![শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার](uploads/2024/01/26/1706249664.srestho-radhunir-puroshkar-.jpg)
গত সংখ্যার পর
কত রঙ্গ জানো জাদু, জানো কত রঙ্গ।
চার কঠিন দেখাতে পারো যাব তোমার সঙ্গ।
শিলা কঠিন লোহা কঠিন কঠিন সিঁদুর ফোঁটা।
তার চেয়েও কঠিন কইন্যা শ্বশুরবাড়ির খোটা।
কত রঙ্গ জানো জাদু, জানো কত রঙ্গ-
চার দুঃখ দেখাতে পারো যাব তোমার সঙ্গ।
রোগ দুঃখ শোক দুঃখ দুঃখ একা থাকা
তার চেয়েও দুঃখ কইন্যা তোমায় না দেখা।
কত রঙ্গ জানো জাদু, জানো কত রঙ্গ-
চার সুখ দেখাতে পার যাব তোমার সঙ্গ।
ধনের সুখ জনের সুখ আর ক্ষমতার সুখ-
তার চেয়েও সুখ কইন্যা দেখা তোমার মুখ।
কত রঙ্গ জানো জাদু, জানো কত রঙ্গ-
চার জ্বালা দেখাতে পারো যাব তোমার সঙ্গ।
দেবর জ্বালা ননদ জ্বালা জ্বালা বেকার বর,
তার চেয়েও বিষম জ্বালা দুই সতিনের ঘর।
অনেকক্ষণ নিজের লেখার দিকে বিহ্বল তাকিয়ে থাকলেন কবি। তিনি নিতান্তই গ্রামীণ কবিয়াল। পট আঁকেন আর কখনো-বা পটের নিচে গ্রামীণ স্টাইলে দু-একটি পদ লেখেন, অবসরে করেন গ্রামের গান। কিন্তু কখনো তার হাত দিয়ে সাহিত্য বের হবে, তা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেননি কোনোদিন। কিন্তু তাঁর এই লেখাটি এমন লাগছে কেন? রবীন্দ্রনাথ এ অঙ্গের ছড়াকে বিখ্যাত করে গেছেন।
কিন্তু তাই বলে হাসান আলী পিতা মরহুম আয়ুব আলী, সাকিন আদর্শগ্রাম- একজন ছড়াকার বা কবি হতে পারে? এরকম ধারণাও ভয়ংকর পাপ। মনে মনে আওড়ান কবি। তবে ‘কঠিন সিঁদুর ফোঁটা’ লেখাটির মধ্যে কী যেন আছে ভাবতে ভাবতে বারবার তাকান সেদিকে কিন্তু কিছুই খুঁজে পান না। একবার ভাবেন, সিঁদুরের ফোঁটা তো নরম জিনিস, আবার ভাবেন, সিঁদুরের ফোঁটার যে স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন তার চেয়ে কঠিন শৃঙ্খল পৃথিবীতে আর কী আছে? তবে এই অব্যাখ্যাত জিনিসই কি কবিতা?
তিনি ঠাহর করতে পারেন না, কীভাবে তা তার কলমের আগায় চলে এসেছিল। তারপর একঠায় সেদিকে তাকিয়ে থাকেন।
আদর্শ পাইলট স্কুলের মাঠ লোকে লোকারণ্য। পরীক্ষার্থীর চেয়ে অভিভাবকের সংখ্যা বেশি। পরীক্ষা হলের বাইরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। শতরকম ফেরিওয়ালার হাজার রকম হাঁকডাকে স্কুলের প্রাঙ্গণ গুলজার হয়ে আছে।
সবচেয়ে বড় লম্বা লাইন পড়েছে কালাম পড়া কলমের দোকানে। শালু টাঙিয়ে এক মৌলানা বসে আছেন। অভিভাবকরা পরীক্ষার্থীদের কলম নিয়ে হজুরের কাছে আসছেন, হুজুর কালাম পড়ে ফুঁ দিচ্ছেন। কেউ-বা পরীক্ষার্থীদের নিয়েও চলে এসেছেন। তাদের বিশ্বাস মন্ত্রপূত কলমের বলে কঠিন পরীক্ষাও আসান হয়ে যাবে। যেকোনো জটিল অজানা প্রশ্নের উত্তর কলমের আগায় আপনিতে চলে আসবে।
হুজুর মিতভাষী মানুষ। বলেন, এ তার কোনো কারামতি নয়। এ আল্লাহর কিতাবের মহিমা, তবে তার প্রকৃত ফায়দা হাসিলের জন্য শিক্ষার্থীদের যথাযথ জ্ঞান থাকা চাই। আল্লাহ তো অপাত্রে তার দানের হস্ত ন্যস্ত করেন না।
কবি হাসান আলী দেখেন আর হাসেন, তবে এই ভেবে তার ভালো লাগে যে, মন্ত্রপূত কলম হাতে শিক্ষার্থীদের মনের জোর অনেক বেড়ে যায়। যেমন বাড়ে ভাগ্য পরীক্ষার টিয়ে পাখি আশাব্যঞ্জক কিছু লেখাভর্তি খাম ওঠালে। তিনি দেখলেন, গণক হারাধন ঠাকুরের টিয়ে পাখির সামনেও লম্বা লাইন পড়ে গেছে। সেখানে লেখা: জেনে নিন আজকের পরীক্ষা কেমন হবে আপনার। সেখানে টিয়ের ঠোঁটে ওঠা তাঁরই লেখা এক একটা আশার বাণী দেখে শিক্ষার্থীরা হেসে উঠছে, তাদের মন হাসছে, তাদের মস্তিষ্ক নতুন বলে বলীয়ান হচ্ছে। দূর থেকে দেখে, ভেবে কবির ভেতরটা ভোরের হাওয়ার মতো হালকা হয়ে যায়।
কবি জানেন তিনি একজন সাধারণ, অতি সাধারণ মানুষ। দেশের আইনকানুন, শাসনযন্ত্র, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কিছু বলা বা করার এক্তিয়ার তার নেই। কিন্তু তার সামান্য লেখায় কোনো বাপ কী মায়ের চোখের পুত্তলি ছেলে কী মেয়েটি তার জীবন-মরণের এ পরীক্ষায় এতটুকু বাড়তি মনোবল পাচ্ছে- এমন দৃশ্য কল্পনায় নিজেকে, নিজের হৃদয়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও একজন সার্থক মানুষ মনে হয়। লম্বা লাইনের এহেন দৃশ্য দেখে জনান্তিকে কেঁদে ফেলেন তিনি। তারপর অন্যদিকে চলে যান।
জায়গায় জায়গায় হকাররা বসে গেছে। কচি ডাবের দোকানদার, চটপটিওয়ালা, আইসক্রিমের ব্যাপারী সবাই চিৎকার-চ্যাঁচামেচিতে পরীক্ষার মাঠ সরগরম করে তুলেছে। তাদের অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পড়াশোনা নয়, বরং তাদের খাবারটাই পরীক্ষায় ভালো করার মোক্ষম হাতিয়ার।
একটু পর পরীক্ষার ঘণ্টা পড়ে গেলে এতক্ষণের জমজমাট পরিবেশ হঠাৎ ভাঙা হাটের রূপ নেয়। হারাধন গণক অর্জিত টাকার কিছু দিয়ে তৃপ্তি হোটেলের বিখ্যাত মালাই চা নিয়ে আসেন। তিন বন্ধুতে বহুদিন পর আশ্লেষে চায়ের পেয়ালায় মুখ রাখে। কিন্তু কোনো এক অব্যক্ত-বাধায় কবি হাসান আলীর মুখে চা ঢোকে কী ঢোকে না। মনে মনে বলেন, চা তো পাঞ্জাবির পকেটে ঢোকানো যায় না, মা!
একটু পর দু-একজন করে আবার লোক জড়ো হতে থাকে। কবি হাসান আলী কিছুই বুঝতে পারেন না। ইতস্তত ঘুরে বেড়ান তিনি। কিন্তু শিগগিরই টের পেয়ে যান, পরীক্ষার হল থেকে প্রশ্ন নকল করে বাইরে পাঠানো হয়েছে। এখন তার উত্তর লিখে আবার ভেতরে পাঠানো হচ্ছে।
দলে দলে লোক জায়গায় জায়গায় গুচ্ছে গুচ্ছে বসে গেছে। প্রত্যেক গুচ্ছের মাঝখানে একজন অতি শিক্ষিত মানুষ। তিনি বলছেন, অন্যরা মুসাবিদা করে নিচ্ছেন। কবি হাসান আলী দেখলেন, এই ‘শিক্ষিত লোকজন’ কলেজ কী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অথবা অন্য কোনো স্কুলের শিক্ষক। তারা স্কুল-কলেজের গণ্ডি ছেড়ে এখানে এই মাঠের মধ্যে কী পাঠদান করবেন জানতে তিনি বড় বেশি উৎসুক হয়ে পড়লেন।
একটু পরই তার ঔৎসুক্যের অবসান হলো। এক পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে- বিশেষ বাহিনীর তাড়া খেয়ে একটি দুষ্ট বানর ১৫ ফুট লম্বা একটি তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠছিল। বানরটি প্রতি প্রথম মিনিটে তিন ফুট ওঠে আর প্রতি দ্বিতীয় মিনিটে দুই ফুট নেমে গেলে বাঁশের চূড়ায় উঠতে তার কত মিনিট লাগবে। বাঁশের উচ্চতা সাড়ে ১৪ ফুট হলেই-বা তার কত সময় লাগবে?
চলবে...