মানুষ স্বভাবতই সামাজিক। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে পছন্দ করে তারা। আর সে সমাজে আছে নানা নিয়ম-নীতি, আচার-সংস্কৃতি। সমাজের নানা ধরনের আচার, সংস্কৃতি, প্রথা, রীতি-নীতি নিয়ে তৈরি হয় লোকাচার। লোকাচার দেশ-জাতির পরিচয় বহন করে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত এসব লোকাচার দেশ, জাতি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। তবে পৃথিবীতে এমন কিছু লোকাচার আছে যা খুবই অদ্ভুত। বিভিন্ন দেশ ও জাতির এসব অদ্ভুত লোকাচার নিয়ে জানাব আজকে।
বসনিয়ার বসন্ত উৎসব: বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার লোকেরা নতুন বছর শুরু করে ডিম দিয়ে। একে বসন্ত উৎসবও বলা হয়। বসন্তের প্রথম দিনে বসনা নদীর তীরে কাম্বেরোভিকা মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এ উৎসব। যেখানে সব লোক জড়ো হয়। নদীর ধারে একটি বড় প্যানে ডিম ভাঙা হয়। তারপর তা ভেজে খায় লোকজন। বসনিয়ার সংস্কৃতিতে ডিম নতুন জীবনের প্রতীক। তাই তারা নতুন বছর শুরু করে ডিম খেয়ে। এই উৎসবকে বলা হয় সিম্বুরিজাদা বা ফেস্টিভ্যাল অব স্ক্র্যাম্বলড এগ।
প্লেট ভেঙে নতুন বছর উদযাপন: নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ডেনিশরা অদ্ভুত এক রীতি পালন করে। ডেনমার্কের লোকেরা নববর্ষের জন্য ভাঙা প্লেট, থালা-বাসন, কাপ, বাটি সংরক্ষণ করে। তারপর তা নতুন বছরের শুরুতে বন্ধু-বান্ধবদের বাড়ির সামনে রেখে আসে। নতুন বছরে শুভেচ্ছা জানাতে ডেনিশরা ভাঙা বাটি, প্লেট ব্যবহার করে। তারা মনে করে এতে সৌভাগ্য আসে। এই অদ্ভুত রীতিটি ‘স্ম্যাশিং প্লেট’ বা ‘প্লেট স্ম্যাশিং’ নামে পরিচিত।
বুলেট পিঁপড়ার কামড়: ব্রাজিলের অ্যামাজন রেইন ফরেস্টের সাতেরে-মাওয়ে উপজাতির মধ্যে এক ভয়ংকর রীতি প্রচলিত আছে। সাতেরে-মাওয়ে উপজাতির মতে একটি ছেলে মানুষ হতে পারে না যতক্ষণ না সে বুলেট পিঁপড়ার কামড় সহ্য করতে পারে। সাতেরে-মাওয়ে উপজাতিদের রীতি হলো অল্পবয়সী ছেলেদের বুলেট পিঁপড়ার দীক্ষা দেওয়া হয়। অল্পবয়সী ছেলেদের হাতে গ্লাভসবন্দি করে সেখানে পিঁপড়া দেওয়া হয়।
এই বুলেট পিঁপড়ার কামড় বুলেটের আঘাতের মতোই যন্ত্রণাদায়ক। পিঁপড়ার দংশন যারা সহ্য করতে পারবে তারাই যোদ্ধা হতে পারবে। যন্ত্রণা না মানলে তারা দীক্ষায় ব্যর্থ হয়। পিঁপড়ার বিষের ফলে উভয় হাত এবং নিচের বাহু সাময়িকভাবে অবশ হয়ে যায় এবং ছেলেরা গুরুতর ব্যথা, পুরো শরীরের অনিয়ন্ত্রিত কম্পন এবং হ্যালুসিনেশনে ভুগতে পারে, যা সাধারণত বেশ কয়েক দিন স্থায়ী হয় যতক্ষণ না তারা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়। এই উপজাতির ছেলেরা সাধারণত যোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার আগে বেশ কয়েক মাস ধরে প্রায় ২০ বার এই দীক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়।
মৃতদের সঙ্গে বসবাস: ইন্দোনেশিয়ার তানা তোরাজার বাসিন্দাদের অদ্ভুত এক রীতি আছে। যেখানে মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে হাঁটা হয়। মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে বিশেষ উৎসব করা হয়। বিশাল কুচকাওয়াজ হয়। পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার ঘন জঙ্গলের গভীরে, তানা তোরাজা ‘স্বর্গীয় রাজাদের দেশ’ হিসেবে পরিচিত। এখানকার বাসিন্দারা মনে করেন মৃত ব্যক্তিও পারিবারিক প্রাত্যহিক জীবনের অংশ।
এখানে কেউ মারা গেলে তাকে সমাধিস্থ করা হয় বহু বছর পর। মৃত ব্যক্তিদের বিশেষ রাসায়নিক দিয়ে মমি বানিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এমনকি মৃত ব্যক্তিদের খাবারও দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবিও তোলা হয়। আবার বহু বছর পর যখন তাদের সমাধিস্থ করা হয় তখন বেশ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়। তবে মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে বসবাস করার এই প্রথা এখন প্রায় বিলুপ্ত।
তিন দিন নিষিদ্ধ টয়লেট: ইন্দোনেশিরাই আরেকটি অদ্ভুত প্রথা রয়েছে টিডং জাতির মধ্যে। টিডং জাতি একটি স্থানীয় গোষ্ঠী যা বোর্নিওর উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে উদ্ভূত এবং ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার সীমান্তের উভয় পাশে বসবাস করে। এই উপজাতির বিবাহ রীতিতে একটি প্রথা আছে। যেখানে বিবাহ অনুষ্ঠানের পরে নতুন দম্পতিকে একটি নির্দিষ্ট ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাদের বিয়ের প্রথম তিন দিন কাটাতে হয়। এই তিন দিনের মধ্যে তাদের টয়লেট ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এমনকি যখন তাদের প্রয়োজন হয় তখন তিন দিনের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের এটি ধরে রাখতে হবে। টয়লেট ব্যবহার করা এড়াতে তাদের অল্প পরিমাণ পানি এবং খাবার দেওয়া হয়। দম্পতিদের তিন দিন মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাহারা দেওয়া হয়। যাতে তারা নিয়ম ভঙ্গ না করে।
টিডং উপজাতির বিশ্বাস বিবাহের পর এই তিন দিন যারা চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হয় তারাই একটি স্থায়ী/দীর্ঘস্থায়ী দাম্পত্য জীবন অর্জন করতে সক্ষম হবে এবং যারা ব্যর্থ হবে তাদের দাম্পত্য জীবনে দুর্ভাগ্য হবে। তাই টিডং উপজাতিরা এই অনুষ্ঠানটি গুরুত্ব সহকারে পালন করে।
দারুচিনি নিক্ষেপ: ডেনমার্কে কেউ যদি ২৫ বছর বয়সে অবিবাহিত থাকে তাহলে তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর পাঁচ বছর তাকে সময় দেওয়া হয়। ডেনমার্কের একটি রীতি প্রচলিত আছে, যেখানে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত কেউ অবিবাহিত থাকলে তাকে রাস্তার ধারে গাছের বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর তাকে তার পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব মিলে দারুচিনির স্তূপ নিক্ষেপ করে। সারা শরীর ঢেকে যায় দারুচিনি দিয়ে। যদি ৩০ বছরেও কেউ বিয়ে না করে তাহলে তাকে মরিচ নিক্ষেপ করা হবে। কখনো কখনো ডিমও ছুড়ে দেওয়া হয়। ডেনমার্কে এই রীতি শত শত বছর ধরে চলে আসছে। এই অদ্ভুত রীতির প্রচলন হয়েছে মসলা ব্যবসায়ীদের থেকে। কেননা তারা ব্যবসার কাজে বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরিত হতো। তাই আর বিবাহ করা হয়ে উঠত না।
মরদেহের সঙ্গে নাচ: মাদাগাস্কারের মালাগাসি জনগণের একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ঐতিহ্য হলো ফামাদিহানা। যেখানে মৃত ব্যক্তির শরীর নিয়ে নাচা হয়। এখানকার লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের কবর থেকে তুলে নতুন কাপড়ে মুড়িয়ে নেয়। তারপর কাঁধের ওপর নিয়ে গানের তালে নাচতে থাকে। কাপড়ে তাদের নাম লেখা থাকে। তাদের মতে এভাবে মরদেহকে সম্মান জানানো হয় এবং তাদের স্মরণ করা হয়। মাদাগাস্কারে প্রতি পাঁচ-সাত বছরে এই অনুষ্ঠান করা হয়। তবে বর্তমানে ফামাদিহানা অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে।
সূত্র: ইন্ডিপেন্ডেন্ট, মিডিয়াম ও উইকিপিডিয়া
কলি