![কায়কোবাদ: মহাশ্মশান ও জাতীয়তাবোধ](uploads/2024/02/23/1708669363.KOBI-KAYKOBAAD-flat.jpg)
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে মুসলিম সাহিত্যিকদের ভূমিকা তেমন অগ্রগণ্য নয়। ওই সময়ে যারা সাহিত্যচর্চা করতেন প্রায় সবাই রত ছিলেন দোভাষী পুঁথিসাহিত্য, ঈশ্বর বন্দনা ও নর-নারীর প্রণোয়োপাখ্যান রচনায়। আবদুল হাকিম বা এরকম দু-একজন বাদে অধিকাংশের চেতনায় এ দেশের মুক্ত বাতাসের চেয়ে আপন ছিল মরুভূমির লু’হাওয়া। আরব, ইরান ছিল বেশি আত্মীয়। জাতীয়তাবোধের চেয়ে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভিনদেশি মুসলিম বীরত্বের গৌরবগাথা। এমনকি বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা নবজাগরণের সূচনা হওয়ার পরও তাদের এসব স্পর্শ করেনি। ব্যতিক্রম কায়কোবাদ। তিনি সময়ের ধ্বনি ও প্রয়োজনকে খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন।…
কায়কোবাদ। যিনি মহাকবি নামে পরিচিত। আরও পরিচিত মহাশ্মশানের মহাকবি হিসেবে। কায়কোবাদ বললেই মহাশ্মশান কিংবা মহাশ্মশান উচ্চারণ করলেই কবি কায়কোবাদের নাম বাঙালির মানসপটে ভেসে ওঠে। মহাশ্মশান মহাকাব্য ছাড়াও এই কবি দশের অধিক কাব্যের রচয়িতা ছিলেন। লিখেছিলেন আরও কয়েকটি মহাকাব্য। লিখেছিলেন গদ্য ও পদ্যমিশ্রিত এক ধরনের রচনা ‘গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ।’ প্রকাশিত হয়েছিল তার মৃত্যুর বহু বছর পর- ১৯৭৯ সালে।
তিনি যে সময়ে মহাকাব্য রচনায় ব্রতী হন সেই সময় ছিল গীতিকবিতার স্বর্ণকাল। বিংশ শতাব্দীর ওই সময়টা মহাকাব্য রচনার জন্য মোটেও উপযোগী ছিল না। তবুও তিনি নিবিষ্ট থাকলেন। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে এবং তার কবি-মানসের মূল দর্শন উদ্ধার করতে গেলে কয়েকটি উপাদানের গভীরে যেতে হবে। এক. মহাশ্মানের ভূমিকা, দুই. মহাশ্মশানের কবিতার কিছু অংশ পাঠ, তিন. মহাশ্মমানের বিষয় ও কবির এতদ্বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি।
প্রথমেই আসা যাক মহাশ্মশানের ভূমিকায়। কবি সেখানে লিখেছেন, ‘সাহিত্যের বাজারে আজকাল কবিতার বড়ই ছড়াছড়ি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বঙ্গসাহিত্যে মহাকাব্যের জন্ম অতি বিরল। মধুসূদনের পর হইতে আজ পর্যন্ত মহাকবি হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র ব্যতীত কয়জন কবি মহাকাব্য লিখিয়াছেন? এখনকার কবিগণ কেবল নদীর জল, আকাশের তারা ফুলের হাসি, মলয়পবন ও প্রিয়তমার কটাক্ষ লইয়াই পাগল। প্রেমের ললিত ঝংকারে তাহাদের কর্ণ এরূপ বধির যে, অস্ত্রের ঝনঝনি বীরবৃন্দের ভীষণ হুংকার তাহাদিগের কর্ণে প্রবেশ করিতে অবসর পায় না। তাহারা কেবল প্রেমপূর্ণ খণ্ড কবিতা লিখিয়া নিজেরকে গৌরবান্বিত করেন।
খণ্ড কবিতা কেবল কতগুলি চরণের সমষ্টি, সামান্য একটি ভাব ব্যতীত তাহার বিশেষ কোনো লক্ষ্য নাই, কিন্তু মহাকাব্য তাহা নহে, তাহাতে বিশেষ একটা লক্ষ্য আছে, কেন্দ্র আছে। কবি কোন একটি বিশেষ লক্ষ্য ঠিক করিয়া ও ভিন্ন ভিন্ন গঠনপ্রণালীর অনুসরণ করিয়া নানারূপ মালমসলার যোগে বহু কক্ষ সমন্বিত একটি সুন্দর অট্টালিকা নির্মাণ করেন।
ইহার প্রত্যেক কক্ষের সহিত প্রত্যেক কক্ষেরই ঘনিষ্ট সম্বন্ধ, অথচ সবগুলিই পৃথক, সেই পৃথকত্বের মধ্যেই আবার একত্ব, ইহাই কবির নূতন সৃষ্টি ও রচনা কৌশল। ইহাই মহাকাব্য।’ বোঝা যাচ্ছে, প্রচলিত পথের পথিক তিনি হতে চাননি। প্রেমের ললিত ঝংকারের পরিবর্তে তিনি শুনেছিলেন অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেই অস্ত্রের ঝনঝনানি কত গভীর খাদে নিয়ে যায় মানবতাকে, সেই অস্ত্রের ঝনঝনানি মানুষের অগ্রগামিতাকে কত পশ্চাতে নিয়ে যায়, সেই অস্ত্রেও ঝনঝনানি কত রক্তপাত ঘটায় তা তারা বোঝেনি। অস্ত্রের ঝনঝনানির ভেতরে ঝরে যাওয়া রক্তস্রোত যখন মিশে একাকার হয়ে যায় তখন পৃথক করা যায় না কে হিন্দু কে মুসলমান।
কবি কায়কোবাদ সেই মিশে যাওয়া রক্তের ভেতরে দেখেছিলেন ঐক্যের সুর। তাই তো মানবশরীরে প্রবহমান রক্তের জয়গান গেয়েছেন। রক্তপাতের নয়। যে রক্তপাত হিন্দুকে আরও হিন্দু করে তোলে, মুসলমানকে আরও মুসলমান। তিনি দেখাতে চেয়েছেন হিন্দু হিন্দু নয়, মুসলমান মুসলমান নয়। তিনি দেখাতে চেয়েছেন হিন্দু-মুসলমান আসলে মানুষ। দেখাতে চেয়েছেন ভারতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য আসলে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ইতিহাস।
বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, মহাশ্মশানের কাহিনি তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। সঙ্গে রয়েছে কবি-কল্পিত কয়েকটি প্রেমোপাখ্যান। ইতিহাসের সত্যের সঙ্গে তিনি কবি-কল্পনার কিংবা বলা যায় কাব্যসত্যের মিলমিশ করেছেন। সচেতন পাঠক মহাশ্মান পাঠে ঠিকই পৃথক করে ফেলবেন ইতিহাসের সত্য আর কবিতার সত্যকে। মহাশ্মশানের মূল শক্তি সেখানেও নয়। এটা কাঠামো, মূল শক্তি অন্য জায়গায়।
সেই জায়গাটা ধরতে গেলে প্রথমে যেতে হবে ইতিহাসের সত্যের কাছে। আমরা জানি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মারাঠা-শিখ ও আফগান রাজা আহমদ শাহ আবদালির মধ্যে। যুদ্ধে মহারাষ্ট্রীয়দের পরাজয় হয়। আহমদ শাহ বিজয়ী হন। ভারতে হিন্দু রাজ্য পুনঃস্থাপনের সংকল্পে হিন্দুত্ববাদী মারাঠারা যখন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে, কাবুল অধিপতি আহমদ শাহ আবদালির সহায়তার রোহিলার অধিপতি নজীবদ্দৌলা ভারতে মুসলিম শক্তির সংগঠন করেন। যুদ্ধে মুসলমানরা জয় লাভ করে।
ইতিহাসের এই সত্যের কাছে কবি কায়কোবাদ তার কাব্যসত্তাকে বিলীন করেননি। তিনি অনুধাবন করেছিলেন ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে মানবভাগ্যের উত্থান-পতনের ভয়ংকর পরিণাম। ইতিহাসের সত্য যেখানে মুসলমানরা জয়ী। কায়কোবাদের মহাশ্মশানের সত্য সেখানে মানবতার পরাজয়। ভূমিকায় তিনি বলেছিলেন, ‘একপক্ষে পানিপথ যেমন হিন্দু গৌরবের সমাধিক্ষেত্র, অপরপক্ষে মুসলমান গৌরবেরও মহাশ্মমান।’ তিনি এখানে হিন্দুকে ছোট করেননি, মুসলমানকেও। উভয়ই বীর। কিন্তু তাদের পরিণাম কীসে? পরিণাম শক্তিক্ষয়ে ও ধ্বংসে।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে হিন্দু-মুসলমানকে এরূপ বীর রূপে উপস্থাপনের মাধ্যমে তিনি আসলে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত শক্তির ভেতরে দেখছিলেন জাতীয়তাবোধের উপাদান ও চেতনা। এখানেই মহাশ্মশান শুধু তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাপিয়ে কাব্যমূল্যে ও জাতীয়তাবোধের উপাদানের আলোকে মহান হয়ে ওঠে। এই জাতীয়তাবাদী চেতনার গভীরে হিন্দু-মুসলমান তথা এই সমগ্র সম্প্রদায়ের মিলিত শক্তিতে যে অমিত তেজ রয়েছে, যে বীরত্বব্যঞ্জক গুন রয়েছে তারই মহিমাকীর্তনই মহাশ্মশানের লক্ষ্য ও কেন্দ্র। রক্তপাত ও বীরগাথা এর লক্ষ্য ও কেন্দ্র নয়। কিংবা মুসলমানকে বিজয়ী দেখানো বা হিন্দুকে পরাজিত দেখিয়ে স্থুল এবং তথাকথিত আত্মপ্রসাদ লাভ- কোনোটাই নয়। মহাশ্মশান কখনোই নিছক ইতিহাসের একরৈখিক সরল উপস্থাপন নয়।
মহাশ্মশান মহাকাব্যের নিম্নোক্ত অংশটুকুতেও কায়কোবাদের মূল অভীষ্ঠ কী, তা অনুধাবন করা যায় ‘তুমি মুসলমান/ আমি হিন্দু, কি পার্থক্য প্রেমের নিকটে/ হিন্দু-মুসলমানে নাথ? নিজে প্রেমময়/জগদীশ, প্রেম শ্রেষ্ঠ সর্ব ধর্ম্ম হতে।/ হিন্দু মুসলমান করে সৃজেছে বি বিধি/ জীবশ্রেষ্ঠ মানবেরে-তোমারে আমারে?/ আমরা মানব মূর্খ পড়ি ভ্রান্তির ঘোরে/সৃজিয়াছি জাতিভেদ ধ্বংসের কারণ/ হিংসা বশে, ভাবিতে তা হৃদয় শিহরে।’
কবিতাংশের এটুকুতেই কবির অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়, যা মহাশ্মমানের প্রাণভোমরা।
অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত, নয় শ পৃষ্ঠার এই মহাকাব্য মুসলিম কবিদের বাংলা ভাষায় লিখিত সর্বপ্রথম মহাকাব্য।
মহান এই কবি জন্মেছিলেন ঐতিহাসিক সিপাহি বিপ্লবের বছর- ১৮৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। জন্মদিনে তাকে প্রণতি জানাই।