![উপজেলা নির্বাচন: আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে অস্বস্তি](uploads/2024/04/19/1713503075.Sultan-Mahmud-RAna.jpg)
বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলেও দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এখনো স্পষ্ট বিভ্রান্তি বিদ্যমান। দলীয় প্রতীকে যেহেতু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না, সেহেতু নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে বিএনপি অটল থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের অবস্থান কী হবে, এ বিষয়ে এখনো অস্পষ্টতায় রয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা। অন্যদিকে সাধারণ জনগণের মনেও একধরনের ধূম্রজাল রয়েছে। স্বতন্ত্রভাবে দলের কেউ নির্বাচন করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, নাকি বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল নেবে, তা নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। যে কারণে অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে দলের অভ্যন্তরে। দীর্ঘদিন থেকে আমরা লক্ষ করেছি, বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ায় এবং নেতৃত্ব-সংকটে দলের সিদ্ধান্ত নিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে সব সময়ই প্রতিটি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির নেতারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছেন। প্রায় দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থেকে এই দলটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতাও অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে বলে অনুমান করা যায়।
উপজেলা নির্বাচনকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিএনপির অনকেই মনে করেন, তারা যেহেতু কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে নেই, সেহেতু নেতা-কর্মীদের সক্রিয় এবং ঐক্যবদ্ধ রাখতে কৌশলে হলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত। তা ছাড়া এ কথাও সত্য যে, অসংখ্য নেতা-কর্মীকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা এই মুহূর্তে বিএনপির জন্য কঠিন হবে।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের সিদ্ধান্তকেও অনেকেই ভুল সিদ্ধান্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও চায় বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। উল্লেখ্য, প্রথম ধাপের ১৫০টি উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার পর বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামীও সিদ্ধান্ত বদল করেছে। দলটির আগের অবস্থান ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে ভোটে অংশ নেওয়ার। ঘোষণা না দিয়ে যেসব উপজেলায় জয়ের সম্ভাবনা আছে, সেখানে দলের নেতারা স্থানীয়ভাবে প্রার্থী হবেন। অনেকে গণসংযোগও শুরু করেছেন। সারা দেশে অসংখ্য নেতা-কর্মী পোস্টার-ব্যানার এবং প্রত্যক্ষ জনসংযোগের মাধ্যমে মাঠে রয়েছেন। উল্লেখ্য, জামায়াত বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথা বললেও দলটির নেতারা গত ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন, উপনির্বাচনে অংশ নেন। দুটি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী জামায়াত নেতা জয়ীও হয়েছেন। উপজেলা নির্বাচন দলীয়ভাবে হলেও এবার দলীয় প্রতীক দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। এ কারণে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই অসংখ্য প্রার্থী নির্বাচনে থাকছেন। একইভাবে বিএনপি-জামায়াত থেকেও প্রার্থী থাকবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকেও বলে দেওয়া হয়েছে যে, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নির্বাচনগুলো আর দলীয়ভাবে হবে না। যেকোনো প্রার্থীর পক্ষে দলের নেতারা ভোট করতে পারবেন। এ কারণে এখন দলের ভেতরেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হবে। যিনি প্রকৃত জনপ্রিয় তিনিই নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবেন। সেটি আওয়ামী লীগ হোক আর বিএনপি হোক।
২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন শুরু হয়। বিএনপি ২০২১ সালের মার্চের পর থেকে সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। এর আগেও সিটি করপোরেশন নির্বাচন বা ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। তা সত্ত্বেও দলটির তৃণমূলের অনেক নেতা সেসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দেড় শতাধিক প্রার্থী বিজয়ীও হয়েছেন।
এ কথা সত্য যে, দীর্ঘদিন যে দলটি নির্বাচনের বাইরে রয়েছে, সেই দলের সাংগঠনিক শক্তি এবং মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে হলে নির্বাচনে গিয়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এর মাধ্যমেই তাদের জনপ্রিয়তা তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের তৃণমূলের অনেক নেতার এলাকায় ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা রয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে থাকবে। ফলে বিএনপির অনেক নেতার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আর যদি উপজেলা নির্বাচনও বিএনপি বর্জন করে তাহলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যেই তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। যেমনটি আমরা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে লক্ষ করেছি। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে সবার মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, কেন্দ্রে নাম পাঠানোর সময় স্বজনপ্রীতি, স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিং, লবিং, বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনের মাঠে না থাকা এবং দলের চেইন অব কমান্ডের সংকটের ফলে এখন সবাই রাজনীতিতে নিজ নিজ অবস্থানে শক্ত ভূমিকায় থাকছে। ইদানীং আরেকটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে, উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীরা দলের প্রভাবশালী নেতাদের কাছে আসছেন এবং তাদের পক্ষে ভূমিকা রাখার জন্য ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে মাঠে বিএনপি না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ এমন প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চোখে পড়ার মতো আকার ধারণ করেছে।
এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলা যায়, যেসব আওয়ামী লীগার দীর্ঘদিন নৌকা প্রতীকের পক্ষে ভোট করেছেন, তাদের জনসম্পৃক্ততা কমে যাওয়ায় তারা এখন কিছুটা ব্যাকফুটে চলে গেছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকারীরাই সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন মূল দলের নিবেদিতদের তুলনায়। এসব কারণে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। দলের নেতা-কর্মীদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশে কিছুটা উদ্বেগ-উত্তেজনা, ক্ষোভ এবং নানাবিধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সূত্রপাত হয়েছে। সরকারের আত্মবিশ্বাসের মাত্রা যখন তুঙ্গে ঠিক তখনই এমন পরিস্থিতির সূত্রপাত এবং তা মোকাবিলার বিষয়ে চিন্তার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এ কথা বলার অবকাশ নেই যে, সরকার পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে রয়েছে। সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য-বিবৃতি, কার্যক্রম এবং অর্জন আত্মবিশ্বাসের বিষয়টি প্রমাণ করছে বারবার। তবে একদিকে যেমন আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, অন্যদিকে নিজেদের যথাযথভাবে মজবুত করতে না পারার দীর্ঘশ্বাসও প্রায়ই লক্ষ করা যাচ্ছে। দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা সচেতন মহলকেও যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে। সংগত কারণেই আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির মাঠে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ানোর শঙ্কা তৈরি করেছে। এ জন্য এই মুহূর্তে সাংগঠনিক ভিত্তি অটুট রাখতে দলের ভেতরে একটি সুস্পষ্ট চেইন অব কমান্ড তৈরির প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
E-mail: [email protected]