১৯৬৫ সাল। টোঙ্গান বোর্ডিং স্কুলের ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৬ কিশোর হঠাৎ করেই নিখোঁজ। একসঙ্গে ৬ কিশোর নিখোঁজ হওয়ার খবর তখন চারদিকে তোলপাড় করে দিয়েছিল। দিন গিয়ে মাসে গড়ায়, মাস গড়িয়ে বছর; কিন্তু সেই ৬ কিশোরের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। দেখতে দেখতে ১৫ মাস পার হয়ে যায়। তাদের খুঁজে না পেয়ে সবাই হাল ছেড়ে দেয়। ফলে একটা সময় সবাই তাদের ভুলতে শুরু করে।
১৫ মাস পর হঠাৎ এক খবরে পুরো বিশ্ব নড়েচড়ে বসে। কারণ সেই ছয় কিশোরকে খুঁজে পাওয়া গেছে। আর যেখানে খুঁজে পাওয়া গেছে সেটি হলো একটি ছোট্ট জনবসতিহীন দ্বীপ। নাম ‘আতা’। এই ছোট্ট দ্বীপটি মূল ভূখণ্ড থেকে ১০৪ মাইল দূরে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। যে লোকটি তাদের খুঁজে বের করেছিলেন তিনি ছিলেন পিটার ওয়ার্নার; যিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান অভিযাত্রী।
ছেলেগুলো কীভাবে সেখানে গেল, কীভাবেই-বা এতদিন ছিল তা জানার জন্য চারদিকে সবাই তখন মুখিয়ে ছিল। উদ্ধারের পর সেই ছয় কিশোরের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা ১৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত টোঙ্গার রাজধানী নুকুআলোফার বন্দর থেকে একটি মাছ ধরার নৌকা নিয়ে তাদের অকল্পনীয় দুঃসাহসিক অভিযান শুরু করেছিল। তারা স্কুল থেকে খানিকটা পরিকল্পনা করেই অভিযান শুরু করে।
কিন্তু একটি ঝড় তাদের সে পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেয়। ঝড়টি তাদের জাহাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয় এবং এর ফলে আট দিন পর্যন্ত তারা ভাসতে থাকে। আট দিন শেষে তারা দ্বীপের উপকূলে ভেসে যায়। সেখানে তারা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রাথমিকভাবে মাছ, কলা এবং পেঁপের ওপর নির্ভর করেছিল। তারা তাদের বসবাসের জন্য একটি কুঁড়েঘর বানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, তারা সেখানে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থাও করে ফেলে। এ যেন সেই আদিম যুগের মতো বসবাস।
তাদের অসাধারণ অভিযানের গল্পটি সেই সময়ে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। তবে একটা সময় এটি জনসাধারণের স্মৃতি থেকে বিবর্ণ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে লেখক রুটার ব্রেগম্যান দ্বারা ঘটনাটি পুনরুত্থিত হয়েছিল, যিনি তার লেখার মাধ্যমে অসাধারণ বেঁচে থাকার গল্পটি নতুন করে ফোকাসে এনেছিলেন। সিডনি-ভিত্তিক ফটোগ্রাফার জন কার্নেমোল্লা ছেলেদের সঙ্গে সেই দ্বীপে গিয়েছিলেন। তারা যে অবিশ্বাস্য পরিস্থিতিতে বাস করত, তার নমুনা ক্যাপচার করেছিলেন জন কার্নেমোল্লা।
সেখানে তারা কীভাবে টিকে ছিল- এই প্রশ্নটি তখন সবার মনে। পরে জানা যায়, বৃষ্টির পানি তাদের তৃষ্ণা মেটাবার এক অন্যতম মাধ্যম হয়ে গিয়েছিল। কিশোররা ফাঁপা-আউট গাছের গুঁড়িতে পানি সংগ্রহ করত। তবে যখন তারা পানি সংকটে ভুগত তখন সামুদ্রিক পাখির রক্ত পান করার মতো ভয়ানক কাজও করেছিল।
বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য দরকার। এই পুরো দ্বীপে ছিল বন্য তারো, যা কচুজাতীয় এক উদ্ভিদ। ৬ কিশোর এই তারোগুলোকে খাদ্য-উপাদান বানিয়ে ফেলে। শুধু তাই নয়, তারা সমুদ্র উপকূল থেকে ধ্বংসাবশেষের ভেতর থেকে এটা-ওটা সংগ্রহ করে মাছ ধরার সরঞ্জাম বানাত এবং মাছ ধরে খাদ্যের ব্যবস্থা করত।
এক সময় এই সাহসী ছেলেগুলো বুঝতে পারে যে তাদের এখন আগুন প্রয়োজন। কেননা প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে আগুনের প্রয়োজনীয়তা সেই আদিম যুগ থেকে। তারা সামুদ্রিক হিবিস্কাস ব্যবহার করে আগুনের প্রাথমিক অঙ্গার জ্বালায়, যা প্রাচীন একটি কৌশল। তবে এর চেয়েও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই আগুন ধরে রাখার ক্ষেত্রে তাদের দৃঢ়তা। তাদের ১৫ মাসের অবস্থানজুড়ে ক্রমাগত জ্বলেছিল এই আগুন। কেননা তারা শুধুমাত্র উষ্ণতা এবং রান্নার জন্য নয়, বরং আগুনকে সংকেত হিসেবে ব্যবহার করার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল- যেন কোনো উদ্ধারকারী দল কাছাকাছি থাকলে তাদের দেখতে পায়।
তারা তাদের দক্ষতার মাধ্যম দ্বীপের সামগ্রী ব্যবহার করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড় এবং ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছিল। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করা যে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, তা ৬ কিশোরের ১৫ মাসের অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে নতুন করে প্রমাণ হয়েছিল।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ও ডিসার্ট আইল্যান্ড সারভাইভাল
কলি