গত সংখ্যার পর
এ পর্যায়ে হালিম শাহ কবির কানে কিছু বলেন। তারপর দুজনই তাকিয়ে দেখেন, মুরগি মারুফ নামে এলাকায় পরিচিত মাস্তান থানায় ঢুকছে। দুজন এতে আশ্চর্য হলেন না, তারা জানেন থানায় খারাপ লোকেরা আসে। কিন্তু থানার বোর্ডে ঝোলানো এলাকার টাউটদের নামের তালিকায় থাকা মুরগি মারুফ কীভাবে থানায় এমন দাপটের সঙ্গে ঢুকছে, হাসছে, কথা বলছে সেটাই আশ্চর্য করে রাখল তাদের। আশ্চর্যবোধে বাধা দিয়ে এ সময় সেন্ট্রি এসে তাদের দুজনকে ওসি সাহেবের রুমে নিয়ে গেলেন।
ওসি সাহেবের রুমে মানুষের জটলা। এখানে মুরগি মারুফ যেমন বসে আছে তেমনি বসে আছেন আদর্শ পাইলট স্কুলের হেডমাস্টার। দুই বন্ধু কী করবে, কী করা উচিত ঠাহর করতে পারছে না। এ সময় ওসি সাহেবের বাজখাঁই গলা শোনা গেল, কে আপনি? এ প্রশ্ন কাকে করা হলো দুই বন্ধু বুঝতে পারলেন না। হাসান আলীই উত্তর দিলেন।
-আমি এক সামান্য কবি।
উত্তর শেষ হয়েছে কি হয়নি, পুনরায় সেই বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হলো-
-আপনি এইমাত্র এক বিরাট অপরাধ করলেন।
-কসুর মাফ করবেন, হুজুর।
-আপনি কবিকে সামান্য বলেছেন, আপনি কি জানেন, কবিগণ এ সমাজের জাগ্রত বিবেক, আর আপনি সেই কবিকে বললেন সামান্য। সম্বোধন সংশোধন করে আবার বলুন।
-আমি একজন কবি স্যার।
-ঠিক আছে, স্যার বলতে হবে না। উপস্থিত গণক হারাধনের দিকে ইঙ্গিত করে ওসি সাহেব বলেন, আপনার এই বন্ধু স্বীকার করেছেন, টিয়ার মুখের এসব খামবন্দি কবিতা আপনারই লেখা। এসব বুজরুকি কাজকারবার একজন কবি হয়েও কেন করেন?
-মাফ করবেন, হুজুর। আমি সামান্য মানুষ। পরীক্ষার্থীরা হলে ঢোকার আগে যখন প্রতিদিনের পরীক্ষার ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য টিয়ার খাম ওঠায় তাতে সুসংবাদ দানকারী, উদ্দীপনাদায়ী কবিতাংশ দেখে তাদের মনোবল বহু গুণে বেড়ে যায়। মানবসমাজের এক ক্ষুদ্র সদস্য হিসেবে এ ক্ষুদ্রতর অবদানটুকু আমার ক্ষুদ্রতম অবস্থান থেকে করতে চাই। তাই এ কবিতা রচনা। গুস্তাকি হলে মাফ করুন, হুজুর।
ওসি সাহেব অনেকক্ষণ কিছুই বললেন না। তারপর হঠাৎ করে মুখ খুললেন-
-এই যে ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রতর ইত্যাদি পদ বারবার উচ্চারণ করলেন কবিতায়, একে কী বলে জানেন?
-জি। একে বলে অনুপ্রাস।
-একটা উদাহরণ দিন তো-
কবি হাসান আলী পড়লেন মহাবিপদে, তিনি স্বল্পশিক্ষিত একজন গ্রাম্য কবি। কোথায় এখন অনুপ্রাসের উদাহরণ খোঁজেন। এ সময় বাইরে নেমে এলো আষাঢ়ের বৃষ্টি। দিগন্ত অন্ধকার করা অঝোর, অফুরন্ত বৃষ্টি। শুরু হলো দিকচক্রবালব্যাপী বজ্রপাত। আর তাতেই বহুদিন আগে বাংলা ক্লাসের হেডপণ্ডিত পরেশ চন্দ্র আচার্যের মুখে শোনা লাইনটি কবির মনে পড়ে গেল। কিছুটা সংশয়, কিছুটা দ্বিধার সঙ্গে আওড়ান কবি-
-গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে।
-এখানে ‘গ’-এর অনুপ্রাস হয়েছে।
বহুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। নিস্তদ্ধ রুমে নির্জন থানার চারপাশজুড়ে আষাঢ়ের বৃষ্টি বিলাপ করে গেল শুধু। কবির কানে কানে সেন্ট্রি বলল, স্যারের সঙ্গে কথায় কথায় উত্তর দেওয়ার কী দরকার ছিল। এখন বুঝুন অবস্থা।
এ সময় ওসি মুখ খুললেন-
-আপনি কি জানেন, কবিতা সকলেই লেখেন, কিন্তু সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।
-জি।
-আপনি কি জানেন, সকল কবিতাই পদ্য, কিন্তু সকল পদ্য কবিতা নয়।
ওসি সাহেব আবার চুপ মেরে গেলেন। সেন্ট্রি আবারও কানে কানে বললেন, এইবার ঠেলা বুঝুন। কী শাস্তি হয় দেখুন।
ওসি সাহেব হেডমাস্টারকে বললেন, বৃষ্টির দিন খিচুড়ি খুব জমবে। আমরা খাব আর আসামিরা দেখবে, কী বলেন?
বলে নিজেই হা হা করে হাসতে থাকলেন। খিচুড়ির অন্য নাম কী জানেন?
-না।
-পলান্ন। পল অর্থাৎ মাংস মিশ্রিত অন্ন। -মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস।
বাইরে বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। মনে মনে আল্লাহ নাম জপেন কবি আর কবিবন্ধু হালিম শাহ। এ সময় ওসি সাহেব তার রায় ঘোষণা করলেন-
-সেন্ট্রি?
-ইয়েস স্যার।
-এই দুই পল্লি কবিকে বাইজ্জত তাদের নিজ নিজ বাসায় পৌঁছে দাও। আর আমার পক্ষ থেকে প্রদান করো এক প্যাকেট পলান্নের পদ।
-ইয়েস স্যার।
তিন.
শীতের সকালে বেলী’স ক্যাফেটেরিয়ায় লম্বা লাইন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে এখানকার নতুন আইটেম- গরম গরম ভাঁপা পিঠা ধোঁয়া ওঠা খেজুর রসে চুবিয়ে খাওয়া।
মৃদুল সম্পন্ন ঘরের ছেলে। তার বাবা ইংল্যান্ডে পড়ালেখা করা মানুষ। তার সূত্রে সে জানে, চায়ে বা কফিতে বিস্কুট বা অন্যকিছু চুবিয়ে খাওয়া ব্রিটিশ সমাজে অবমাননাকর। ইংরেজিতে একে বলে ডাংকিং। যে চুবিয়ে খায় তাকে বলে ডাংকার। এটি একটি ব্রিটিশ স্ল্যাং।
কিন্তু এত কিছু জানা সত্ত্বেও বোধ করি বাঙালি রক্তের টানে সে এই শীতের সকালে কী জানি কী ভেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলী’স ক্যাফেটেরিয়ায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছে।
বন্ধুদের মুখে অনেকবার এ খাবারের খবর শুনেছে সে। একবার তার নতুন কর্মস্থল ‘বাংলা টিভি’র ডাইনিংয়ে বসে সুহৃদ ও সুতনুর (যারা যথাক্রমে হৃদয়হীনতা এবং স্থূলতার জন্য বিখ্যাত) সঙ্গে এ পিঠা চেখেও দেখেছে। ভালো
শব্দের শেষে ই-প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ভালোই হলে যেমন ভালোত্ব একটু কমে যায়, সেরকম স্বাদ লেগেছিল তার। অবশ্য তার বস আজমল সাহেব বলেছিলেন, প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে এ পিঠা খেতে হবে তাওয়া থেকে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা ঘেরা ভোরে। আজ এত দিন পর তার সেই অপূর্ণ আশা পূর্ণ হলো বলে।
চলবে...