হিমেল পরশ পাব কোথায়?

উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথের পাশে নানা রকমের গাছগাছড়া দেখতে দেখতে একসময় হাজির হলাম লাউয়াছড়া ফরেস্ট অফিসের রেস্ট হাউসে। তার সামনে এক বিশাল চালমুগরাগাছ। অনেক উঁচুতে কচি ফল ধরে আছে। জানা গেল, গাছটা সিলেটের অরণ্যে মাঝে মাঝে দেখা যায়। আছে কক্সবাজারেও। গাছটি অনেক ভেষজ গুণে গুণান্বিত। কী সে গুণ, তা আর জানা হলো না। ছবিও তোলা হলো না। ফিরে এলাম ঢাকায়। তবে ফিরে আসার আগে জেনে এলাম, সিলেটের লোকেরা এ গাছকে বলে ডালমুগরা।

পয়লা শ্রাবণে ছুটে গেলাম মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের এ রকম জনমানবহীন দৃশ্য এর আগে আর কখনো চোখে পড়েনি। একটা সেকশনের মধ্যে নামফলকে চালমুগরা গাছের নামটা দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ি। একটু খুঁজতেই পেয়ে যাই গাছটা। মাঝারি আকারের বৃক্ষ, প্রায় দশ-বারো মিটার লম্বা, কাণ্ড সোজা—সরল ও গোলাকার। গাছে দোলানো ঝোলানো ডালপালা। ডালের দুই পাশে সাজানো চকচকে সবুজ লম্বা লম্বা আয়তাকার পাতা, পাতার কিনারা সমান, তবে সামান্য ঢেউখেলানো, অগ্রপ্রান্ত সুচালো, শাখার দুই পাশে পাতাগুলো বিপরীতভাবে সজ্জিত, একেবারে আগায় বা শীর্ষে একটি পাতা, শিরা স্পষ্ট দেখা যায়। শাখায় শাখায় দুলছে গোল গোল বলের মতো নস্যি রঙের ফল। কোনো ডালে কোনো ফুল নেই, ফুল ফোটা শেষ হয়ে গেছে আরও আগেই। গ্রীষ্ম-বর্ষা ফুল ফোটার সময়। ফুলের রং হালকা হলুদ, কখনো একক আবার কখনো কয়েকটা ফুল থোকায় ফোটে, ফুলে ঘ্রাণ আছে। 

ফল পাকবে আরও পরে, সাধারণত হেমন্তের দিকে পরিপক্ব হয়। ফল সুগোল, শক্ত কাঠের মতো পুরু খোসা, বাদামি। ভেতরে ভুট্টার দানার মতো কয়েকটা বীজ থাকে। পরিপক্ব হলে সেসব ফল সংগ্রহ করে বীজ বের করা হয়। বীজ পিষে তেল বের করা হয়। চালমুগরা তেল অত্যন্ত ঔষধি গুণসম্পন্ন। এ গাছের আর কোনো অংশকে ঔষধার্থে ব্যবহারের পরামর্শ প্রাচীন বৈদ্যরা দেননি। চক্রপাণি দত্ত তার প্রণীত ‘চক্রদত্ত সংগ্রহ’ গ্রন্থে অর্শরোগে চালমুগরার তেল পান করার উপদেশ দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এও বলা হয়েছে যে, যেভাবে তিল থেকে তেল বের করা হয়, সেভাবে চালমুগরার বীজও পিষে নিলে তেল পাওয়া যায়। চালমুগরার তেল বিভিন্ন চর্মরোগ, বাত ও দেহের কোনো স্থানে থেঁতলে গেলে সেখানে মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়। 

তেল মালিশ করলে চুলকানি থাকলে তাও সেরে যায়। এমনকি মাথার খুশকি দূর করতে চালমুগরার তেল মাথায় মাখা হয়। অতীতে কুষ্ঠরোগ হলে রোগীকে একঘরে করে রাখা হতো। তাকে ঘৃণার চোখে দেখত সমাজ। এমনকি কুষ্ঠরোগীকে সে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হতো। কিন্তু সে যাবে কোথায়? শেষে গ্রামীণ বৈদ্যরাই তাকে চালমুগরার তেল ব্যবহারের নিদান দিতেন। বলতেন, কুষ্ঠরোগের প্রাথমিক অবস্থায় চালমুগরার তেল গরম করে তাতে সামান্য মৌ-মোম মিশিয়ে মলমের মতো করে লাগালে ও চালমুগরার তেল ১০ ফোঁটা মাত্রায় দুই বেলা খেলে কুষ্ঠরোগের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এ উপদেশ দিয়েছেন আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তার ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ বইয়ের পঞ্চম খণ্ডে। 

চালমুগরার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Hydnocarpus kurzii ও গোত্র Flacourtiaceae। এ গাছ চিরসবুজ প্রকৃতির, অর্থাৎ শীতে এর পাতা ঝরে না। কাঠ খুব শক্ত, কাঠের ভেতরের রং সাদা, বাইরের রং হলদে, বাকল ধূসর। গাছের আদি নিবাস ভারতবর্ষ ও মায়ানমার। সে অর্থে গাছটি আমাদের দেশি। তবে চালমুগরাগাছ সমতলের চেয়ে ত্রিপুরা, খাসিয়া পাহাড় বা সিলেট অঞ্চল, চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা, কক্সবাজারের অরণ্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম, ইয়াঙ্গুন প্রভৃতি এলাকায় ভালো জন্মে।

চালমুগরাগাছ এত ঔষধি গুণের হলেও তার ব্যবহার সেভাবে এখন আর হয় না। অকম্মা গাছের খাতায় চলে যাওয়ায় ধীরে ধীরে বন থেকেও সে হারিয়ে যাচ্ছে। এ গাছকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রাকৃতিক পরিবেশে এর প্রকৃত আবাসস্থলে চারা লাগাতে হবে। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সমতলে না লাগিয়ে পাহাড়ের মধ্যদেশ থেকে পাদদেশ পর্যন্ত চালমুগরাগাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে।

‘বাঘ বিধবা’ সোনামণির কষ্টকাহিনি

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৪, ১০:২০ এএম
আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৪, ১০:২০ এএম
‘বাঘ বিধবা’ সোনামণির কষ্টকাহিনি
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের সোনামণির দিন কাটে একাকিত্বে আর সংকটে। ছবি: খবরের কাগজ

সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার আলোচিত এক মুখ সোনামণি। যার দুই স্বামীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বাঘের আক্রমণে দুই স্বামী নিহত হওয়ার পর থেকে ‘অপয়া’, ‘অলক্ষ্মী’, ‘স্বামীখেকো’ অপবাদ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে সোনামণিকে। কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলেও তাকে খেতে দেওয়া হয় সবার শেষে।

বর্তমানে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ বাজারের পেছনে জেলেপাড়ায় বসবাস তার। দুই স্বামীর সংসারে চার সন্তান থাকলেও সোনামণির দেখভাল করেন না তাদের কেউই। বলতে গেলে একাকী জীবনে সংকট নিত্যদিনের, নেই কোনো সমাধান। 

বাঘ বিধবা সোনামণির বাবার বাড়ি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে। ছোটবেলা থেকে বাবার অভাবের সংসারে বড় একটা বোঝা ছিলেন তিনি। এ জন্য বেশি দিন বাবার ঘরে থাকতে পারেননি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন নিজ বংশীয় এক জেলের সঙ্গে।

ভালো ছেলে হওয়ায় পাত্রকে হাতছাড়া করেননি সোনামণির বাবা। বর শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ গ্রামের জেলেপাড়ার তরুণ রাধাকান্ত সরদার। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম নেয় এক ছেলে। সোনামণি ও তার স্বামীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বেশ ভালোই চলছিল তাদের জীবন ও সংসার। 

সন্তানের বয়স যখন এক মাস, তখন (১৯৯৯ সাল) স্বামী রাধাকান্ত সরদার বন বিভাগ থেকে পাস-পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান। সেখানে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারাতে হয় তাকে। বাঘের কবল থেকে রাধাকান্তের লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাননি তার সঙ্গীরা। মর্মান্তিক এই ঘটনায় আকাশ ভেঙে পড়ে সোনামণির মাথায়। তছনছ হয়ে যায় সুখের সংসার। মাত্র এক মাস বয়সী শিশুসহ স্বামীর বাড়ি থেকে বিধবা এই নারীকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন তার শাশুড়ি। সমাজের লোকজন সোনামণিকে ‘অপয়া’ বলে আখ্যা দেন। যেন তার অপরাধের(!) কারণেই স্বামীকে বাঘে খেয়েছে।

কষ্টেসৃষ্টে দিন যেতে থাকে হতভাগিনী সোনামণির। কীভাবে সংসার চলবে? এই সংকটের কী সমাধান? সে সময় স্বামীহারা একজন নারীকে সমাজে অবহেলার চোখে দেখা হতো। অভাবী বাবার সংসারেও জায়গা হয়নি তার। সমাজ তাকে ‘অপয়া’ বলে ধিক্কার দিতে থাকে। একপর্যায়ে প্রতিবেশীরা সোনামণির এক মাস বয়সী শিশুসন্তানের কথা ভেবে তার অবিবাহিত দেবর ভুবেন সরদারের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এ সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ের জম্ম হয়। এতে সোনামণির দুঃখ কিছুটা লাঘব হয়। পেছনের কালো শোকার্ত অধ্যায় মুছে ফেলে নতুনভাবে সংসার শুরু করেন। 

২০০৩ সালে ভুবেন সরদার বন বিভাগ থেকে পাস-পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান। কিন্তু আর ফিরে আসেননি। মন্দ কপাল আর কাকে বলে! প্রথম স্বামীর মতো দ্বিতীয় স্বামীও বাঘের শিকার হন। খুঁজে পাওয়া যায়নি স্বামী ভুবেনের লাশও। 

দুই স্বামী বাঘের পেটে যাওয়ার পর সোনামণিকে স্থানীয় লোকজন ‘অলক্ষ্মী’ ও ‘স্বামীখেকো’ আখ্যা দিয়ে সমাজ থেকে আলাদা করে দেন। শাশুড়ি তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন, যাতে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে অকল্যাণ এড়াতে এই ‘অলক্ষ্মী’র মুখ দেখতে না হয়। 

সোনামণি বলেন, ‘১৯৯৯ সালে আমার স্বামীকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। সে কারণে কোলের এক মাস বয়সী বাচ্চাসহ শাশুড়ি আমাকে তাড়িয়ে দেন। তখন আমাকে বাচ্চা নিয়ে পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। পরে দেবর আমাকে বিয়ে করে। ২০০৩ সালে বাঘে ধরে তাকেও।’

সোনামণি আরও বলেন, “আমার এ জীবন তো মৃত্যুর মতোই। স্বামীরা গেল বাঘের পেটে, সেই সঙ্গে আমাকেও মেরে রেখে গেল। আমার মতো সব ‘বাঘ বিধবা’ নারীর জীবন চলছে অপমানে অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে।” 

স্বামী হারানোর অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের সঙ্গে তাদের জীবনে যোগ হয়েছে সামাজিক নির্যাতন ও নিগ্রহ। পরিচিতি জুটেছে ‘অপয়া, ‘অলক্ষ্মী’ ও ‘স্বামীখেকো’ হিসেবে। স্ত্রীর মন্দভাগ্য স্বামীদের বাঘের মুখে ফেলেছে বলে মনে করে এই সমাজ। এই দায় মাথায় নিয়ে বহু ‘বাঘ বিধবা’ অসহায় নারী বাধ্য হন স্বামীর ঘর ছাড়তে। কিন্তু তার পরও বেঁচে থাকতে হয়। সন্তান লালন-পালন করতে হয়। রোজগারের জন্য যুদ্ধ না করে উপায়ই বা কী?। এমন হাজারও সংকটে বিপন্ন অভাগিনী ‘বাঘ বিধবা’রা। তাদের ভাঙাপোড়া জীবনে বিবর্ণ অন্ধকার ছাড়া অন্য কিছু নেই।

নাম তার সরস্বতী চাঁপা

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪, ১১:৩৬ এএম
আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৪, ১১:৩৬ এএম
নাম তার সরস্বতী চাঁপা
ছবি: লেখক

একেই বলে দশচক্রে ভগবান ভূত! দশজন যদি ভগবানকে ভূত বলে ডাকে, তবে তার সে নামটাই একদিন স্থায়ী হয়ে যায়। লোকমুখের রটনা খুবই মারাত্মক। কখনো কখনো তা বিপর্যয়েরও কারণ হয়। তবে সরস্বতী চাঁপার ক্ষেত্রে কথাটা কতটা সত্য হবে, জানি না। কেননা এ গাছের চারা সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছে ভারত থেকে। 

এ গাছের কোনো বাংলা নাম না থাকায় নার্সারির লোকেরা একে ডাকতে শুরু করেন সরস্বতী চাঁপা বলে। এরপর সেসব নার্সারি থেকে যারা চারা কিনে নিয়ে বাগানে লাগান, তখন তার ধবধবে সাদা সুগন্ধি ফুলের রূপে বিমোহিত হয়ে নার্সারির লোকদের দেওয়া সে নামকেই আপন করে নিয়ে তারা ডাকতে শুরু করেন সরস্বতী চাঁপা বলে। আবার কেউ কেউ এ নামটাকে এতটাই পছন্দ করেছেন যে, সে নামের পক্ষে বেশ জোরালো একটা যুক্তিও দাঁড় করিয়েছেন। তারা বলছেন, এ গাছের কাঠ দিয়ে বাদ্যযন্ত্র বীণা তৈরি হয়। বীণা আর বই হলো সরস্বতীর হাতের শোভা, সংগীতকলা ও জ্ঞানের প্রতীক। আবার ফুলের শুভ্রতাও শুভ্রবসনা সরস্বতীর সঙ্গে মানানসই। তাই এ গাছের নাম সরস্বতী চাঁপা তো হতেই পারে। 

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা সাধারণত যেকোনো উদ্ভিদের নামকরণ করেন তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে। বৈশিষ্ট্যের ওপর ভর করে প্রথমে করা হয় তার দ্বিপদী নামকরণ, যাকে আমরা উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম বা প্রজাতিগত নাম বলি। এসব নামের দুটো অংশ থাকে, যাকে বলে এপিথেট বা নামাংশ। এরপর করা হয় তার সাধারণ নাম, যা সাধারণত ইংরেজি নাম হিসেবে পরিচিত হয়। এরপর আসে স্থানীয় নাম। এটা বিভিন্ন ভাষাভাষীর কাছে বিভিন্ন আঞ্চলিক নামে প্রতিষ্ঠা পায়। 

এসব নামকরণ যে বিজ্ঞানীরা করেন তা নয়, স্থানীয় লোকেরাই এসব নাম দেন, তাই এগুলোকে বলা যায় লোকনাম। সরস্বতী চাঁপা নামটিকে যদি বাংলাদেশি লোকেরা দিয়ে থাকেন, তবে সেটা দোষের কিছু না। শুধু খেয়াল রাখতে হবে যে তার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামটা যেন আমরা না বদলাই, সে অধিকার বিজ্ঞানীরা আমাদের দেননি।

পাঁচ-ছয় বছর আগে ধানমন্ডির ৯ নম্বর রোডের একটা বাড়ি ‘টোনাটুনি’তে সরস্বতী চাঁপাগাছ দেখেছিলাম। খুব ছোট সে গাছে লম্বা ঝুলন্ত ছড়ায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা রঙের ফুল ফুটতে দেখেছিলাম। তেমন আহামরি রূপ না থাকায় বেশি গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু বাগানের মালিক ডা. ফেরদৌস আরা যখন সে ফুলের সুগন্ধ শুঁকে দেখতে বললেন, তখন সে সুগন্ধে বিমোহিত হয়ে গেলাম। ওই ছোট্ট ফুলের এত সৌরভ! তিনি জানিয়েছিলেন, গাছটা তিনি ঢাকার বৃক্ষমেলা থেকে কিনেছিলেন। এর পর থেকেই গাছটার খোঁজখবর নিতে শুরু করি। সংবাদ পেয়েও যাই নানা জনের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে। তার মানে সরস্বতী চাঁপা বাংলার মাটিতে ঠাঁই করে নিয়েছে। কিন্তু এর বিস্তারিত তথ্য তেমন পেলাম না। বছর দুয়েক আগে আশুলিয়ার চারাবাগের এক নার্সারিতে চারা পেয়ে আমিও তা কিনে নিয়ে টাঙ্গাইলের সখিপুরে যাদবপুর গ্রামে কবি নজরুল পার্কের চাঁপাবাগে লাগাই। 

সেখানে অন্যান্য চাঁপাগাছের সঙ্গে সরস্বতী চাঁপার গাছও বড় হতে থাকে। পরের বছরই তাতে ফুল ফোটে। পাতার কোল থেকে প্রায় ৮-১০ ইঞ্চি লম্বা ছড়া বা পুষ্পমঞ্জরিতে অনেকগুলো সাদা রঙের ফুল ফোটে দফায় দফায়। তার কাছে যেতেই সেই সুগন্ধ। পরের বছর দেখলাম, গাছটা আরও বড় হয়েছে, বাড়ছে বেশ দ্রুত। তবে ঢাকায় রমনা পার্কের মধ্যেই যে সরস্বতী চাঁপার একটা বয়স্ক গাছ আছে, তা কোনো দিন চোখে পড়েনি। মহুয়া চত্বরের পাশে সে গাছটায় বর্ষাকালেও ফুল ফুটছে। বড় বৃক্ষের পাতার ফাঁকে ছোট ছোট লম্বা মঞ্জরিতে ছোট ছোট ফুল থাকায় হয়তো তা চোখ এড়িয়ে গেছে। গাছটার বাকলও অদ্ভুত। বাদামি রঙের টিস্যু পেপারের মতো পরতে পরতে সাজানো বাকল, লম্বা চেরা চেরা ফাটলের মতো দাগ, বর্ষার জলে ভিজে জবজবে হয়ে আছে।

কিন্তু এ দেশের বইপত্র ঘেঁটে ও গাছের কোনো উল্লেখ কোথাও পেলাম না। অবশ্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে বিদেশি একটি বইয়ে ওর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম পেলাম Citharexylum spinosum ও গোত্র ভার্বেনেসি, ইংরেজি নাম ফ্লোরিডা ফিডলউড। তার মানে এ গাছটার জন্মভূমি আমেরিকার ফ্লোরিডা। ক্যারিবীয় দেশগুলোতে এ গাছ বেশ দেখা যায়। গাছ আছে ভেনেজুয়েলা, গায়ানা ও সুরিনামে, ভারতেও আছে। মনে হয়, সেখান থেকেই আমাদের দেশে এ গাছের অনুপ্রবেশ। প্রতিবছর বৃক্ষমেলার সুবাদে এ দেশে চারা ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে, বিশেষ করে ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে নতুন নতুন গাছ এনে বাংলার উদ্ভিদসম্পদকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন। এটিও তেমনিভাবে এসেছে। এ গাছের প্রতিষ্ঠিত কোনো বাংলা নাম নেই। সরস্বতী চাঁপা নামটি আমরা গ্রহণ করতে পারি। 

সরস্বতী চাঁপা ছোট বৃক্ষপ্রকৃতির বহুবর্ষজীবী চিরসবুজ গাছ। গাছ ১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতা উপবৃত্তাকার, পাতার বোঁটার রং কমলা আভাযুক্ত। পাতা ও ডালের সংযোগস্থল বা কক্ষ থেকে লম্বা ছড়ার মতো পুষ্পমঞ্জরিতে প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে, ফুলগুলো অত্যন্ত সুগন্ধযুক্ত। পুষ্পমঞ্জরির দৈর্ঘ্য ৮ থেকে ১৬ সেন্টিমিটার, পাপড়ি ৫টি। হিজল ফুলের মতো ছড়ায় পুষ্পমঞ্জরি ঝুলতে থাকে। ফুল শেষে গোলাকার ফল হয়। পাকলে ফলের রং হয় লাল থেকে কালো। বন্য প্রাণী ও পাখিদের খুব প্রিয় এই ফল। সুগন্ধি ফুল প্রজাপতিদেরও আকৃষ্ট করে। বীজ থেকে চারা হয়। তাই সহজে বাগানে এ গাছের বংশ বৃদ্ধি নিজেরাই করা যায়। এই গাছ আধো ছায়া ও রোদে ভালো হয়। বাগানের শোভাময়ী গাছ হিসেবে লাগানো যায়। গাছ মাঝারি লবণাক্ততা সইতে পারে। তাই উপকূলীয় অঞ্চলের বাগানেও এ গাছ লাগানো যায়।