
ই-কমার্স শুধু একটি কেনাবেচার প্ল্যাটফর্ম নয়- বরং এটি পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেম, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি করে, রপ্তানির সম্ভাবনা জাগায়। এ খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে ড্যাফোডিল ফ্যামিলির গ্রুপ সিইও ও গ্রীন ডাটা লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ নূরুজ্জামানের সঙ্গে-
খবরের কাগজ: আপনি একটি নতুন টার্ম ‘ই-কমার্স ইকোনমি’ ব্যবহার করছেন, এটা দিয়ে কি বুঝাতে চাচ্ছেন?
নূরুজ্জামান: ই-কমার্স ইকোনমি বলতে বোঝায় এমন একটি আধুনিক ডিজিটাল অর্থনীতি, যা অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্য, ডিজিটাল পেমেন্ট, দ্রুত ডেলিভারি সেবা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, দক্ষতা প্রশিক্ষণ এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যকে একটি সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে। এটি শুধু একটি কেনাবেচার প্ল্যাটফর্ম নয়- বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেম, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, রাজস্ব বৃদ্ধি করে, রপ্তানি সম্ভাবনা জাগায় এবং দেশের অর্থনীতিকে প্রযুক্তিনির্ভর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ই-কমার্স ইকোনমি গড়ে উঠলে বহুমুখী ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। বিশেষ করে: মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে। নারী উদ্যোক্তার অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে, যা সামগ্রিক নারী অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত করবে। প্রযুক্তিনির্ভর রাজস্ব প্রবাহ সৃষ্টি হবে, যা সরকারের আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকার সহজতর হবে, যা রপ্তানিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
অতএব, ই-কমার্সকে কেবল একটি খাত হিসেবে নয়, বরং ‘নতুন অর্থনীতির রূপকার’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ এবং বাণিজ্যিক কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এর সঠিক বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি টেকসই, প্রযুক্তিনির্ভর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির পথে দ্রুত অগ্রসর হতে পারবে।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশে ই-কমার্স জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না কেন?
নূরুজ্জামান: বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, এটি এখনো জিডিপির আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এর পেছনে রয়েছে কিছু কাঠামোগত ও নীতিগত সীমাবদ্ধতা, যা এই খাতকে পূর্ণমাত্রায় অর্থনীতির মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে বাধা দিচ্ছে। প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো:
অফিশিয়াল স্বীকৃতির অভাব: বাংলাদেশের বেশির ভাগ ই-কমার্স ব্যবসা এখনো ইনফর্মাল বা ফেসবুকভিত্তিক ফরম্যাটে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে ট্রেড লাইসেন্স, বিন, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নেই। ফলে এসব ব্যবসা জাতীয় আয় বা জিডিপির হিসাবভুক্ত হতে পারছে না। নগদ লেনদেনের প্রাধান্য। অধিকাংশ লেনদেন এখনো ক্যাশ-অন-ডেলিভারিভিত্তিক, যা ব্যাংকিং চ্যানেল বা ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মে প্রতিফলিত হয় না। ফলে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পরিসংখ্যানে এর উপস্থিতি দুর্বল থেকে যায়।
ডেটা ঘাটতি: পরিসংখ্যান ব্যুরো, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন (ই-ক্যাব) বা সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে ই-কমার্স খাতভিত্তিক একটি কেন্দ্রীয় ও নির্ভরযোগ্য ডেটাবেস নেই। ফলে সঠিক তথ্য বিশ্লেষণ ও নীতিনির্ধারণে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
নীতিগত অস্পষ্টতা ও প্রণোদনার অভাব : একটি স্পষ্ট নীতিমালা এবং আনুষ্ঠানিক খাতে অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনার অভাবে অনেক উদ্যোক্তা ফর্মাল ইকোনমির আওতায় আসতে আগ্রহী হন না।
খবরের কাগজ: এর সমাধান ও করণীয় কী ?
নূরুজ্জামান: এই বাস্তবতা পাল্টাতে হলে প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত ও প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ। এর জন্য স্মার্ট বিডিআইডি চালু করে প্রতিটি ই-কমার্স ব্যবসাকে একটি ইউনিক ডিজিটাল পরিচিতির আওতায় আনতে হবে। ডিজিটাল পেমেন্টের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে এবং এই ব্যবস্থার ব্যবহারকারীদের জন্য আকর্ষণীয় প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করতে হবে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন, ই-ক্যাবের নেতৃত্বে একটি জাতীয় ই-কমার্স ডেটা ড্যাশবোর্ড গঠন করতে হবে, যেখানে রিয়েল-টাইমে ব্যবসার ধরন, আয়, লেনদেন ও কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন সূচক সংরক্ষিত ও বিশ্লেষণযোগ্য থাকবে। সঠিক নীতিনির্ধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ই-কমার্স খাতকে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব, যা জিডিপি বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে।
খবরের কাগজ: ‘গ্লোবাল বাংলাদেশ’ বলতে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন?
নূরুজ্জামান: ‘গ্লোবাল বাংলাদেশ’ এখন শুধু একটি স্লোগান নয়, বরং একটি নতুন অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি- যেখানে বাংলাদেশি পণ্য ও উদ্যোক্তা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করে। এই ভিশন বাস্তবায়নে সবচেয়ে সহজ ও সম্ভাবনাময় মাধ্যম হিসেবে উঠে এসেছে ই-কমার্স। শপিফাই, অ্যামাজন, ইটসি, ইবে-এর মতো আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে এখন সহজেই বাংলাদেশের পণ্য পৌঁছানো যাচ্ছে। জামদানি, হস্তশিল্প, হালাল স্কিন কেয়ার, দেশি ফুড বা কসমেটিকস-এসব পণ্য বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিজিটাল মার্কেটিং, ক্রস-বর্ডার লজিস্টিকস ও পেমেন্ট গেটওয়ের দক্ষ ব্যবস্থাপনা তৈরি করা গেলে এই খাত হতে পারে নতুন রপ্তানি জোন।
খবরের কাগজ: আপনি কেন বলছেন ‘ই-কমার্স ইকোনমি’ একটি আন্দোলন হতে পারে?
নূরুজ্জামান: কারণ ই-কমার্স ইকোনমি কেবল একটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম নয়- এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে আমূল বদলে দেওয়ার এক শক্তিশালী উপাদান। এই খাত আমাদের চোখের সামনে এমন কিছু পরিবর্তন আনছে, যা অন্য কোনো খাতে এত বিস্তৃত ও বহুমাত্রিকভাবে একসঙ্গে দেখা যায় না। বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তারা ঘরে বসেই আয় করছেন, তরুণরা চাকরির জন্য অপেক্ষা না করে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করছেন, এবং গ্রামের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পণ্য শহরের ক্রেতার হাতে পৌঁছাচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। ই-কমার্স শুধুই বিক্রির মাধ্যম নয়, এটি হয়ে উঠছে কর্মসংস্থান, স্বনির্ভরতা এবং অন্তর্ভুক্তির এক অনন্য মঞ্চ।
খবরের কাগজ: তরুণ প্রজন্মের জন্য আপনার পরিকল্পনা কি?
নূরুজ্জামান: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার তরুণ জনগোষ্ঠী। দেশীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের ওপর। তবে, এই বিশাল সম্ভাবনাময় শক্তিকে ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত করতে হলে প্রয়োজন ব্যবহারিক শিক্ষা ও বাস্তব সহযোগিতা। শুধু তত্ত্বীয় জ্ঞান নয়, তরুণদের হাতে তুলে দিতে হবে কার্যকরী সরঞ্জাম, যাতে তারা নিজের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হতে পারবে।
খবরের কাগজ: নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে কি করবেন?
নূরুজ্জামান: নারীরা হচ্ছেন ঘরে বসে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অংশীদার। তারা শুধু পরিবার নয়, দেশকেও সামনে এগিয়ে নিতে পারেন- যদি দেওয়া যায় প্রয়োজনীয় সুযোগ ও সহায়ক কাঠামো। বাংলাদেশে হাজার হাজার নারী ঘরে বসে অনলাইনে পণ্য তৈরি ও বিক্রি করছেন। কিন্তু এখনো তাদের বড় একটি অংশ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, নীতিগত সহায়তা ও প্রযুক্তিগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই বাস্তবতা বদলাতে হলে, আমাদের প্রয়োজন একটি লক্ষ্যভিত্তিক, নারীবান্ধব ই-কমার্স নীতি ও কাঠামো।
খবরের কাগজ: গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে আপনার রোডম্যাপ কি?
নূরুজ্জামান: বর্তমান সময়ের ই-কমার্স খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো গ্রাহকের আস্থা পুনরুদ্ধার। নানা ধরনের প্রতারণা, পণ্য নিয়ে বিভ্রান্তি, এবং অভিযোগের সমাধানে বিলম্ব- সব মিলিয়ে অনেক ভোক্তা অনলাইন কেনাকাটায় অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। অথচ আস্থা ছাড়া কোনো ইকোসিস্টেম দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এই বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দরকার একটি কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য কাঠামো, যা গ্রাহক, বিক্রেতা ও প্ল্যাটফর্ম- তিন পক্ষকেই সুরক্ষা ও স্বচ্ছতা দেবে।
খবরের কাগজ: নির্বাচিত হলে আপনার প্রথম ১০০ দিনের অগ্রাধিকার কি হবে?
নূরুজ্জামান: একটি স্বচ্ছ, সুশাসিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ই-কমার্স ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে শুরুতেই দরকার দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ। সে লক্ষ্যেই প্রথম ১০০ দিন হবে ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরির সময়। এই সময়ে আমরা সাতটি অগ্রাধিকারভিত্তিক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করব। ‘এক ব্যবসা, এক পরিচিতি’ নীতির ভিত্তিতে উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ, স্বয়ংক্রিয় ও একক নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করা হবে। গ্রাহকের আস্থা, নিরাপদ লেনদেন ও সঠিক বাণিজ্য আচরণ নিশ্চিত করতে একটি বিশেষ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা চালু করা হবে। সদস্যদের তথ্য, অভিযোগের ধরন ও সমাধানের অগ্রগতি কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য একটি জাতীয় তথ্যভিত্তিক প্যানেল গঠন করা হবে। নিয়মিত মতবিনিময় ও সমস্যা সমাধানের জন্য সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক সহায়তা ইউনিট করা হবে, যাতে নারী ও ছোট উদ্যোক্তারা সহজে প্রশিক্ষণ, তথ্য ও সরকারি সহায়তা পান। তার জন্য একটি বিশেষ সহায়তা কেন্দ্র গঠন করা হবে। উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে চালু করা হবে একটি বার্ষিক প্রশিক্ষণ ক্যালেন্ডার এবং অনলাইন জ্ঞানভিত্তিক তথ্যকেন্দ্র, যেখানে পণ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে বিপণন কৌশল পর্যন্ত শেখানো হবে।
খবরের কাগজ: আপনি কি কেবল বড় উদ্যোক্তাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন?
নূরুজ্জামান: না। তবে আমার অবস্থান স্পষ্ট-ই-কমার্সের প্রকৃত চালিকাশক্তি হলো দেশের ক্ষুদ্র, নারী ও তরুণ উদ্যোক্তারা। তারাই ঘরে বসে, সীমিত মূলধনে, নিজ উদ্যোগে একটি নতুন অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তুলছেন। অথচ এতদিন তাদের কণ্ঠ, চাহিদা ও বাস্তবতা অনেকটা উপেক্ষিত থেকেছে। আমি চাই, যারা আজ ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামে, নিজস্ব ওয়েবসাইটে বা স্থানীয় বাজারমুখী অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা করছেন- তাদের কথাই আগে শোনা হোক। কারণ তারাই আসল বাংলাদেশের সম্ভাবনা।
খবরের কাগজ: ই-কমার্সে পেমেন্ট সিকিউরিটির বিষয়ে আপনার অবস্থান কী?
নূরুজ্জামান: বর্তমানে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের সবচেয়ে বড় সংকট হলো গ্রাহকের আস্থার অভাব, যার মূল উৎসই পেমেন্ট নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা। পণ্যের টাকা পরিশোধের পর যদি গ্রাহক নিশ্চিত না থাকেন- পণ্য আসবে কি না, টাকা ফেরত পাবেন কি না- তাহলে ই-কমার্সে টেকসই প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। এই বাস্তবতা বদলাতে হলে পেমেন্ট ব্যবস্থাকেই হতে হবে আস্থার প্রতীক। আমি বিশ্বাস করি, অনলাইন লেনদেন মানে হওয়া উচিত- “আচরণে বিশ্বাস”।
খবরের কাগজ: আপনি ই-কমার্স খাতকে কীভাবে রপ্তানিমুখী করবেন?
নূরুজ্জামান: বাংলাদেশের হাতে রয়েছে বিশ্বমানের কিছু ঐতিহ্যবাহী ও উদ্ভাবনী পণ্য- যেমন জামদানি, নকশিকাঁথা, চামড়াজাত পণ্য, পাট, অর্গানিক স্কিনকেয়ার ও হালাল খাদ্যসামগ্রী। এসব পণ্যের গুণগত মান, নান্দনিকতা ও বৈশ্বিক চাহিদা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ ই-কমার্স রপ্তানিতে বিশাল এক সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
আমার লক্ষ্য স্পষ্ট- এই অসাধারণ দেশীয় পণ্যগুলোকে বিশ্বের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অনলাইন বাজারে পৌঁছে দেওয়া, যাতে করে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ একটি সম্মানজনক গ্লোবাল ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। এই লক্ষ্য পূরণে উল্লিখিত কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ: সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, নীতি, প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগে সহায়তা প্রদানকারী একটি স্থায়ী সেল গঠন করা হবে। আমাজন, ইটসি, শপিফাই-এর মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য সরবরাহের জন্য আনুষ্ঠানিক সমঝোতা গড়ে তোলা হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যে পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশি পণ্য পরিবেশনের জন্য আন্তর্জাতিক গুদাম বা সরবরাহ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। উদ্যোক্তাদের জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে পণ্য প্রস্তুত, মান নিয়ন্ত্রণ ও প্যাকেজিং নিয়ে প্রশিক্ষণ চালু করা হবে।
খবরের কাগজ: আপনার মতে ই-ক্যাবের সংস্কার প্রয়োজন আছে কি?
নূরুজ্জামান: অবশ্যই আছে। বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত বর্তমানে এক সম্ভাবনাময় অধ্যায় অতিক্রম করছে। কিন্তু আমরা একটি সময় পেরিয়েছি যেখানে এর সংগঠন হিসেবে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) অনেক সদস্যের মধ্যে আস্থাহীনতায় ভুগেছেন। অভিযোগ রয়েছে-সংগঠন কার্যকর সেবা দিতে পারছে না, সিদ্ধান্তে সদস্যদের মতামত প্রতিফলিত হচ্ছে না, এবং কাঠামোগত দুর্বলতা স্পষ্ট। এই প্রেক্ষাপটে, আমি মনে করি ই-ক্যাবকে নতুন করে সাজাতে হবে, সদস্যদের সত্যিকারের অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করে।
খবরের কাগজ: ‘ই-কমার্স ইকোসিস্টেম’ বলতে কী বোঝেন?
নূরুজ্জামান: ই-কমার্স কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যবসা নয়- এটি একটি সমন্বিত, টেকসই ও আস্থাভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো। একজন উদ্যোক্তা যেন ঘরে বসে অনলাইন ব্যবসার প্রতিটি ধাপ- রেজিস্ট্রেশন, পেমেন্ট, ডেলিভারি, প্রশিক্ষণ ও রপ্তানি- নির্বিচারে ও নিরাপদভাবে সম্পন্ন করতে পারেন, সেটিই হচ্ছে ই-কমার্স ইকোসিস্টেমের মূল লক্ষ্য।
খবরের কাগজ: ‘ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স’-এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি?
নূরুজ্জামান: বাংলাদেশের পণ্যকে আন্তর্জাতিক বাজারে সফলভাবে বিক্রি করতে গেলে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। এই চ্যালেঞ্জগুলো দূর করতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ ও কৌশল। প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো পেমেন্ট গ্রহণের সমস্যা। বর্তমানে বাংলাদেশে পেপাল, স্ট্রাইপ বা আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে নেই, যার ফলে বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে পেমেন্ট গ্রহণে সমস্যা সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় সমস্যা হলো লজিস্টিকস ও শিপিং কাঠামো দুর্বলতা। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য প্রেরণের জন্য কোনো স্থায়ী পূর্ণতা কেন্দ্র (ফুলফিলমেন্ট সেন্টার) বা ওয়্যারহাউজ গড়ে উঠেনি, যা শিপিং ব্যবস্থা সুসংহত করতে পারবে।
তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পণ্যের মান ও প্যাকেজিংয়ে ঘাটতি। বিশ্ববাজারে পণ্য বিক্রি করার জন্য গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে পণ্যের মান বজায় রাখা এবং যথাযথ প্যাকেজিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বেশির ভাগ উদ্যোক্তার এ বিষয়ে প্রস্তুতি নেই। চতুর্থ সমস্যাটি হলো নীতিনির্ধারণের অস্পষ্টতা। ক্রস-বর্ডার পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক এখনো যথাযথভাবে তৈরি হয়নি, যার কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। পঞ্চম চ্যালেঞ্জ হলো উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের অভাব। যদিও উদ্যোক্তারা অ্যামাজন, ইটসি, ইবে, শপিফাইয়ে ব্যবসা করতে চায়, তবে অধিকাংশেরই প্রস্তুতি নেই।