আমাদের জীবনে এমন অনেক কঠিন সময় আসে, যখন আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। মনে হয় এখানেই সব শেষ। কিন্তু শেষ থেকেও যে শুরু করা যায়, ভাঙনও যে আশ্চর্য সুন্দর উঠতে পারে, তার অনন্য উদাহরণ জাপানের কিন্টসুগি শিল্প। প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো এই শিল্প হচ্ছে অপূর্ণতাকে আলিঙ্গন করার শিল্প, অসম্পূর্ণতার সৌন্দর্যের শিল্প। যখন কোনো কাচ বা সিরামিকের জিনিস ভেঙে যায়, সেই ভাঙা টুকরোগুলো ওরা জোড়া লাগায় সোনার গুঁড়োর বার্নিশ দিয়ে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে, ভাঙা কাচ কখনো জোড়া লাগে না। কিন্তু জাপানিরা এই প্রবাদকে মিথ্যে প্রমাণ করেছে। যদিও এই ভঙ্গুর জিনিস জোড়া লাগানোর জন্য অনেকটা সময় প্রয়োজন, তবে মেরামতের পর তা আগের চেয়ে আরও বেশি নান্দনিক হয়ে ওঠে। তখন দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করাটা সার্থক মনে হয়।
কিন্টসুগি শিল্পের জন্ম সম্পর্কে জানা যায়, জাপানের এক সেনা কমান্ডার ইয়োশিমাসার প্রিয় একটি চায়ের কাপ ভেঙে যায় এবং তিনি এই কাপটি মেরামত করার জন্য চীনে পাঠিয়েছিলেন। তখন তা ধাতব স্ট্যাপলার দিয়ে মেরামত করে পাঠানো হয়। কিন্তু কমান্ডারকে তা খুশি করে না। এরপর জাপানিরা নিজেরাই ভিন্ন এবং নান্দনিক উপায়ে সিরামিক মেরামতের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। এভাবেই একসময় কিন্টসুগি শিল্পের উদ্ভব হয়। কমান্ডারের ইচ্ছা অনুযায়ী নান্দনিকভাবে সমৃদ্ধ কাপ তৈরি করার লক্ষ্যে যে শিল্পের জন্ম হয়েছিল, তা যে এত জনপ্রিয় হবে এবং সুদীর্ঘ বছর ধরে টিকে থাকবে, তা হয়তো তখনো কেউ ভাবতে পারেনি।
যদিও কিন্টসুগি বস্তুর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত একটি শিল্প, তবে এটিতে একটি গভীর দর্শন রয়েছে। কিন্টসুগি দর্শন অনুসারে, ভাঙা, ক্ষয়প্রাপ্ত বা আগের রূপ হারানো কিছুই মূল্য হারায় না। বরং তা আগের চেয়ে আরও মূল্যবান এবং বিশেষ করে তোলা সম্ভব। জাপানিরা অপচয় করতে পছন্দ করে না। তারা রূপান্তরে বিশ্বাসী। যেকোনো ভঙ্গুর কিংবা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে ওঠা জিনিসকে তারা রূপান্তর করে নতুন কিছু তৈরি করে।
এই কিন্টসুগি শিল্প যেকোনো পণ্যে ভিন্ন মূল্য যোগ করার পাশাপাশি মানব সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্টসুগি দর্শন অনুসারে, যদি পর্যাপ্ত প্রচেষ্টা করা হয় এবং প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত বিন্দু সাবধানে এবং সূক্ষ্মভাবে মেরামত করা হয়, তবে যেকোনো জিনিস আগের চেয়ে অনেক সুন্দর এবং মূল্যবান হয়ে ওঠে।
সিরামিক আসলে শক্তিশালী, সুন্দর, কিন্তু মানুষের মতোই ভঙ্গুর। কখনো এমন কিছু ঘটতে পারে, যা মানুষের জীবনে গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে যায় এবং মেরামত করা অসম্ভব বলে মনে করা হয়। তবে সেসব পরিস্থিতি অতিক্রম করা এবং অনেক বেশি মূল্যবান এবং শক্তিশালী বন্ধন দিয়ে ভাঙা জায়গাগুলো মেরামত করাও যে জীবনের একটি অংশ, কিন্টসুগি শিল্প থেকে আমরা তা জানতে পারি। আপনি কীভাবে নিজেকে নিরাময় করতে পারেন এবং আপনার ভাঙা জায়গাগুলো মেরামত করতে পারেন, তা আবিষ্কার করতে পারেন এই শিল্পের মাধ্যমে। কিন্টসুগি আপনাকে আপনার দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করতে পারে।
জাপানিরা তাদের ঘরে কিন্টসুগি শিল্পের তৈরি শো-পিস রেখে দেয়। যখন তাদের মেন্টাল ব্রেকডাউন হয়, তারা ওই শো-পিসগুলোর দিকে তাকায় এবং সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়, বুকে বাঁধে নতুন আশা। এসব শো-পিস তাদের জীবনের ভুলত্রুটি কিংবা ব্যর্থতা উদযাপনের স্মারক। এ ব্যাপারটা তাদের ক্ষেত্রে ম্যাজিকের মতো কাজ করে।
জাহ্নবী