গত ৯ মে Fondazione Fratelli Tutti-এর আমন্ত্রণে দ্বিতীয় Meeting on Human Fraternity সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেওয়ার উদ্দেশ্যে অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস ঢাকা ছেড়েছেন। উল্লেখ্য, ১৭ মে প্যারিস থেকে এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি বিমানে তিনি দেশে ফিরবেন বলে জানা গেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রায় ৩০ জনকে এই সভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনিশ্চয়তা ও ভয়ের এই সময়ে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়ে ‘মানবতার সনদ’ প্রকাশ-সংক্রান্ত এই সভায় ড. ইউনূসের যোগদানের বিষয়টি নিয়ে খুব ন্যায্যভাবে কয়েকটি কারণে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
গ্রামীণ ব্যাংক এবং যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় তৈরি করে তিনি চেয়ারম্যান হয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে চলমান তহবিল আত্মসাতের মামলার কারণে তিনি ইতোমধ্যেই একজন প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত ব্যক্তি। এখানে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, মানবতার এবং ভ্রাতৃত্ব-সংক্রান্ত ইস্যুতে কীভাবে ড. ইউনূস আমন্ত্রিত হন। কোনোভাবেই ড. ইউনূসের এমন সভায় যোগদানের নৈতিকতা নেই। তিনি ফিলিস্তিনে গাজা অধিবাসীর ওপর নির্মম এবং বর্বর হামলার প্রতিবাদ কখনোই করেননি। বরং সব সময়ই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাফাই গেয়ে চলেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র মানবতাবিরোধী অনেক কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকলেও ড. ইউনূসের অবস্থান তাদের পক্ষেই। এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে মানবতাবিষয়ক গোলটেবিল সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি নিয়ে সর্বমহলে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি কীভাবে শান্তি ও মানবতা সম্মেলনের প্রধান বক্তা হন? তার এযাবৎকালের কার্যক্রম প্রমাণ করে যে, তিনি কোনোভাবেই শান্তির পক্ষের ব্যক্তি নন। খুব স্বাভাবিকভাবেই উল্লিখিত সম্মেলনে ড. ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানানোর আগে তার অবস্থান শান্তির পক্ষে কি না, সেটি ভেবে দেখা দরকার ছিল। শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন কিন্তু বিশ্বের অবহেলিত, নির্যাতিত মানুষের পক্ষে তাকে কখনোই সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। তিনি বরং গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার নামে গরিব মানুষকে শোষণ করেছেন।
তিনি অর্থনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা হিসেবে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরপরই ড. ইউনূস বাংলাদেশে মার্কিন এজেন্ডা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছিলেন। এমনকি তিনি কখনোই শান্তির পক্ষে ছিলেন না। প্রথমে রাজনৈতিক দল করে তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু জনগণের ভোটে জেতা তার পক্ষে অসম্ভব বুঝতে পেরে তিনি পিছিয়ে যান।
গত বছরের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন আকারেও প্রকাশিত হয় একটি খোলা চিঠি। সেখানে ড. ইউনূসের প্রতি ন্যায়বিচার করা হচ্ছে কি না, প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ৪০ বিশ্বনেতার লেখা ড. ইউনূসের পক্ষে এক পৃষ্ঠার পক্ষপাতমূলক সাফাই, যা নতুনভাবে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়। ২০১১ সালে ড. ইউনূসকে যখন দেশের অবসর আইন অমান্য করে ব্যাংকের এমডি পদ থেকে পদত্যাগ করার অনুরোধ এবং ‘উপদেষ্টা ইমেরিটাস’ হিসেবে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আপিল বিভাগে আইনি লড়াইয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব বিষয়ে কী বলবেন বিদেশি ৪০ নাগরিক?
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। যেগুলো এই এক লেখায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তিনি এবং তার প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের তদন্ত প্রথম করে নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন। তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে ডেনমার্কের চলচ্চিত্র নির্মাতা টম হাইনম্যান তৈরি করেন ‘ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে’ (Caught in Micro Debt) নামে এক প্রামাণ্য চলচিত্র। বিভিন্ন সময়ে দেশে-বিদেশে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যে ইতিবাচক চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল, এই চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণ তার বিপরীত একটি চিত্র তুলে এনেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ভর্তুকি হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯৯৬ সালে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের (নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানি) দেওয়া অর্থ থেকে ১০ কোটি ডলারেরও বেশি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণ নামে নিজের অন্য এক প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেন ইউনূস; যা নিয়মবহির্ভূত ও প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ।
প্রামাণ্য চিত্রটি তৈরির সময়ে এর নির্মাতা ছয় মাস ঘুরে এ সম্পর্কে ড. ইউনূসের বক্তব্য নিতে পারেননি, উপরন্তু প্রতিবেদনটি প্রচার না করার জন্য চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখেন ড. ইউনূস। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দাতাগোষ্ঠী অনুদান এবং ঋণ দেয় গ্রামীণ ব্যাংককে। অনুদানের সব অর্থ রাষ্ট্র এবং জনগণের জন্য ব্যয় না করে গঠন করেন সোশ্যাল ভেনচার ক্যাপিটাল ফান্ড (এসভিসিএফ)। ১৯৯২ সালের ৭ অক্টোবর ওই ফান্ড দিয়ে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালেই ‘গ্রামীণ ফান্ড’ নামের একটি লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হয়। তাতে ওই ফান্ডের ৪৯.১০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। সুতরাং গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়ে বিদেশ থেকে টাকা এনে তা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা ছিল শুরু থেকেই।
মজার ব্যাপার হলো, গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থে এবং বোর্ডসভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ড গঠিত হয়। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত হয়েছে তা সবই আইনত গ্রামীণ ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ফান্ড এবং গ্রামীণ কল্যাণের পরিচালনা পর্ষদে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি থাকলেও ২০২১ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনীত ব্যক্তি। কিন্তু ড. ইউনূস এখনো গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ডের চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন।
নোবেল বিজয়ী বলে তাকে ধোয়া তুলসী পাতা ভাবা নিশ্চিতভাবে অযৌক্তিক। পাশের দেশ মায়ানমারের রাষ্ট্রীয় আদালত অং সান সু চিকে বিভিন্ন অপরাধের জন্য কারাদণ্ড দিয়ে প্রমাণ করেছেন নোবেল বিজয়ী হওয়া মানে বিচারের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া নয় এবং নোবেল বিজয়ী হলেই ধরে নেওয়া যাবে না যে তিনি অপরাধ করতে অক্ষম। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতও সু চির বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের তদন্তে নেমেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে। অতীতে সে দেশেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ডমিনিক স্ট্রস কানের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে বিচার হয়েছে। সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাই সারকোজির বিচার প্রমাণ করছে যে, বড় মাপের মানুষ হলেই তিনি অপরাধমুক্ত হবেন বা বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবেন, এমনটি হতে পারে না।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]