![মুক্তিযুদ্ধে দেখেছি সন্তান ও সহযোদ্ধার নিথর দেহ](uploads/2023/12/02/1701505915.rk.jpg)
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয়টি মাস। এই নয় মাসকে কেন্দ্র করেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম আনন্দ-বেদনার স্মৃতি। আমি প্রত্যক্ষ করেছি একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়, দেখেছি সহযোদ্ধার লাশ আর আপন সন্তানের নিথর দেহ।
যৌবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী ঢাকা শহরের গণ আন্দোলনের অনেক কর্মকাণ্ডেই ছিল আমার সক্রিয় অংশগ্রহণ। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল। ২৫ মার্চ ক্র্যাক ডাউনের পর ২৭ মার্চ হেঁটে, রিকশা এবং নৌকায় অনেক কষ্টে নরসিংদী পৌঁছলাম। চলতে লাগল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। যোগাযোগ হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত মেজর নূরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি ক্যাপ্টেন মতিউরকে পাঠালেন যুদ্ধ প্রস্তুতির সার্বিক পরিস্থিতি জানার জন্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে গিয়ে ক্যাপ্টেন মতিউর আবার নরসিংদী এলেন ৩০ মার্চ, সঙ্গে বহু ইপিআর সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রসহ। নরসিংদীর জনগণ উজ্জীবিত হয়ে ঢাকা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। ২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন মতিউরের পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম।
বিকালে নরসিংদীর পাঁচদোনা পৌঁছলে পাকবাহিনী নৌ, রেল ও স্থল তিন দিক থেকে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে শুরু হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ। শত্রু বাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। তাদের অতর্কিত আক্রমণে আমরা হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও অসীম সাহসিকতায় যুদ্ধ চালাতে থাকলাম। মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখলেও কোনো এক আমোঘ আকর্ষণে হৃদয়ে প্রলয় নাচন শুরু হলো। উপলব্ধি করতে লাগলাম সুসংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের।
নরসিংদীর স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রস্তুতি নিলাম ভারত যাওয়ার। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকামীদের প্রথম এবং সহজতম আশ্রয়স্থল ছিল ত্রিপুরার আগরতলা। আগরতলা পৌঁছলাম। পেলাম পরিচিত মুখ মেজর নূরুজ্জামানসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী ও ঢাকার অনেক সংগঠকের। আগরতলা মুখরিত হলো মুক্তিকামী বাঙালিদের পদভারে। বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, যে মামলাকে কেন্দ্র করেই ফাঁসিতে ঝোলানোর চেষ্টা করা হয়েছিল জাতির পিতাকে। বিস্ময়করভাবে সেই আগরতলাই হয়ে উঠল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ডেডলাইন।
ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। ত্রিপুরার ভৌগোলিক অবস্থান অদ্ভুতভাবে গাঁথা বাংলাদেশের সঙ্গে। ভারতের অন্যান্য অংশ যেখানে একদিক থেকে বেঁধে রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ তিন দিক থেকে আলিঙ্গন করে আছে ত্রিপুরাকে। মহারাজাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা যেমন ইতিহাস তেমনি ১৯৭১-এর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে পরবর্তী প্রজন্মের ত্রিপুরাবাসীর তেমন ইতিহাস।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশের অভ্যন্তরে গিয়ে এমপি, মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দিলে আমি ১ জুন হোমনার এমপি অধ্যাপক মোজাফফর আলী ও ছাত্রলীগ নেতা আলীসহ হবিগঞ্জের মাধবপুর বর্ডার দিয়ে দেশে প্রবেশ করি। রাত ২টা ৩০ মিনিটে বর্ডার ক্রস করতে সাহায্য করলেন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন। সকালে চারগাছ বাজারে চা-নাস্তা করার সময় লক্ষ্য করলাম স্থানীয় লোকজন আমাদের সন্দেহের চোখে দেখছে। সে সময় দেশে শত্রু-মিত্র চেনা খুবই দুরূহ ছিল। সে কারণে দেরি না করে হোমনার উদ্দেশে রওনা হলাম। সারা দিন চলার পর রাতে ঝড়-বাদলে মাঝি পথ হারিয়ে ফেলাতে অনেক কষ্টে ৩ জুন সকালে মোজাফফর আলী এমপির এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠলাম। পরদিন সকালে বাঞ্ছারামপুরের এমপি মহিউদ্দিনের খোঁজে তার এলাকায় গিয়ে তাকে পেলাম ডোমরাকান্দিতে। এরপর রায়পুরার এমপি আফতাব উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হলো নিলিক্ষায়। শিবপুর-মনোহরদীর এমপি ফজলুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় হাইরমারা গ্রামে। তাদের সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর মেসেজ জানাই এবং তারা সবাই আগরতলায় তথা ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হন। এভাবে ২১ জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে এমপি, মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিকামী বাঙালিদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে আলোচনা ও সাক্ষাৎকার কার্যক্রম চালাই। ২২ জুন নিজ গ্রাম নরসিংদীর আলোকবালীতে যাই। অপেক্ষা করছিল দুঃসংবাদ। জানতে পারলাম আমার সন্তান বিপ্লবের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সংবাদ। চলতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ। আমাদের বাড়িতে ২৯ জুন রাতে পরিবার-পরিজনসহ এলেন নরসিংদীর এমপি মোসলেহউদ্দিন। তাকে পেয়ে আমার কাজে অনেকটাই সুবিধা হলো। এ সময় আলোকবালী নিরাপদ নয় ভেবে পরিবার-পরিজন স্থানান্তর করলাম বাঞ্ছারামপুরে। সেখানেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলো আমার ছোট মেয়ে সুইটি। পরে সেও হোমনাতে মারা গেল এক প্রকার বিনা চিকিৎসায়। পরিবার-পরিজন রেখে ৩০ জুলাই আবারও ঢাকার পথে রওনা হলাম। পায়ে হেঁটে, নৌকায়, রেলপথে ও রিকশায় অনেক কষ্টে ঢাকায় পৌঁছলাম ৩ আগস্ট রাতে। ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, মাণ্ডা, মুরাদপুর ও আশপাশের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে ১৭ আগস্ট নরসিংদী রওনা হয়ে ১৯ আগস্ট পৌঁছালাম। নরসিংদী তখন ভীষণ উত্তপ্ত। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দৌরাত্ম্য তখন চরমে। এর মধ্যেই বাড়াইল হয়ে আমার গ্রাম আলোকবালীতে পৌঁছালাম। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশনা দিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর ভোরে আবারও রওনা হলাম আগরতলার উদ্দেশে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের চোখ এড়িয়ে দু-এক জায়গায় ছদ্মবেশে অনেক বিপদ এড়িয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করলাম। ২৫ সেপ্টেম্বর মেজর নূরুজ্জামান ও ২৬ সেপ্টেম্বর গাজী গোলাম মোস্তফাকে দেশের অভ্যন্তরের যুদ্ধ পরিস্থিতি বর্ণনা করলাম। এরপর ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে গাজী গোলাম মোস্তফা ও আমি আগরতলা, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবির পরিদর্শন এবং অন্যান্য সাংগঠনিক কাজে ভারতেই ছিলাম, দেশে আর আসা সম্ভব হয়নি। সেখানে আমরা নিয়মিত তাদের খোঁজ নিয়েছি এবং খাবারসহ যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করেছি।
সেখান থেকে দেশে এলাম ১৪ ডিসেম্বর মেজর হায়দারসহ হেলিকপ্টারে কুমিল্লায়। পরে নরসিংদী হয়ে ঢাকায় এলাম ১৫ ডিসেম্বর বিকালে। যাত্রাবাড়ীতে সেদিনই বিজয় উল্লাস। সেই স্মৃতি সারাজীবন মনে রাখার মতো, জনতা মেজর হায়দার ও আমাকে মাথায় নিয়ে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় নাচতে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর কাটল আনন্দ আর উৎকণ্ঠায়। অবশেষে এলো জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন ১৬ ডিসেম্বর। ঢাকা ক্লাব থেকে আনা হলো চেয়ার-টেবিল, যে টেবিলে স্বাক্ষরিত হলো বাঙালির বিজয়ের দলিল। ১৬ ডিসেম্বরের সেই দৃশ্য সুখ-স্বপ্ন হয়ে আছে এখনো।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ