ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

সরকারের পদক্ষেপ আর জনগণের আক্ষেপ

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০৫ এএম
আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০৫ এএম
সরকারের পদক্ষেপ আর জনগণের আক্ষেপ
রাজেকুজ্জামান রতন

সরকার বলছে, মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ে সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জনগণের স্বার্থে আর জনগণ দেখছে প্রতিটি সরকারি পদক্ষেপের পর দ্রব্যমূল্য তো কমেই না বরং ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোর অজুহাত তৈরি হয়। যেমন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদহার বৃদ্ধি করা হলো। বলা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর লক্ষ্যে সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে, বাড়বে পণ্যের দাম। ভুক্তভোগী শেষে সেই ভোক্তারাই। আর একটি উদাহরণ, গত ২১ মার্চ বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর চার দিন পরেই সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা বেড়ে গেল।  

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সরকারের প্রধান কর্মসূচি, এই কথা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত বলে চলেছেন আর পাল্লা দিয়ে বাজার ক্রমাগত চড়া হচ্ছে। রমজানে দাম বাড়ানো চলবে না এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে এই ঘোষণাও বাস্তবে অকার্যকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাই চায় ঘোষণার বাস্তবায়ন আর আশঙ্কায় আছে ঈদযাত্রায় যানবাহনের ভাড়া ও ভোগান্তি নিয়ে। কেন ভোক্তারা আশা করে দ্রব্যমূল্য কমুক? কারণ দাম বাড়লে তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। যে মানুষের মাসিক আয় নির্দিষ্ট, সে চাইলেই তার আয় বাড়াতে পারে না। অথচ চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, লবণ, চিনি সবকিছুর দাম বেড়েছে এবং বাড়ছে। তখন সে কী করবে? সে সরকারকে দায়ী করে সরকার সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করছে না বলে আর নিজেকে দায়ী করে আয় বাড়াতে পারছে না বলে। কিন্তু ব্যবসায়ীকে বা বিক্রেতাকে কিছু বলতে পারে না, কারণ সে অসহায় বলে। এর প্রভাব কি সমাজে পড়ে না? অবশ্য পড়লেই বা কি যায় আসে যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের? তারা উদাহরণ দেন অতীতের, ইউরোপের এবং গালভরা বর্ণনা দেন নিজেদের কর্মতৎপরতার। 

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে সরকারি যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা হলো ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। কিন্তু বাজারে গেলে ক্রেতাদের কাছে তা কি  বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়? একেবারেই না। কারণ গড় হিসাব করা হয় ৭২২টি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ধরে আর সাধারণ মানুষ প্রতি মাসে বাজার থেকে যেসব পণ্য কিনে থাকে তা গড়ে ৬০টি। এগুলোর গড়ে দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। এই ৬০টির মধ্যে অনেক পণ্য আছে যেগুলোর দাম বেড়েছে ৫-১০ শতাংশ। আবার বাজারের তালিকায় এমন পণ্য আছে যেগুলোর দাম বেড়েছে অত্যধিক, অর্থাৎ ৩০-৪০ শতাংশ। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যা বেশি ব্যবহার করে সেসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। 

ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত তো ছিলই। এর বাইরে নানা অজুহাতে কয়েক মাস ধরেই বাজারে সব নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন উপলক্ষ রোজা। ফলে বাজারদর আরও আকাশচুম্বী। নিত্যপণ্যের সঙ্গে ইফতারির উপকরণের দাম বাড়ার যন্ত্রণায় পুড়ছেন এবং পুড়বেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তা। অর্থনীতির চাহিদা ও জোগানতত্ত্ব না বুঝলেও মানুষ এটা ধরে নিয়েছে যে, সরকারের দুর্বল এবং ব্যবসায়ী সহায়ক ভূমিকার কারণে রমজান ঘিরে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার ইচ্ছায় লাগাম টানা যায়নি। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যতই হুমকি-ধমকি দেওয়া হোক না কেন, ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব ছকে নিয়ন্ত্রণ করে বাজার।  

সরকার বলে, সিন্ডিকেট কিছু নেই, আসলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে থাকে। এরা সরকারের উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলায় এবং বিরোধী দলগুলো তাদের সহায়তা করে। তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতেই পারে, এ ক্ষেত্রে সাধু ব্যবসায়ীদের ভূমিকা কী? আসলে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মুনাফাই প্রধান চালিকাশক্তি। এখানে ব্যক্তিগতভাবে সাধু-অসাধু হওয়া কোনো বিষয় নয়, ব্যাপারটা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ক্ষমতা আর সরকারের আনুকূল্য। ফলে দু-একটা লোক দেখানো পদক্ষেপ নিলেও তেমন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা কারও বিরুদ্ধে নেওয়া হয় না দেখে তারা বুঝতে পেরেছেন এসব হুমকি-ধমকিতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাজার চলবে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছার গতিতে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভোগ সবই তাদের দাম বাড়ানোর মওকা এনে দেবে বারবার। 

দ্রব্যমূল্য আর জীবনযাত্রার মধ্যে তাল মেলাতে হিমশিম খাওয়া মানুষের কাঁধে আবার সমন্বয়ের নামে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। ফলে সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবনে। সাধারণ হিসেবে দেখা যায় পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে মাসে ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে প্রায় দুই হাজার টাকা। কোথা থেকে আসবে এই টাকা। তারা কি দুর্নীতি করবেন? চাইলেই কি সবাই দুর্নীতি করতে পারবেন? তাহলে উপায় কী? পথ একটাই, খরচ কমানো। বিবিএস-এর জরিপে দেখা যাচ্ছে দেশের মানুষের চাল এবং ডিম খাওয়া কমেছে। রমজান উপলক্ষে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের পাত থেকে আরও খানিকটা খাবার কমতে বাধ্য। রোজার অজুহাতে বাজারকে অস্থির করে সাধারণ মানুষের স্বস্তি কেড়ে নেওয়া তো চলছেই। সরকার সজাগ আছে, তৎপর আছে এসব ঘোষণা মানুষ শুনছে কিন্তু ঘোষণার ফল মানুষ দেখেনি, ভবিষ্যতে দেখবে সে আশা খুবই ক্ষীণ।    

একে তো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জীবনকে বিপন্ন করছে, তার সঙ্গে যদি বিকল্পের নামে উদ্ভট পরামর্শ দেওয়া হয় তাতে মানুষ আরও হতবাক হয়ে পড়ে। একদিকে রাষ্ট্রের প্রধান মজুতদারদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, এরা পণ্য পচিয়ে ফেলবে তবু সস্তায় বিক্রি করবে না। অন্যদিকে যাদের দায়িত্ব এসব মজুতদারকে ধরা বা নিয়ন্ত্রণ করা তারা বলছেন, জনগণেরও কিছু দায়িত্ব আছে। জনগণের দায়িত্ব কী, তাও তারা বলে দিয়েছেন, প্রথম দায়িত্ব কম কেনা, কম খাওয়া, দ্বিতীয় দায়িত্ব বিকল্প খুঁজে বের করা আর তৃতীয় দায়িত্ব, দাম বাড়লেও খেতেই হবে এই মানসিকতা পরিহার করা। প্রয়োজনে খাবেন না, তারপর দেখুন দাম কমে কি না! মানুষের সামর্থ্য না থাকলে মানুষ খায় না, কেনে না- এই নিয়মে তো মানুষ অভ্যস্ত। ফলে সেই পরামর্শ দেওয়ার জন্য ট্যাক্সের পয়সা খরচ করে মন্ত্রী, আমলার বেতন ভাতা দিতে হবে কেন? এই প্রশ্ন জনগণ করতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। 

সন্তানসন্ততি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ মানুষকে দেওয়া পরামর্শের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয় সম্ভবত কষ্ট সহ্য করার পরামর্শ। জীবনের দুঃখকে অনেক সময় অতিক্রম করা অসম্ভব বলে কৌতুক করে উড়িয়ে দেওয়ার উদাহরণ পৃথিবীর সব দেশে এবং সব ভাষাতেই আছে। সেই যে একটা কৌতুক আছে না! জীবন যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ যুবক গেছে গুরুজনের কাছে সমাধানের আশায়। গুরুজন অভিজ্ঞ মানুষ। সব শুনে বললেন, কষ্ট করে কিছুদিন সহ্য কর বাবা! যুবক খুশিতে মুখটা উজ্জ্বল করে জানতে চাইল, তারপর আর দুঃখ থাকবে না বাবা? গুরুজন গভীর ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে আশ্বাস দিয়ে বললেন, না রে বাবা, তখন দুঃখকে আর দুঃখ মনে হবে না। তোর সব সহ্য হয়ে যাবে। বাংলাদেশেও দ্রব্যমূল্য বাজার পরিস্থিতি নিয়ে এমন পরামর্শ দেওয়াটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে, কথার মারপ্যাঁচে কি কষ্ট নিরাময় হয়? হয় না। জীবনের সংকটগুলো ঘনীভূত হয়। অসন্তোষ বাড়ে, বিক্ষোভের পটভূমি তৈরি হয়। অর্থনীতিতে তৈরি হয় নেতিবাচক প্রবণতা। দাম বেশি বলে কিনবে কম অথবা কিছু জিনিস কেনা বাদ দিলে খাদ্যপুষ্টির অভাব শুধু জীবনের গতি কমায় না, অর্থনীতির গতিকেও কমিয়ে দেয়। আর বাড়তে থাকে জনসাধারণের আক্ষেপ।   

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)

সবার পরামর্শ নিয়ে সরকারের কাজ করা উচিত

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৫০ এএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৫০ এএম
সবার পরামর্শ নিয়ে সরকারের কাজ করা উচিত
নূর মোহাম্মদ

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে দেশে যে অরাজকতা বিরাজ করছিল তা এখন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যে কঠিন সহিংসতা ঘটে গেছে তা খুবই ভয়ংকর। গত কয়েক দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে দুর্বিষহ সময় গেল তা চিন্তার বাইরে। মানুষের মধ্যে নানা রকম উৎকণ্ঠা, শঙ্কা ও ভয়ভীতি কাজ করেছে। দেশে কী হতে যাচ্ছে বা ভবিষ্যতে কী হতে পারে, এমন নানাবিধ শঙ্কা। সরকার এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছে বলে মনে হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোটা সংস্কার নিয়ে যে দাবি তুলেছিল তা যৌক্তিক ছিল। মেধার ভিত্তিতে চাকরি হোক। গণপ্রজাতন্ত্রের চাকরিতে যে কোটা ছিল তা নিচের দিকে নামিয়ে আনা। এগুলো খুবই যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য দাবি ছিল। এই দাবি আদায়ে যে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল এবং জানমালের ক্ষতি হলো তা খুবই কষ্টদায়ক। সরকারি অনেক স্থাপনা নষ্ট হলো। 

সেতু ভবন, বিটিভি ভবন, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। কোনো দেশপ্রেমিক এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে না। এর দায়ভারটা কে নেবে? সরকারের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট ছিল বা যারা পরামর্শক ছিলেন, তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। এই সিদ্ধান্ত যদি আগেই দিতে পারত, তাহলে এমন সহিংসতা হতো না। তাহলে এতগুলো মানুষের প্রাণ হারাতে হতো না। 

নাশকতায় স্থাপনা ধ্বংস হতো না। আমি মনে করি, এখানে কিছুটা ভুলভ্রান্তি হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত ভুলভ্রান্তিও হতে পারে। এত দ্রুত সহিংসতা বেড়ে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হবে তা আগে কেউ ভাবতে পারেনি। দেশের সবকিছুর পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে এলেও এই মানুষগুলোকে আর ফেরত পাওয়া যাবে না। প্রাণ হারানো মানুষগুলোর পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন। দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হলো, এর দায়ভার কে নেবে?

দেশের মানুষের মধ্যে ভয়ংকর এক অবস্থা বিরাজ করছে। আন্দোলন তো সব সময়ই হয়। এবারের ছাত্র আন্দোলনকে পুঁজি করে বিরোধী পক্ষ কিছু একটা করে সরকারকে দেখাতে ও বোঝাতে চেয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রেও বিরোধীরা এমন আচরণ করে থাকে। সরকারের দুর্বলতা সব সময় খুঁজতে থাকে বিরোধীরা বা তৃতীয় পক্ষ। কিন্তু এভাবে সরকারি স্থাপনা নষ্ট করা মোটেও কাম্য নয়। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

দেশ হঠাৎ করে যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়, তাহলে স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবেই। আমার মনে হয়, সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে তাতে অচিরেই দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করার চেষ্টা করছে। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত বা দেশের মিলিটারি যা বলে সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপরি শান্ত হয়ে যাবে। এখন যে অবস্থা তাতে সারা দেশে ছোটখাটো দুর্ঘটনা হতে পারে। বড় কোনো সংঘাত তৈরি হওয়ার মতো অবস্থা নেই। 

অন্যভাবে বলা যায়, যদি বেহালায় একটা টান দেওয়া হয়, তাহলে প্রথমে বড় একটা শব্দ করবে। তার পর ধীরে ধীরে সেই শব্দ বিলীন হতে একটু সময় লাগে। তেমনি দেশের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে একটু সময় নেবে। তার পরও সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে বলে মনে করি।

দেশের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায়ও একটু ঘাটতি ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গোয়েন্দাদের এমন দুর্বলতা থাকে। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গুলি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার ক্ষেত্রেও গোয়েন্দারা সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। গোয়েন্দাদের নজরদারি সব সময় সঠিক হয় না। তাদেরও কিছু ব্যর্থতা বা সচেতনতার অভাব থাকে।

যেহেতু কোটা সংস্কারের বিষয়টি সরকার আগে থেকেই জানত, সে ক্ষেত্রে ছাত্রদের এই আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত ছিল। সরকারের যে ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল সেটা নিতে পারেনি। 

দেশে আন্দোলন বড় রূপ ধারণ করলে স্বাভাবিকভাবেই তা পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রতিহত করা কঠিন হয়। এবারের আন্দোলনে এত বেশি নাশকতা হয়েছে, যা হওয়া উচিত ছিল না। একটু আগে যদি এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হতো, তাহলে আন্দোলন সারা দেশে এত ছড়াতে পারত না। ছাত্র আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা বলেছিলেন, আন্দোলন আর তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সে সময় সরকার শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আবার ফিরে আসবে। সেই সময় ছাত্রছাত্রীরা তাদের অন্যান্য দাবির জন্য আন্দোলন করতে পারে। তখন সরকারকে একটু চিন্তাভাবনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। আগেই পরিকল্পনা করা ঠিক 
হবে না। ছাত্রদের আন্দোলনের ব্যাপারে ছাত্রলীগের উসকানিমূলক কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী সময়ে যাতে না বাড়ে, সে জন্য রাজনৈতিক দলসহ সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- ছাত্ররা পুনরায় দাবিদাওয়া তুললে সরকার আগে শুনবে। তারপর ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সমাধান করবে। ছাত্ররা ১০টা দাবি তুললে সরকার হয়তো ৫টা রাখল, এভাবেই সমাধানে যেতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুরই সমাধান সম্ভব। আলোচনা না করলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবেই। ছাত্রদের সঙ্গে যথাসময়ে আলোচনা করলে সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ নিতে পারত না। এসব বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদের ওপর পুলিশের গুলি করাটা খুবই অমানবিক কাজ হয়েছে। কোনোভাবেই তা মেনে নেওয়া যায় না। গুলি তখনই করে, যখন জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। পুলিশ যাকে গুলি করেছে তার দিক থেকে বড় কোনো শঙ্কা বা ভীতিকর অবস্থা ছিল না। 

সবকিছু মিলিয়ে আবু সাঈদের যে অবস্থা দেখা গেল, সে একা দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা লাঠি। সে খালি হাতে ঢিল ফেরাচ্ছে। পুলিশ তাকে গুলি করার কোনো অর্থই খুঁজে পাই না। সেই পুলিশ কনস্টেবল একদম অপেশাদারির পরিচয় দিয়েছে। একজন প্রশিক্ষণহীন মানুষের মতো কাজ করেছে। সেই কনস্টেবল একজন অবিবেচক ও অমানবিক কাজ করেছে।

দুষ্কৃতকারীরা পুলিশের ওপর আক্রমণ ও সরকারি স্থাপনায় যেভাবে আগুন দিয়েছে তা ধারণার বাইরে। দুষ্কৃতকারীদের ধারণা ছিল, এভাবে ধ্বংসাত্মক কাজ করে সরকারকে অচল করে দেওয়া যায় কি না। এ জন্যই সরকারি স্থাপনাগুলোতে আঘাত করেছে।

উচ্চ আদালত কোটা সংস্কারের যে রায় দিয়েছেন, তা যথেষ্ট সম্মানজনক। ছাত্রদের কোটা সংস্কার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তবে সরকার ইচ্ছা করলে পরবর্তীকালে নারী কোটাসহ অন্যান্য কিছু সংযোজন-বিয়োজন করতে পারে। দেশে ইন্টারনেট না থাকায় যে অচলাবস্থা হয়েছে তা মানুষের জন্য বড় দুর্ভোগ। 

আমার মনে হয়, এখনই ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া উচিত। ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া জরুরি। কিন্তু সরকারের অবস্থান থেকেও বুঝতে হবে যে, এখনই যদি ইন্টারনেট খুলে দেওয়া হয়, তাহলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না। সরকার যখন চিন্তাভাবনা করে দেখবে যে, দেশ পুরোপুরি নিরাপদে আছে, তখনই খুলে দেওয়া সম্ভব। তবে সরকার খুব দ্রুতই খুলে দেওয়ার প্রচেষ্টায় আছে।

এই মুহূর্তে সরকারের উচিত সবার পরামর্শ নিয়ে কাজ করা। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়াতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। ছাত্রদের যদি আরও কোনো যুক্তিসংগত দাবিদাওয়া থাকে; তাহলে আলোচনার মাধ্যমে কিছু দাবি মেনে নিয়েই সরকারের সামনে এগোনো উচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের এখনো কিছুটা শঙ্কা আছে। আশা করি, বৃহত্তর জনস্বার্থে সরকার অচিরেই শান্তি ফিরিয়ে আনবে।

লেখক: সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল,
বাংলাদেশ পুলিশ

কমলা হ্যারিসের নেতৃত্বই হতে পারে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বড় শক্তি

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৪৬ এএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৪৬ এএম
কমলা হ্যারিসের নেতৃত্বই হতে পারে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বড় শক্তি
সাইমন জেনকিন্স

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদের দৌড়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী এখন কমলা হ্যারিস। তাকে দেখে কিছুটা দুর্বল মনে হলেও তিনি সফল হতে চান। আমেরিকার সাবেক দুই প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে হয়। মার্কিন গণতন্ত্রে নেতাদের ব্যর্থতার সমালোচনা করা ইউরোপীয়দের দীর্ঘদিনের খেলা। 

কমলা হ্যারিস ৫৯ বছর বয়সী ক্যালিফোর্নিয়ার একজন আইনজীবী। তিনি একজন অভিবাসী শিক্ষাবিদদের মেয়ে। তার বাবা-মা দুজন দুই দেশের, একজন জ্যামাইকান এবং অন্যজন ভারতীয়। তিনি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। তিনি তার রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল এবং শেষ পর্যন্ত একজন সিনেটর হয়েছিলেন। তিনি প্রথম নারী এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। তিনি প্রথম দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান, যিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন।

যদিও মনে হচ্ছে যে, ট্রাম্প প্রচারাভিযানে কমলা হ্যারিসের জাতি এবং লিঙ্গের ওপর আক্রমণ করবেন। বারাক ওবামাও দুটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। যদিও ওবামার জাতি এবং লিঙ্গ নিয়ে সীমাহীন ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এতেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এ ধরনের প্রচারণা ভোটারদের খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না। নারীর জন্য হোয়াইট হাউসে নিশ্চয়ই প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র।

ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কৃতিত্বের কিছুটা ঘাটতি থাকলেও এগিয়ে যাচ্ছেন। মেক্সিকোর সঙ্গে সীমান্ত সংকট দিয়ে প্রথমেই তাকে বেঁধে দেন বাইডেন। তার সমালোচকরা এমনটাই দাবি করেন। অদ্রবণীয় ছিল। গর্ভপাত এবং অপরাধ নিয়ে বিভাজনে দেশীয় নীতিও বিভক্ত। প্রথমত, হ্যারিস একজন স্পষ্টবাদী প্রচারক। দ্বিতীয়ত, তিনি রক্ষণশীল বই লেখক হিসেবেও পরিচিত। 

হ্যারিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ভেঙে পড়া ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। যাতে ট্রাম্পকে থামাতে সক্ষম না হলেও কমপক্ষে এমন এক কংগ্রেসকে নির্বাচিত করা হয়, যা তার বন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম। এ জন্য ভিন্ন ভিন্ন নেতৃত্বের দক্ষতা প্রয়োজন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর্চি ব্রাউন তার চ্যালেঞ্জিং কাজ ‘দ্য মিথ অব দ্য স্ট্রং লিডার’-এ এই থিসিসটি ভেঙে দিয়েছিলেন যে, যারা সহকর্মীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকে নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে তারা সবচেয়ে বেশি সফল হন। 

তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সহকর্মীদের ওপর নেতৃত্ব দেওয়াকে প্রায়শই দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাকে বড় শক্তি হিসেবে দেখা হয়। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইজেনহাওয়ার ও রিগান এবং ব্রিটেনের অ্যাটলি ও উইলসনের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন।

ব্রিটেনে একজন নেতার ক্ষমতা মন্ত্রিপরিষদ এবং সংসদীয় দলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে কাজ করার ক্ষমতা থেকেই উদ্ভূত হয়। তেমনি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশংসা করে এবং তাদের ইচ্ছার কাছে নত করে খুব কম নেতাই জয়ী হয়েছেন। বারাক ওবামাকে বন্দুক নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যেমনভাবে দেখা গেছে। 

কমলা হ্যারিসের শক্তি নিশ্চয়ই অন্য জায়গায়। ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করতে তিনি এগিয়ে এসেছেন। কারণ অনেকেই জো বাইডেনের বিদায়কে বিভিন্নভাবে আঘাত করতে শুরু করেছিলেন। এখন তাকে ঘিরেই ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে চায়। তার নিজের কোনো নির্বাচনি এলাকা নেই। তার অংশীদার, সমর্থক, সহযোগী, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং প্রতিভাপূর্ণ একটি দল প্রয়োজন। তাদের অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ স্টেটগুলোতে সমর্থন জোরদার করতে হবে। কমলা হ্যারিসের শক্তি প্রচার করতে হবে এবং তার দুর্বলতাগুলো হ্রাস করতে হবে।

অতীতের অনেক প্রেসিডেন্টের উচ্চপদে আসীন হওয়ার অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। তবে এতে ভেঙে পড়ার দরকার নেই। অ্যাটর্নি এবং সিনেট কমিটিতে কমলা হ্যারিসের অনুসন্ধানী ক্ষমতা তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। আপনি ইতোমধ্যে শিখেছেন- এমন বিশ্বাসের চেয়ে শেখার প্রস্তুতি প্রায়শই আরও বেশি কার্যকর। 

কমলা হ্যারিস যত পরামর্শ শুনবেন, তার তত জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তার চেয়েও বড় কথা, ট্রাম্পের আরেকটি প্রেসিডেন্সি এড়াতে মরিয়া আমেরিকানদের এখন আর কোনো বিকল্প নেই। কমলা হ্যারিসকে জয়ী করতে তাকে অবশ্যই সাহায্য করতে হবে।  

লেখক: গার্ডিয়ানের কলামিস্ট
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, নজর দিতে হবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দিকে

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৫০ এএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৫০ এএম
বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, নজর দিতে হবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দিকে
শাহদীন মালিক

ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা দেখেছি। প্রথম দিকে আন্দোলন কোনো রকম সহিংসতা ছাড়াই সুশৃঙ্খলভাবে হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য শৃঙ্খলবদ্ধভাবে এই আন্দোলন করেছেন। অবরোধের মধ্যে কিছু কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ হয়েছে এ কথা অনস্বীকার্য। তবে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা সংঘটিত হতে দেখা যায়নি। 

তারপর সহসা আমরা দেখলাম চারদিকে সহিংসতা শুরু হয়ে গেল। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর করা হলো। গাড়িঘোড়া পোড়ানো হলো। নরসিংদীর জেলখানা ভেঙে ৮০০-এর মতো কয়েদি পালিয়ে গেল। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক কিছুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের সঙ্গে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে- কারা এ ধরনের সহিংস আন্দোলনের পথে গেল!

সরকারের জবাব একটাই। এ কাজ করেছে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে অবস্থিত ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের ৬০ জন রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাদের বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই কাজ সংঘটিত করেছে বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রফ্রন্ট ইত্যাদি গোষ্ঠী। 

সরকার মনে করে, বড় বড় দেশ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা এসব কে করছে, কেন করছে, এসবকিছুই তারা জানেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা অনেক কিছুই জানেন। সারা বিশ্ব এ সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে। এই সহিংসতা কে করেছে? এই সহিংসতা করেছে একটি অশুভ শক্তি, যারা কখনো দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গল চায় না। তারাই দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়েছে। এরাই সেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সহিংসতায় বিএনপি-জামায়াতের যে সম্পৃক্ততা নেই, সেটা কেউই জোর গলায় দাবি করছে না। এ ধরনের সহিংসতার পেছনে অবশ্যই জঙ্গিবাদী দলের সম্পৃক্ততা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কিছু সহিংস লোক থাকতে পারে। মনে রাখতে হবে, এভাবে পূর্বপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোর ওপর সংঘবদ্ধভাবে হামলা করা, এটা রাষ্ট্র আক্রমণের শামিল। এ ধরনের আক্রমণ দল-মতনির্বিশেষে সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীই করতে পারে।

এ ধরনের কার্যক্রম করে তারা পরিবেশ অস্থিতিশীল করে থাকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় আগমন উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকেন্দ্রিক যে সহিংসতা হয়েছিল, স্থানীয় সরকারের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া, পাঠাগার পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম হয়েছিল। সেটাও জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছে। সরকার শুধু বিএনপি-জামায়াতে ভূত দেখছে। এটা সম্পূর্ণ অমূলক। 

জামায়াত-বিএনপির ঘাড়ে দোষ চাপানোয় সরকারের অতি উৎসাহের কারণে এই সন্ত্রাস গোপনে গোপনে ব্যাপক আকারে সংঘটিত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে নজরদারির প্রয়োজন ছিল, সেই নজরদারি অনেকটাই শিথিল। হোলি আর্টিজেনের কথা যদি আমরা মনে করি, যে ছেলেরা এই হোলি আর্টিজেনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা জামায়াত-বিএনপির ছিল না। 

তারা ছিল উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রশিক্ষিত সদস্য। গত কয়েক দিনের সহিংসতায় বিএনপির বর্ষীয়ান নেতাকে রিমান্ডে নেওয়া হলো। কিন্তু ছাত্রী মেরে ফেলা কোনো জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের কথা আমরা শুনিনি। বিএনপি-জামায়াতের নিশ্চয়ই কিছু সংশ্লিষ্টতা আছে। এ ধরনের সহিংসতা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত করে, এমন সব স্থাপনায় ভাঙচুর করা, ইন্টারনেট অকেজো করে দেওয়া, আমি বিশ্বাস করতে চাই না, ভালোমন্দ যেটাই হোক, বিএনপির মতো পুরোনো রাজনৈতিক দল এটা করতে পারে না। 

এসব কাজ করে থাকে চরমপন্থী জঙ্গিরা। আমরা দেখছি সরকার বিএনপি-জামায়াতকে দোষারোপ করছে। ফলে চরমপন্থী জঙ্গিরা যে ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হচ্ছে, সেদিকে সরকারের যতটুকু তৎপর হওয়ার কথা ছিল, সেই তৎপরতা দেখছি না। এতে আশঙ্কা করা হয়, সরকার এক পক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে আরও অন্যান্য যে ভিশন শত্রু দেশে সয়লাব হয়ে গেছে, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে নিয়েছে। 

এটাই সবচেয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কার ব্যাপার যে, এতে নিশ্চয়ই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের বিরাট ব্যর্থতা আছে। এত জায়গায়, এতভাবে আক্রমণ হলো এভাবে সংঘবদ্ধ আক্রমণ, অথচ তারা কিছুই জানত না। সত্তরোর্ধ্ব বয়সের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে সরকারের যে একচোখা মনোভাব দেখাল, এতে আমাদের রাষ্ট্রই সশস্ত্র হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ল। 

আমরা চাই দেশব্যাপী অস্থিতিশীল পরিবেশ কাটিয়ে উঠতে আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হোক। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এখন অবধি সঠিকভাবে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়ার কোনো সুযোগ দেখছি না। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সরকার যদি সমঝোতার পথে আসতে চায়, তাহলে শুরুতেই এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা দরকার। 

পুলিশের গুলিতে নিহত রংপুরের আবু সাইদের মৃত্যু এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারী নাহিদ ইসলামকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের তদন্তের মাধ্যমে বিচার করা উচিত। দেশে অন্যায়-অবিচার হলে সব মহলই বিচারের জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানায়। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে সঠিক বিচার তারা পায় না। আমার মতে, বিচার বিভাগকে অচিরেই ঢেলে সাজানো খুবই জরুরি। 

দেশব্যাপী সহিংসতায় অর্থনীতি অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। দেশে সেনাবাহিনী নামিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে, হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, একটা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারকে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সব সমস্যা সমাধানের পথে যেতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যাপীঠে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। দেশ ও দেশের স্বার্থকে সবার আগে আমলে নিয়ে দল-মতনির্বিশেষে সব পক্ষকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তৎপর হতে হবে।

লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক

প্রগতিশীল সমাজ গঠনে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৫ এএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৫ এএম
প্রগতিশীল সমাজ গঠনে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে
হীরেন পণ্ডিত

দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যুবক। বিভিন্ন আর্থসামাজিক বৈচিত্র্যসহ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হলে তরুণদের কথা ভাবতে হবে। তরুণরা বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, যুবকদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। সরকারের যুবনীতিতে এ সীমা ১৮ থেকে ৩৫ বছর। বয়সসীমা যদি ২৯ বছর ধরে যুবক হিসেবে ধরা হয়, তাহলে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এর নিচে।

তারুণ্য হলো মানুষের জীবনে সাহস, সংগ্রাম ও সৃজনশীলতার সময়। পুরোনো ভেঙে সংস্কার করে নতুন কিছু করা যেন তারুণ্যের ধর্ম। সমাজের এই সংস্কারকাজে তরুণসমাজকে সাহস ও সততার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণরা সমাজের সর্বস্তরে পরিবর্তনের বিপ্লব শুরু করবে এবং এ ক্ষেত্রে তরুণসমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই সবচেয়ে কার্যকর। সমাজে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি দেখলে তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে হবে এবং প্রতিবাদ যদি তরুণসমাজের কাছ থেকে আসে তাহলে তা কেউ ঠেকাতে পারবে না।

আমাদের দেশের তরুণদের অর্জন অনেক। খেলাধুলা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তরুণরা এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন উদ্দীপনা এবং সম্ভাবনাকে ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে তরুণসমাজ। তবে তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের শক্তি দেশ ও জাতির জন্য সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা যেমন স্পষ্ট নয়, তেমনি তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আজকের তরুণসমাজই ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারক। 

তারা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে সমাজ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করবে। তাই রাষ্ট্র ও সমাজের সব কল্যাণমূলক কাজে যুবসমাজের অংশগ্রহণ আবশ্যক। তরুণসমাজ ঘুমিয়ে থাকলে অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সমাজের আকাশ থেকে কখনো কালো মেঘের ছায়া সরবে না। সমাজ পরিবর্তন করতে হলে তরুণসমাজকে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি দেশ ও সমাজের কথাও ভাবতে হয়। সব সমাজকল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে আসতে হবে। 

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ সব সংস্কার আন্দোলনে তরুণদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ছিল। আমাদের ভবিষ্যৎ অনেক বেশি আশাব্যঞ্জক। তাই একটি আদর্শ সমাজ গঠনে তরুণসমাজকে কিছু চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। সামাজিক রাষ্ট্র নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী সাহসিকতার সঙ্গে সব বাধা অতিক্রম করে স্বপ্নের পথে হাঁটতে হবে। সঠিক প্রস্তুতি নিতে হবে এবং তরুণসমাজের সঠিক প্রস্তুতি শুধু নিজেকে নয়, সমাজকে, রাষ্ট্রকে নিয়ে যাবে অনন্য সাফল্যের পথে। 

তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উনয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সে জন্য বর্তমান সরকার মজুরির মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তরুণদের জন্য উপযুক্ত চাকরি নিশ্চিত করতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিচ্ছে- উপার্জন এবং আত্মকর্মসংস্থান।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শ্রমবাজারে দক্ষ ও শিক্ষাগতভাবে যোগ্য শ্রমিকের চাহিদা মেটাতে পারছে না। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষায় বিশেষ দক্ষতার অভাবে চাকরির বাজারের চাহিদা মেটাতে পারছে না পড়াশোনা শেষ করা তরুণ-তরুণীরা। কলেজের স্নাতকদের মধ্যে মাত্র ১৯ শতাংশ ফুলটাইম বা পার্টটাইম নিযুক্ত, যেখানে প্রায় অর্ধেক বেকার। অধিকন্তু নারী স্নাতকদের স্নাতক হওয়ার দুই বছর পরও বেকার এবং পড়াশোনার বাইরে থাকার আশঙ্কা অনেক বেশি: ৩৭ শতাংশ পুরুষ স্নাতকের বিপরীতে ৪৩ শতাংশ নারী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক বেকার থাকে।

তরুণদের বেকারত্বকে অর্থনীতির জন্য একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের নীতিমালায় অনুপস্থিত। জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া হয়নি বলে মনে করেন অনেকে। নীতিমালায় তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই। অবশ্য অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান বেশি হওয়ায় কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হতে হবে বেসরকারি খাতকে। 

এ জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন কাঠামো, তদারকি ও মান নিয়ন্ত্রণ যথাযথভাবে করতে হবে। উচ্চশিক্ষার কারিকুলাম তৈরি করতে হলে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কারিকুলাম হালনাগাদ করতে হবে। আইনপ্রণেতা, নিয়োগকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। সরকারকে কিছু প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নিতে হবে। 

এ জন্য আগামী বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ, রাস্তা সম্প্রসারণ এবং অন্যান্য কর্মশক্তির বিভিন্ন বিভাগের জন্য চাকরি তৈরি করে। চাকরির সংখ্যা, তাদের ধরন এবং কোন সেক্টরে চাকরি তৈরি করা হবে তার একটি চিত্র থাকতে হবে।

যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষতা উনয়ন প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তবু চাকরির বাজারে দক্ষতার বিশাল ঘাটতি রয়েছে। বেসরকারি খাতের অনেক কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি-সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের যুবকদের মধ্যে, কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব দেখায়, যা তাদের আরও পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। একটি প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য যুবসমাজকে মূলধারায় যুক্ত করার জন্য আমাদের উপরিউক্ত বিষয়টিতে মনোনিবেশ করা উচিত। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো

হাওয়ায় ভেসে থাকা থেকে মাটিতে নেমে আসার অনুভূতি

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৪২ এএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৪২ এএম
হাওয়ায় ভেসে থাকা থেকে মাটিতে নেমে আসার অনুভূতি
অমিয় দত্ত ভৌমিক

আজ থেকে পাঁচ শ বা হাজার বছর পর ইন্টারনেট আবিষ্কারের আগের সময়টাকে বলা হবে আদিম যুগ। আর আমরা যেটাকে আদিম যুগ বলছি সেটাকে ‘আদিম দাদার যুগ’ বলা হতে পারে। সে হিসেবে আমরা যারা ইন্টারনেট যুগের আগে জন্মেছি তারা আদিম যুগের মানুষ হিসেবে বিবেচিত হব। আর যারা এই আদিম যুগের শেষ ধাপ আর ইন্টারনেট যুগে প্রবেশের সময়টা দেখেছি, তারা কোন হিসেবে বিবেচিত হব, তার সঠিক নাম আমি এখনো দিতে পারছি না।

আজ আমার এই লেখাটি যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা। আমরা যারা আদিম যুগ থেকে ধীরে ধীরে ইন্টারনেট তথা আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছি, তাদের কাছে বিষয়টি বেশ মজার। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বা তারপর যারা জন্মেছে তারা আদিম যুগের মধ্যে পড়ছে না। তবে তার বাবা-মা, দাদা-দাদিরা আদিম যুগের।

আধুনিক যুগে প্রবেশের পর থেকে আমরা কমবেশি সবাই আদিমতা ভুলে এই যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিখে গেছি। আমাদের হাতে আদিমকালে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিকস জিনিসের পরিবর্তে চলে এসেছে অত্যাধুনিক সব ডিভাইস। এগুলোই এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। এক দশক আগেও কিছু কিছু অফিস-আদালতে ‘সেমি আদিম’ যুগের ইলকট্রনিকস জিনিসের ব্যবহার ছিল। 

বিশেষ করে দেশে-বিদেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে টেলিফোনের ল্যান্ডলাইন, ফ্যাক্স ইত্যাদি। ধীরে ধীরে এগুলোও আর ব্যবহার হচ্ছে না। অনেক অফিসে যন্ত্রটি থাকলেও তা সচল আছে কি না, এ নিয়ে সন্দেহ আছে।

আধুনিক যুগে প্রবেশের পর আমরা সবচেয়ে বেশি যে জিনিসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তা হলো ইন্টারনেট। এর ব্যবহার এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সব জায়গাতেই এটি সমানভাবে সমাদৃত। আমাদের কাছে এটি এখন পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হয়েছে। অনেককে তো বলতে শোনা যায়, এটি নাকি অনেক ক্ষেত্রে ‘টনিক’ হিসেবে কাজ করে। 

সন্তান লালন-পালন করতে ইন্টারনেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলেও অনেকে অভিমত দেন। আবার এর বদৌলতে ঘরে বসেই দলবদ্ধ আড্ডাও চলে। যাক ওসব কথা। আসি সাম্প্রতিক বিষয়ে।

মাঝেমধ্যে এই ইন্টারনেট ডাউন হয়ে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কিছু বিষয়ের সঙ্গে আমাদের কমবেশি পরিচয় আছে। এটা স্বল্প সময়ের জন্য হতো। তবে বিকল্প ব্যবস্থাও থাকত। কোম্পানি বদল করে বা একসঙ্গে একাধিক সংযোগ ব্যবহার করে সবাই কাজ চালিয়ে নিতে পেরেছেন। 

কিন্তু গেল কয়েক দিন দেশজুড়ে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংস আন্দোলনের ফলে বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। এটাও সপ্তাহখানেক হয়ে গেল। এর প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে যেমন বিরাট ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি জনজীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার! যারা শতভাগ ডিজিটাল জীবনযাপন করেন, তাদের তো ‘ঘোর কলি’ চলছে। তাদের খাওয়া, ঘুম, চলাফেরা সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

অন্যদিকে ইন্টারনেটের বদৌলতে সংবাদমাধ্যমেও এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। আগে যেভাবে সংবাদ সংগ্রহ বা প্রকাশ করা হতো, তা থেকে সরে আধুনিক যত পদ্ধতি আছে সবই ব্যবহৃত হচ্ছে এই দুনিয়ায়। ফলে সংবাদ সংগ্রহে সংবাদমাধ্যমগুলোকে বেগ পেতে হচ্ছে। 

আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বড় একটা অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ভিত্তি করে মূল ধারাকে ছাড়িয়ে ফেসবুক বা ইউটিউবকে সংবাদ পাওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম মনে করে থাকে। ফলে এসব নেশাতুরদের চলছে ‘ঘোর কলি’।

অন্যদিকে যারা, আধা আদিম আর আধা আধুনিক তারা একটা অন্য রকম অনুভূতি পাচ্ছেন। অনেক দিন পর এমন একটা সময়ের অপেক্ষা হয়তো তারা করেননি। কিন্তু যেকোনোভাবেই হোক, এমন একটা সময় তারা উপভোগ করছেন। তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের মতো সেই দিনগুলো অল্প সময়ের জন্য হলেও ফিরে পেয়েছেন। আর চলমান ইন্টারনেটবিহীন পারিবারিক আড্ডায় সন্তানদের সঙ্গে আদিম হতে যাওয়া যুগের কিছু প্রচলিত সামাজিক ও পারিবারিক চিত্র কেমন ছিল তা হয়তো বোঝাতে পারছেন।

আমরা যান্ত্রিক জীবনে শুধু ছুটছি আর ছুটছি। যতটুকু সময় ঘরে কাটানোর সুযোগ হয় তারও অধিকাংশ কেটে যায় মোবাইল ফোন ঘিরে। এতে এক সময়ের পারিবারিক রীতিগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। এই কয়েক দিন ভাসমান দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার অনুভূতি নতুন প্রজন্মের কাছে একেবারেই অনভিপ্রেত। তবে তাদের আগের প্রজন্মের থেকে শোনা কথাগুলো সপ্তাহখানেক আগ পর্যন্ত অনেকটা গল্পের মতো লাগলেও তা যে সত্যিই এমন ছিল, এটা নিশ্চয়ই বুঝতে আর বাকি থাকার কথা নয়।

যে শিশুটি বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল সেটে গেম খেলত, সে এখন টেলিভিশন দেখছে। অনেকেই লুডু খেলছে। সবকিছু বন্ধ থাকায় পরিবারের সবাই বসে টেলিভিশনে সিনেমা বা নাটক দেখছে। খাবার টেবিলে বসে দাদা-দাদি, মা-বাবার সঙ্গে আড্ডা হচ্ছে। পরে পড়বে বলে ফেলে রাখা বইগুলোও হয়তো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। 

মোট কথা, এক ছাদের নিচে থেকেও যে পরিবারের সঙ্গে অনেকটা দূরত্ব ছিল তা অল্প সময়ের জন্য হলেও সবার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে। 

এই ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা আমাদের অর্থনৈতিক দিক থেকে পেছনে নিয়ে গেলেও পরিবার বা সমাজের যে আলাদা একটা প্রাণ আছে, তা এই প্রজন্মের সামনে হাজির করতে পেরেছে।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, খবরের কাগজ