![পাকিস্তানের নির্বাচন এক বিস্ময়কর চমক](uploads/2024/02/11/1707626798.nasim-jehra.jpg)
পাকিস্তানের এবারের নির্বাচন ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত। তারপরও নির্বাচনের ফলাফল যখন আসতে শুরু করে, তখন পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের ভেতরে একটা স্বস্তি ফিরে আসে।
পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান। বহু মাস ধরে তিনি কারাবন্দি এবং শত মামলার অভিযোগে অভিযুক্ত। তিনি এবারের নির্বাচনে প্রতিষ্ঠিত দলের বিপক্ষে তার রাজনৈতিক দলকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও বিজয়ী করতে পেরেছেন। অনেকে বিশ্বাস করেন, সংসদের বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র দ্বন্দ্ব ও তিক্ততাই তাদের এই বিজয়ের পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। নির্বাচনে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদ দিলে সব রাজনৈতিক দলের সমঝোতায় এই ফলাফল হয়েছে।
ভোটের অনেক বিস্ময়কর ফলাফলের মধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য হলো- এক. পাকিস্তান মুসলিম লিগ-এন (পিএমএল-এন) ২০১৮ সালে হাস্টিংয়ে পরাজিত হওয়ার পর তারা আবার ক্ষমতায় আসার জন্য চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল তাদের ব্যাপকভাবে হতাশ করেছে।
পিএমএল-এন এবং তার তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ আশা করছিলেন, তাদের জয়ের জন্য সবকিছুই পরিষ্কার এবং পথ খোলা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এই দলটি জাতীয় সংসদের ২৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি আসনে জয়লাভ করতে পারেনি। এর মানে পিএমএল-এন নিজে থেকে সরকার গঠন করতে পারবে না। পাকিস্তানের প্রধান প্রদেশ পাঞ্জাবে পিএমএল-এন সরকার গঠন করতে পারে। তাই পিএমএল-এনের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
যদিও পুরো শরিফ পরিবার অন্তত ছয়টি নিজ নিজ আসনে জিতেছে। খুররম দস্তগীর এবং রানা সানাউল্লাহর মতো প্রভাবশালী মন্ত্রীসহ পিএমএল-এনের অনেক বড় নেতা তার নিজ আসনে হেরেছেন।
প্রকৃতপক্ষে পাঞ্জাবের প্রধান শহরগুলো, যেমন- গুজরানওয়ালা, ফয়সালাবাদ, শেখুপুরাসহ কিছু আসনে হেরে যাওয়ার কারণে পিএমএল-এনের মূল গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পরিচয় আপাতত মুছে গেছে।
দুই. ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পিটিআই পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল নির্বাচনে ভালো ফল করবে বলে আশা করা হয়নি। কারণ ২০২৩ সালের ৯ মে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী পিটিআইকে হঠানোর পর ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করে। এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কমান্ড পিটিআই-এর বড় পরাজয় দেখতে চেয়েছিল। অনেকেরই ধারণা ছিল, নির্বাচনে পিটিআই দলকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার জন্য সেনাবাহিনী সম্ভাব্য সব উপায় ব্যবহার করবে। নির্বাচনের কারণে ইমরান খানের সমর্থনে ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাওয়া পিটিআই সদস্যদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার, গ্রেপ্তার, হয়রানি, লক্ষ্যবস্তুতে হামলা এবং আইন প্রয়োগকারী বাহিনী দ্বারা হেনস্তা করা হয়েছিল।
জনগণ তাদের দৃঢ়সংকল্প এবং ক্ষমতাসীন দলের নিপীড়নের দাঁতভাঙা জবাব তাদের ভোটের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। কারণ সামরিক বাহিনীর মদদে পিটিআই সদস্যদের বিরুদ্ধে সন্দেহজনক বিচারিক পদক্ষেপ এবং তাদের দলনেতা ইমরান খানকে কারাদণ্ড দিয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।
ইমরান খান দেখিয়েছেন যে, জনগণের শক্তি পাকিস্তানে অগণতাত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বিচার বিভাগ পিটিআইকে নির্বাচনি প্রতীক ছাড়াই ছেড়ে দিয়েছে এবং নির্বাচনের সময় দলটিকে কার্যকরভাবে অস্তিত্বহীন করে দিয়েছে। পাকিস্তানি ভোটারদের জন্য পিটিআইয়ের জাতীয় ও প্রাদেশিক প্রার্থীদের স্বতন্ত্র নির্বাচনি প্রতীক দেওয়ার একটা দীর্ঘ পরিকল্পনা ছিল ক্ষমতাসীনদের। এত কিছুর পরও সারা দেশে পিটিআই সমর্থকরা তাদের প্রার্থীদের ভোট দিতে পেরেছেন।
নির্বাচনের ফলাফলে পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা ৯৯টি আসন পেয়ে পিএমএল-এন ও পিপিপির চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপিকে) পিটিআই ভোটে জয়লাভ করেছে। এমনকি দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রান্তিক আসন ও প্রধান বন্দরশহর করাচিতে পিটিআই বেশ কয়েকটি আসনে জয়লাভ করেছে।
তিন. প্রধান পিটিআই নেতারা (বিশেষ করে ইমরান খানের ডেপুটি), যারা তাকে ত্যাগ করে বিচ্ছিন্ন দল গঠন করেছিল তারাও ভোটে পরাজিত হয়েছেন। ইমরান খানের একসময়ের প্রধান আস্থাভাজন ও সমর্থক জাহাঙ্গীর তারিন এবং তার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পারভেজ খট্টক উভয়েই সংসদ নির্বাচনে আসন পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। ইমরান খানকে পরিত্যাগ করে অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়েছে তাদের। খট্টকের দলের পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা খট্টক পরিবারের সাত সদস্যের প্রত্যেকেই হেরে গেছেন।
তারপরও পিটিআইয়ের জন্য সবকিছু অনুকূলে নয়, কারণ কয়েকটি আসনের প্রতিযোগীরা তাদের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাদের দাবি, নির্বাচনের ফলাফল পদ্ধতিকে পিটিআইয়ের সদস্যরা প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে আদালতে গেছেন। পরবর্তী সরকারে আইনি লড়াইয়ে পিটিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
পিটিআইয়ের জন্য এখন অনেক কঠিন সময়। কারণ ৯ মে বিষয়টি কীভাবে শেষ করা হবে তা এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
পিটিআইয়ের কারাবন্দি, দণ্ডিত এবং দোষী সাব্যস্ত নেতা ইমরান খানকে নিয়ে পাকিস্তানের জনগণ আশাবাদী।
লেখক: ভিজিটিং প্রফেসর, কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়, পাকিস্তান
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল