এলিজাবেথান সময়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা পুরুষতান্ত্রিক ছিল। তখনকার ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে ইংল্যান্ডের পুরুষদের হাতে এবং বিশেষ করে, উচ্চবর্গের পুরুষদের হাতে ন্যস্ত ছিল। নিম্নবর্গের নারী ও পুরুষ উভয়ই ছিল ক্ষমতাহীন। সামাজিক স্তর এবং ভেদাভেদ তখন ছিল প্রখর।
তখন নারীদের নিগ্রহ করা হলেও উচ্চ শ্রেণির নারীদের অবস্থান ছিল একটুখানি ভিন্ন, কেননা তাদের ক্ষমতাসীন পুরুষদের ক্ষমতা অর্জনের এক মাধ্যম হিসেবেও ধরা হতো। আসলে তখন কন্যাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
শুধু তাই নয়, মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র অধিকার পিতারই ছিল এবং এই বিয়ে বেশির ভাগ সময় ক্ষমতা আগ্রাসনের পথ হিসেবেই বিবেচিত ছিল। একবার কোনো নারীর বিয়ে হয়ে গেলে তার কাজ ছিল একজন উত্তরাধিকারী তৈরি করা, যা পরিবারের আরও অগ্রগতির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
শেকসপিয়ার ছিলেন সে সময়ের মানুষ। তার লেখায় তিনি নারী চরিত্রদের এমনভাবে তৈরি করতেন যেন তারা পুরুষদের থেকে কোনো অংশে কম নন এবং বলতে গেলে কিছুটা ঊর্ধ্বেই, যা সে সময়ের সামাজিকতার সঙ্গে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। শেকসপিয়ারের লেখার মাঝে বেশ কয়েকজন শক্তিশালী মহিলা রয়েছে, যারা কখনো কখনো পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক প্রভাব রাখে, কিছু রাজনৈতিক ফলাফল আনতে তাদের স্বামীদের ওপরও কাজ করে।
এ ছাড়া শেকসপিয়ার কিছু নারীকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হন, যা তাদের গুরুত্বসহকারে নেওয়ার অনুমতি দেয়। চরিত্রগুলো স্বাধীন, শক্তিশালী বানানোর পরও নাটকের শেষে নারীরা সর্বদা তাদের নারী ভূমিকায় ফিরে যেতে হয়েছে এবং উপসংহারটি হয়েছে হয় বিবাহ হয়ে নয়তো তাদের পুরুষের আনুগত্যের ঘোষণা ও প্রচলিত মহিলা ভূমিকায় তাদের প্রত্যাবর্তন দেখিয়ে। সম্ভবত শেকসপিয়ারও সে সময়কার নিয়মকে পুরোটা অগ্রাহ্য করতে পারেননি।
শেকসপিয়ারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিসগুলোর মধ্যে একটি হলো শক্তিশালী নারীদের উপস্থাপনা। তিনি চেয়েছিলেন নারী চরিত্রগুলোকে এমনভাবে তৈরি করতে যেন সবাই নারীদের অন্য রূপে গ্রহণ করতে পারে, তাদেরও যেন পুরুষের সমান বলে গণ্য করা হয়। বুদ্ধিতে, কৌশলে তাদের হারাতে গেলে যেন বেগ পেতে হয় এবং তারা একেকজন যেন তখনকার তথাকথিত নিয়মের বিপরীতে চলতে চাওয়া একেকজন চলমান আলো।
এমন বেশকিছু নারী চরিত্র আমরা দেখেছি যেমন ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর পোর্শিয়া, যিনি আদালতে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে অ্যান্টোনিওকে নির্দোষ প্রমাণ করে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। যেখানে অপর পক্ষ বলেছিল অ্যান্টোনিও যদি সময়মতো টাকা দিতে না পারে তাহলে তার শরীর থেকে মাংস কেটে নেওয়া হবে।
এমন ভয়ানক এক অবস্থায় কোনো পুরুষ অ্যান্টোনিওকে উদ্ধার করতে পারেনি যেখানে পোর্শিয়া পুরুষের বেশে গিয়ে তার অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। যদিও তাকে পুরুষের বেশে আসতে হয়েছিল কেননা তখনকার সমাজ নারীদের উকিলের মর্যাদা লাভের অধিকার দেয়নি।
এবার আসি নারী খলনায়িকা চরিত্রে। লেডি ম্যাকবেথ একটি দুর্দান্ত চরিত্র। কেউ কেউ লেডি ম্যাকবেথকে নাটকের খলনায়ক হিসেবে দেখেন। তিনি তর্কাতীতভাবে ডানকানকে হত্যার পেছনে চালিকা শক্তি কিন্তু লেডি ম্যাকবেথ এমন একটি পৃথিবীতে বাস করেন যেখানে পুরুষরা শাসন করে। লেডি ম্যাকবেথ যে মেয়েলি গুণাবলি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা ছুড়ে ফেলে নিজের আত্মাদের বলে, ‘আমাকে মুকুট থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত ভয়ানক নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ করে দাও।’
একজন শ্রোতা হিসেবে, আমরা লেডি ম্যাকবেথকে শুধু তার ভয়ংকর উত্থান এবং সন্তোষজনক পতনের কারণে অপছন্দ করি। অথচ আমরা যদি অন্যভাবে ভেবে দেখি তাহলে লেডি ম্যাকবেথ সেই শক্তিশালী চরিত্র যার কাছে পুরুষরাও হার মানে, যদিও লেডি ম্যাকবেথের পরিণতি খুব একটা সুখকর হয়নি।
এবার আসা যাক ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর জুলিয়েটের কথায়, যে কিনা রোমিও নামের এক যুবকের প্রেমে পড়ে এবং সিদ্ধান্ত নেয় তাকেই বিয়ে করার। তখনকার সময় পিতার অবাধ্য হয়ে নিজের পছন্দমতো কাউকে বিয়ে করা ছিল অপরাধ, যা উপেক্ষা করে জুলিয়েট। শুধু পোর্শিয়া, লেডি ম্যাকবেথ এবং জুলিয়েট নয়, শেকসপিয়ারের একেকজন নারী চরিত্র এমন বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী যারা জানে কীভাবে সবকিছু মোকাবিলা করতে হয়, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। কখনো নায়িকার চরিত্রে বা কখনো খলনায়িকা।
শেকসপিয়ার তার একেকজন শক্তিশালী নারী চরিত্রদের দ্বারা নারীদের হয়তো এটাও বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, যখন অবিচার সংঘটিত হবে নিজের বিরুদ্ধে বা নিজের চারপাশের লোকদের বিরুদ্ধে তখন নিজেকে প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করা যাবে না মোটেও এবং এটাও দেখিয়েছেন যে, একজন নারী যদি খলচরিত্রও হয় তখনো তার সমতুল্য পুরুষদের বেগ পেতে হয়।
কলি