![বাউল গবেষণাই আমার প্রধান কাজ](uploads/2023/12/01/1701416085.Anwarul-Karim.jpg)
১৯৫৫ সালে আমি যখন কুষ্টিয়া কলেজের ছাত্র, তখন সর্বপ্রথম লালনের গান আমি শুনেছি। আমার মনে পড়ে, কুষ্টিয়া শহরতলির মঙ্গলবাড়িয়ার একজন রিকশাচালক হারান ফকির আমাকে রিকশায় করে শহরতলিতে আমাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার পথে গুনগুন করে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, কমনে আসে যায়’ গান শুনিয়েছিলেন। তিনি গান গেয়ে চললেন একটা, দুইটা, তিনটা। অর্থের কথা চিন্তা করলেন না, সময়ের কথা ভাবলেন না, গান গেয়ে চললেন এক অসাধারণ জাদু জড়ানো কণ্ঠে। মানুষের প্রতি মানুষের গভীর ভালোবাসা থেকেই বাউল গবেষণায় উৎসারিত হয়েছি।…
অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল করীম ১৯৩৯ সালের ২৩ অক্টোবর যশোরের মণিরামপুর থানার লাউড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস মণিরামপুরের পার্শ্ববর্তী কেশবপুর থানার কুড়িয়াখালি গ্রামে। পিতা মো. করীম বখশ এবং মাতা বেগম রহিমা খাতুন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে ইংরেজিতে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার স্বাধীন বাংলা সাহিত্যিক ও শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন ও তার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনিই সর্বপ্রথম বাউল বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং গবেষণার বিষয় ছিল ‘বাউল মতবাদ একটি মৌলিক ধর্ম’। ১৯৮৫ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে যোগ দেন। সেখানে বিশ্বনন্দিত প্রফেসর অ্যানমেরি শিমেলের তত্ত্বাবধানে সুফি-বাউল এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণা করেন।
ড. আনোয়ারুল করীম ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সরকারের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন। তিনি লালন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং ফোকলোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কুষ্টিয়ার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দীর্ঘ আট বছর আমেরিকার International Folkmusic Council-এর Liason Officer হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে সম্মানিত হন। তিনি ১৯৯৬ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে যান এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সুপার নিউমারারি শিক্ষক পদে যোগদান করেন। পরে ২০০৪ সালের ৩ এপ্রিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারারের দায়িত্ব পালন করেন। ইংরেজি ও বাংলায় তার একাধিক গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে। এ ছাড়া তিনি ‘লোক ঐতিহ্য’ ও ‘Folklore’ নামে ত্রৈমাসিক পত্রিকা তার প্রতিষ্ঠিত ‘লোক সাহিত্য কেন্দ্র’ থেকে প্রকাশ করে আসছেন।
ড. আনোয়ারুল করীম শুধুই একটি নাম নয়। তিনি যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। নব্বই ছুঁইছুঁই বয়সেও তিনি নিয়মিত লিখছেন। ফোকলোর বিশ্ববিদ্যালয় করার ব্যাপারে তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। এটি নিয়েই তিনি বর্তমানে বেশি কাজ করেছেন। এ ছাড়া ফোকলোর ও বাউল বিষয়ে তার কিছু কাজ নতুন করে ভাবনায় এসেছে। বিশেষ করে হার্ভার্ড ও দিল্লিতে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেই বক্তৃতা নিয়ে নতুন করে তিনি ভাবছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং স্কলার হিসেবে কাজ করেন। ওই সময়ে তার এক বক্তৃতা সবার কাছে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কুষ্টিয়াতে তিনি তার নিজ বাড়িকেই ‘জাতীয় ফোকলোর ইনস্টিটিউট’ হিসেবে গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এমনকি এ নিয়ে অনেকের সঙ্গে কথাও বলেছেন। যেহেতু এই বাড়িতে অনেক জ্ঞানী, গুণী, পণ্ডিত ব্যক্তির পদার্পণ ঘটেছে। তিনি নিজগৃহ শেকড়ের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। মাতৃভূমি কুষ্টিয়ার জন্য তার প্রাণ কাঁদে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেছিলেন, তুমি কেন এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেতে চাও। কেউ তো এখানে এসে আর যেতে চায় না। সব সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তুমি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে? প্রতিউত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে চাই।’
আপনি এখন কী পড়ছেন?
১৯৮৬ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে বেশ কিছু অধ্যাপক ফোকলোর, বাউল, ভূত-পেত তত্ত্ব বিষয় জানতে সে সময় খুবই আগ্রহ পোষণ করেছিলেন- যা আমার বত্তৃতায় উঠে এসেছিল। সে বক্তব্যগুলোই আমি এখন পড়ছি। এর থেকে নতুন কিছু গবেষণা করে বের করা যায় কি না, তা ভাবছি। গ্রিক রোমান ইতিহাসবিদের চেতনায় ‘গঙ্গারিড’কে আমি ‘গঙ্গাহৃদয়’ হিসেবে মনে করি। এটাকে নিয়ে আমি আরও গবেষণার প্রয়োজন মনে করছি। এ ছাড়া ‘Bangladesh Folk Life and Folklore for Ages’ এবং ‘প্রাজ্ঞজনের বঙ্গবন্ধু’ বইটি পড়ছি।
আপনি এখন কী লিখছেন?
মূলত বাউল গবেষণাই আমার প্রথম এবং প্রধান কাজ। তবে আমার গবেষণায় বারবার লালন উঠে এসেছে। এ ছাড়া আমি এখন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ‘Bangladesh A worst Victim Climate Change: A Threatening Man-made issues its problems and possibilities’ বইটি লিখছি। ইতালির রোম থেকে শুরু করে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয় সে বিষয়গুলো ছবি এবং তথ্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। বইটির কাজ প্রায় শেষের দিকে।
খবরের কাগজ সাহিত্যপাতা ‘সুবর্ণরেখা’ এগিয়ে যাক আপন ভুবনে- গবেষক হয়ে এই প্রত্যাশা রাখছি।
সাক্ষাৎকার: ড. এমদাদ হাসনায়েন