![শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার](uploads/2024/01/19/1705642152.Radhuni.jpg)
পা ন সা রে গা
সা রে পা মা
গা সা নি।
ঘরে এসে কন্যা বাপের সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেন-বা বাপের আগমনি পথ চেয়ে কেটেছে তার সারাটি দিন। মাঘের মরা কটালে গহন রাত্রে আসা জোয়ার যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কন্যার যতনে পিতার সারা দিনের গ্লানি তেমন করে ধুয়েমুছে যায়।
তারপর পিতা-পুত্রীতে কিছুক্ষণ মান-অভিমানের খেলা চলে।
-তোমাকে কতবার বলেছি, রোদে না বসতে। স্কুলের পূর্ব গেটের নাগেশ্বরী গাছ- যার তলা বিকেলবেলা গোলাপি ফুলে আচ্ছন্ন হয়ে যায়- সেখানে বসে ছবি আঁকলে কী এমন অসুবিধা হয়!
পিতা কিছুই বলেন না, বরং কবি কন্যার কথায় কবিতার কথকতা দেখে তার ভেতরটা পলকা ফুলের মতো উদ্বেল হয়ে ওঠে।
আরও কিছু তরল মুহূর্ত অতিক্রান্ত হয়। পিতার পাটির ওপর মেয়ে ঘন হয়ে বসে। বাইরের ডানাভাঙা কাকটির ব্যাকুল আগ্রহ লিলুয়া বাতাস হয়ে জানালা গলে ঘরে ঢুকে পড়ে। পিতা ছিন্ন পাঞ্জাবির পকেট থেকে, জামার খুঁট থেকে একে একে বের করেন আধা কেজি পাইজাম চাল, পোয়াটাক তেল, এক ছটাক লবণ, কয়েকটি আলু, একটি বাসি শিঙাড়া আর এক শিশি হাদিয়ায় পাওয়া সুলেমানি আতর।
মেয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না। কিছুই বলে না। পিতা জানেন, মেয়ের বিশেষ খিচুড়ি রান্নার মসলা আজকেও তিনি আনতে পারেননি। কিন্তু বাপ-বেটি লজ্জার প্রতিযোগিতায় কাউকে হারাতে পারে না। অনেকক্ষণ চুপ থেকে রুকু অভিমান ঢেলে বলে, অনেক কাজ পড়ে আছে, যাই। দুমুঠো ভাত ফুটিয়ে আনি। আলু এখন থাক। সকালের অম্বলের ঝোল আর পুকুরের পুঁটি মাছের চচ্চড়ি আছে। বাবা অহেতুক ব্যস্ততার সঙ্গে জায়নামাজে এশার নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে ইকামত বলতে থাকেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তাঁর বিহনে আর কেহ নাই, কিছু নাই। বাইরে টুপটাপ শিশির ঝরতে থাকে।
চুলায় চাল চেপে মেয়ে বিলিম্বি ধোয়া টক চালগুলো ডানাভাঙা কাকের পাত্রে রেখে দেয়। সে ভালো করেই জানে, নিত্যপণ্য কিনতেই বাবার দিনের রোজগার শেষ হয়ে গেছে। খিচুড়ির মসলা কিনবেন কীভাবে। কিন্তু মুখে সে কথা কোনোদিন বলে না সে। বলে, বাবা আজকেও আমার রেসিপির মসলার কথা ভুলে গেছেন।
বাইরের অন্ধকার ডুমুর শাখায় ভুখারি কাকটি বসে থাকে। লেজঝোলা পাখিটি চলে যায় কবে, কিন্তু বাতাসে তার ডানার গন্ধ লেগে রয়। রুকু বলে, আজ আমার ভাগ্যে খিচুড়ি নেই। বিলিম্বি ধোয়া টক চাল তোর ভাগ্যে ছিল কাক; খেয়ে নে।
কোনো এক অজানিত সংকেতে বুঝিবা রুকুর কথা বুঝতে পারে কাক। লঘু পায়ে এগিয়ে এসে খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে টক-স্বাদের ভেজা চাল। হয়তো বলে, ভারি স্বাদ তো! এমন সেরা রাঁধুনির হাতে ধোয়া চাল পৃথিবীতে কার ভাগ্যে জুটেছে কখন! অলৌকিক কাকভাষায় স্রষ্টার দরবারে ফরিয়াদ করে ওঠে সে, আমার মালিকরে সেরা রাঁধুনির সম্মান দাও মালিক।
আসমানের মালিক হয়তো সেই তুচ্ছ মাখলুকের কথা বুঝতে পারেন। কিন্তু জমিতে দাঁড়ানো অষ্টাদশী মালিক পাখির ভাষা বুঝবে কীভাবে। আনমনে ভুখারি কাকের খাওয়া দেখতে থাকে সে। ভেতর থেকে কবি হাসান আলীর উদাত্ত কণ্ঠে ভেসে আসে কালামের বাণী: অপেক্ষা করো, দেখো, তোমাকে নিয়ে আমার কোন কোন খেলা সামনে ‘আসিতেছে’।
দুই.
কদিন ধরে কবি হাসান আলীর চোখে ঘুম নেই। রাত জেগে শায়েরির মকশো করছেন তিনি। প্রতি বছর এসএসসি কী এইচএসসি পরীক্ষার আগে তাঁর এই ঘুমহীন রাত জাগা এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগে মেয়ে বলত, ‘বাবা, পরীক্ষা হবে ছাত্রছাত্রীদের আর ঘুম নেই তোমার চোখে।’ পিতা স্মিত হাসে। বলে, তাদের আরামের জন্যই তো আমার ব্যারাম, আমার রাত জাগা। তুই কি জানিস, যখন পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে তারা, তাদের অভিভাবকরা তোর হারাধন কাকার টিয়া পাখির ঠোঁটে তাদের ‘আজকের পরীক্ষা কেমন হবে’ নামের খাম তোলে আর দেখে অসাধারণ একটা দিন হতে যাচ্ছে আজ, কেমন স্বস্তি আর আনন্দ ফুটে ওঠে তাদের চোখেমুখে, তুই কি জানিস?
আমি নিশ্চিত, পরীক্ষার হলে ঢোকার মুখে এরকম একটা সংবাদ তাদের মনোবল অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই কষ্ট করে টিয়ার মুখে এসব উদ্দীপনাময় কবিতা তুলে দিই।
রাত জেগে দশটির বেশি চার লাইনের কবিতা লিখেছেন কবি হাসান আলী। কখনো রুবাই-এর আদলে কখনো-বা জাপানিজ হাইকুর মতো কবিতা। এসব কবিতা খামের ভেতর রাখা হয় আর টিয়া পাখি একটি একটি করে তোলে।
কিন্তু আজ লেখা কোনো কবিতাই মনের মতো হচ্ছে না। এদিকে রাত শেষ হতে যাচ্ছে বাইরে। সুবহে সাদিকের ওয়াক্তে দূরের পাড়া থেকে মোরগের ডাক ভেসে আসছে; এ সময় আশ্চর্য হয়ে কবি খেয়াল করেন, কাটাকুটির কোনো এক ফাঁকে তার টেবিলে তিনি যা লিখেছেন তা কোনো সাহিত্যপদবাচ্য নয়, তা আসলে কয়েকটি ছড়া মাত্র। কিন্তু এ ছড়াগুলোর মধ্যে কী এমন এক শক্তি আছে তা তাকে মোহাবিষ্ট করে রাখে। আর একবার পড়লেন তিনি, বারবার পড়লেন, যেন পড়ে তার কৌতূহল তৃষ্ণা নিবৃত হচ্ছে না-
কত রঙ্গ জানো জাদু, জানো কত রঙ্গ-
চার গরম দেখাতে পারো যাব তোমার সঙ্গ।
তেল গরম আগুন গরম গরম চুলার ছাই-
তার চেয়েও গরম হলেন ঐশ্বরিয়া রাই।
চলবে...