ঢাকা ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাংলাদেশের স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রয়োজন

প্রকাশ: ২১ মে ২০২৪, ১১:০৪ এএম
বাংলাদেশের স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রয়োজন
মো. তৌহিদ হোসেন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু দুই দিনের বাংলাদেশ সফরে আসেন গত ১৪-১৫ মে। সফরকালে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন এবং পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় মিলিত হন। এ ছাড়া  তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন ডোনাল্ড লু। 

বাংলাদেশে গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মানবাধিকার ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের গভীর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। অবাধ, নিরপেক্ষ ও নির্বিঘ্ন নির্বাচনের স্বার্থে ভিসানীতিতে কড়াকড়ি আরোপের ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনের পরও নির্বাচন সুষ্ঠু ও মানসম্পন্ন হয়নি বলে যুক্তরাষ্ট্র বিবৃতি দিয়েছিল। এমতাবস্থায়, নির্বাচনের পাঁচ মাসের মাথায় ডোলান্ড লুর এবারের সফর দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে এক ধরনের উত্তরণের প্রয়াস বলেই সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হচ্ছে।

লুর বক্তব্যেও সেটির আভাস পাওয়া যায়। অস্বস্তি কাটিয়ে দুই দেশের মধ্যে পুনরায় আস্থা স্থাপনের চেষ্টা করছেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন ডোনাল্ড লু। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অনেক বিষয়ে মতভেদ ছিল। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন (বাংলাদেশে) অনুষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম। এতে কিছু টেনশন তৈরি হয়েছিল। তবে আমরা সামনে তাকাতে চাই, পেছনে নয়। কাজেই সম্পর্ক উন্নয়নের উপায় খুঁজে বের করতে হবে বলেও মনে করেছেন লু। বিষয়গুলো দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

লু বলেন, এই সম্পর্কের পথে অনেকগুলো কঠিন বিষয় রয়েছে, যথা র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার। এসবকে পাশে রেখে ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তনসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আরও বেশকিছু বিষয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের বলেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। 

ডোনাল্ড লুর সফরে সার্বিক সুর অনেকটাই ইতিবাচক ছিল। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয়েছিল যে, এবারের সফরের মাধ্যমে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কিন্তু ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, তা হচ্ছে না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেশটার নৈশভোজের সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অব্যাহত পতনের বিষয়টি লু উল্লেখ করেছেন, এবং মার্কিন বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো যে তাদের লভ্যাংশ ফেরত নিতে পারছে না এনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পক্ষান্তরে নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ে লু বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে।

নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পর্যায়ে বহিঃরাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নির্বাচনের আগে চীন, রাশিয়া এবং বিশেষ করে ভারত, সরকারের পক্ষে খুব শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশগুলো একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য তাদের চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছিল। নির্বাচনের পর পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর অনেকটা স্থিমিত হয়ে আসে। অনুমান করা যায় যে, সরকারের পক্ষে ভারতের শক্ত অবস্থানের কারণে, বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে সংঘাতময় সম্পর্কে জড়ানো যুক্তরাষ্ট্র নিজ স্বার্থের অনুকূল মনে করেনি। ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য চীনের আধিপত্যরোধ, যাতে ভারত তার সহযোগী।

বাংলাদেশের নির্বাচন যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশানুরূপ হয়নি, দেশ দুটির মধ্যে পরস্পরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তো শেষ হয়ে যায়নি। ডোনাল্ড লুর সাম্প্রতিক সফরকে এই প্রেক্ষিত থেকে দেখতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের আছে, সে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা তারা রক্ষা করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের স্বার্থ হয়তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তবে বিভিন্ন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও বিদ্যমান। আগামী সময়গুলোতে যে বিষয়গুলো আমাদের সামনে আছে তার মধ্যে অন্যতম নিরাপত্তা ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা ইস্যুতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে বলে মনে করা হচ্ছে । 

অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা আশঙ্কা সবসময় ছিল যে, নির্বাচনের পর পশ্চিমা দেশগুলো থেকে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসে কি না! এ ক্ষেত্রে ভিসা নিষেধাজ্ঞা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও অর্থনীতির ওপর এখন পর্যন্ত কোনো বিরূপ প্রভাব দেখা যায়নি। আগামী দিনগুলোয় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে উভয় পক্ষকেই। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই বাংলাদেশের জন্য। একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যখন টানাপোড়েন থাকে তখন ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে শঙ্কিত থাকেন। বাংলাদেশ আশা করবে, এই সফরের প্রেক্ষিতে সে আশঙ্কা দূরীকরণের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। 

আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে আরও কয়েকটি দেশ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আছে, যেমন ভারত, চীন, মায়ানমার ইত্যাদি। ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকার পরিপ্রেক্ষিতে মনে করা যায় যে, ভারতের নিরাপত্তার প্রয়োজনগুলোকে সরকার হয়তো বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে অন্যান্য দেশের তুলনায়। তবে ভারতের স্বার্থ যে সবসময় বাংলাদেশের সঙ্গে একইরকম হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বার্থ যেন বিঘ্নিত না হয়। 

নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের অন্যতম উদ্বেগের বিষয় মায়ানমার পরিস্থিতি। ইতোমধ্যে মায়ানমারের গৃহযুদ্ধ এক নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গা সমস্যায় আমাদের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে অতীতে প্রকৃত প্রস্তাবে ভারত বা চীন কোনো ধরনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। প্রত্যাশিতভাবে, নিজেদের স্বার্থের নিরিখেই তারা তাদের কার্যক্রমকে সীমিত রেখেছে। ভারত, চীন ছাড়াও মায়ানমারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে ভারত, চীনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা লাভের চেষ্টা বাংলাদেশের স্বার্থে অপরিহার্য।

রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পশ্চিমের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে  ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য জরুরি। রপ্তানি পণ্যের বাজার, বিদেশি বিনিয়োগের উৎস, রেমিট্যান্স ইত্যাদি সব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব বাংলাদেশের জন্য অপরিসীম। এ ছাড়া আছে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। এসব কথা মাথায় রেখেই সামনের দিনগুলোতে আমাদের বৈদেশিক সম্পর্কের অগ্রাধিকারগুলোকে নির্ধারণ করতে হবে।

লেখক: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব 

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কেন ব্যর্থ হচ্ছে?

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ০২:৪১ পিএম
যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কেন ব্যর্থ হচ্ছে?

বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে পিছিয়ে পড়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন এবং হোয়াইট হাউসে আসার প্রথম মাসগুলোতেই যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বব্যাপী এক মহাসংকটে ফেলে দিয়েছে। এমনকি এটি গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুও চিহ্নিত হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন কর্তৃত্ববাদী পরিবর্তন অনুমানযোগ্য নয়। এর জন্য অনেকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে দোষারোপ করছেন। কারণ তারা আমেরিকার জনগণ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। 

অনেক বিশ্লেষক দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণের মূল কারণ হিসেবে জাতি, গর্ভপাত অথবা তথাকথিত ‘জাগ্রত মতাদর্শ’-এর মতো সাংস্কৃতিক কারণগুলোকে নির্দেশ করেছেন। অন্যরা যুক্তি দেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে তার নাগরিকদের অংশগ্রহণ হারিয়ে ফেলছে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক নীতি কেবল ধনীদের স্বার্থে কাজ করছে।

যদিও এসবের পেছনে সত্য ঘটনা রয়েছে। তবুও এগুলো মূলত বিশ্বাসযোগ্য পথের চাইতে ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের লক্ষণগুলো প্রকাশ করে। আমেরিকান গণতন্ত্র কেন তার নাগরিক কণ্ঠস্বর হারাচ্ছে? রাজনীতিবিদরা কেন গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভঙ্গ করেন? কেন অর্থনৈতিক নীতি ধনীদের স্বার্থে কাজ করে এবং অন্যদের নয়? যদি আমরা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি, তাহলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা সুসংগত রোডম্যাপ তৈরি করতে পারব না।

গণতন্ত্রের পতনের পেছনে দুটি শক্তি কাজ করেছে। প্রথমটি হলো তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিপ্লব; যা ১৯৭০-এর দশকে অর্থনীতিকে নতুন রূপ দিতে শুরু করে। দ্বিতীয়টি হলো ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের প্রশাসন কর্তৃক প্রবর্তিত মুক্তবাজার নীতির এজেন্ডা। ২০২০ সাল পর্যন্ত রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক প্রশাসন উভয়ই এ এজেন্ডাকে সমর্থন করেছিল; যা ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’-এর ব্যানারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। 

এই দুটি শক্তির সমন্বয়ে সম্পদ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা খুব কম সংখ্যক মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি প্রথমবার নয়। যদিও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের পূর্ববর্তী পর্যায়গুলোতে যথেষ্ট সুবিধা ছিল। শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের গতিশীলতা আনতে সক্ষম করেছিল যা, গত চার দশক থেকে ভিন্ন ছিল। এ সময়ে, প্রযুক্তি এবং নীতি বিশেষ করে অল্প শিক্ষিত কর্মী যারা মার্কিন শ্রমশক্তির ৬২ শতাংশে তাদের চাকরির জন্য বিপজ্জনক ছিল। 

যেহেতু অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি গণতন্ত্রের পতনকে ব্যাখ্যা করে। তাই এ প্রবণতাকে রোধ করতে জননীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম কয়েক মাসেই বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও অনির্বাচিত ব্যক্তি যিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পাশে আনন্দে মেতে থাকেন, যা দৃষ্টিকটু।  

সবাই জানেন, মার্কিন অর্থনীতি বিশাল ব্যক্তিগত সম্পদ তৈরি করেছে। কিন্তু এটি কীভাবে তৈরি হয়েছে? আমার ২০২৩ সালের বই, ‘দ্য মার্কেট পাওয়ার অব টেকনোলজি: আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য সেকেন্ড গিল্ডেড এজ’-এ আমি দেখাই কীভাবে উদ্ভাবন ও নতুন প্রযুক্তি অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম উৎস। বাজারের ক্ষমতা কীভাবে বৃদ্ধি করে। একটি ফার্মের পণ্য উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি দাম নেওয়ার ক্ষমতা, ফলে একচেটিয়া মুনাফা হয়, তা দেখিয়েছি। 

আমার বিশ্লেষণে দেখা যায়, মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতিতে উদ্ভাবকদের প্রথমদিকে বাজার ক্ষমতা প্রদান করা অর্থনীতির অন্যতম স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় জয়ী উদ্ভাবকরা তাদের প্রাথমিক সাফল্যকে আটকে রাখতে এবং তাদের বাজার ক্ষমতা তৈরি করতে বিভিন্ন ধরনের কৌশল ব্যবহার করতে পারেন।

একচেটিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবিশ্বাস নীতি থেকে অব্যাহতি দেওয়া বাজার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ অব্যাহতি অবিশ্বাস এবং বিশেষ সুবিধা আইনের মধ্যে দ্বন্দ্ব রোধ করতে পারবে। প্রযুক্তি হলো বেশির ভাগ একচেটিয়া ক্ষমতার উৎস। একচেটিয়া মুনাফা অর্জন হলো বেশির ভাগ ব্যবসায়িক উদ্ভাবনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, সিলিকন ভ্যালির ‘ব্যাঘাত’ সম্পর্কে ক্রমাগত আলোচনার বিপরীতে প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা বাজারের ক্ষমতাকে দূর করে না। গবেষণায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়- প্রযুক্তিগত একচেটিয়া বাজার বিভাজনকে রক্ষা করবে এবং এটি খুব কমই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। প্রতিযোগিতার পরিবর্তে প্রযুক্তিভিত্তিক সংস্থাগুলো প্রায়শই যৌথ প্রকল্পগুলো অনুসরণ করে। ছোট সংস্থাগুলোকে গবেষণা ও উন্নয়নে সহযোগিতা করে, যা সফল হলে অধিগ্রহণ করা হয়।

প্রায় প্রতিটি সিলিকন ভ্যালি তাদের সূচনালগ্ন থেকেই তাদের নতুন ধারণাকে কিছুটা উন্নত করার পরিকল্পনা করে। তার পর একটি শীর্ষস্থানীয় সংস্থা কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়। এ সত্যটি প্রতিফলিত করে যে, মূল্যের যোগসাজশ অবৈধ হলেও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা অবৈধ নয়। উন্মুক্ত এআই-এর কথাই বলা যায়। এটির সফটওয়্যার নেতৃত্বদানকারী মাইক্রোসফটের প্রতিযোগী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু প্রতিযোগিতা করার পরিবর্তে, ওপেনএআই মাইক্রোসফট থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছে। অনেক বড় সংস্থার অংশীদার হয়ে উঠেছে। সব তরুণ এআই সংস্থাগুলোতে একই কাজ করছে।

আমাদের গণতন্ত্র অথবা মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতি থাকতে পারে। কিন্তু দুটোই আমাদের থাকতে পারে না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দুটি কেন্দ্রীয় লক্ষ্য অর্জন করা প্রয়োজন। প্রথমত, ব্যক্তিগত ক্ষমতা দমন করা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দূর করা যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি অভিজাততন্ত্রে পরিণত করেছে। দ্বিতীয়ত, উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলো আরও সমানভাবে ভাগ করে নেওয়া নিশ্চিত করা, যাতে কোনো গোষ্ঠী পিছিয়ে না পড়ে। 

বাজারের ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং এর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য কাম্য নয়। নীতিগত সংস্কার এটিকে বিপরীত করতে পারে। অবিশ্বাসের নীতি এবং প্রয়োগ বড় সংস্থাগুলোকে ছোট সংস্থাগুলো অধিগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে পারে। অবিশ্বাস এবং করের সংমিশ্রণ বাজারের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।

নীতিনির্ধারকদের ইউনিয়ন গঠনের ওপর আইনি বিধিনিষেধ দূর করা উচিত। পাশাপাশি দুর্নীতি রোধে ইউনিয়নগুলোর আর্থিক হিসাব এবং শাসনব্যবস্থার কঠোর পাবলিক অডিট বাধ্যতামূলক করা উচিত। যেহেতু ইউনিয়নগুলো শ্রমিকদের সংস্থাকে শক্তিশালী করে এবং বাজারে ক্ষমতার ভারসাম্য উন্নত করতে সহায়তা করে। তাই তারা কাউকে পেছনে না রেখে দ্বিতীয় নীতিগত লক্ষ্যকেও এগিয়ে নিয়ে যায়। 

এটি আমাদের গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধারের দ্বিতীয় উপাদানে নিয়ে আসে: প্রযুক্তি এবং প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলো আরও সমান ভাগাভাগি। এর অর্থ হলো আমেরিকার উদ্ভাবন এবং প্রবৃদ্ধির জন্য নতুন নীতিগত পদ্ধতির প্রয়োজন। প্রচলিত মুক্তবাজার পদ্ধতি এ ধরনের কাজকে উৎসাহিত করছে। নীতিনির্ধারকদের নিশ্চিত করা উচিত, বিজয়ীরা তাদের কিছু লাভ ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে ভাগ করে নেবে।

সহজে ব্যবহারযোগ্য ও রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-ভিত্তিক পণ্য এবং পরিষেবা উদ্ভাবনের প্রচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভর্তুকি চালু করা উচিত। এতে আরও উন্নত প্রযুক্তিগত কর্মসংস্থান তৈরি হবে, যার জন্য উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন হবে না। বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা-উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে কম শিক্ষিত কর্মীদের ভালো চাকরির সম্ভাবনা বাড়াবে। এর জন্য ট্রেড স্কুল, কমিউনিটি কলেজ এবং শিক্ষানবিশ কর্মসূচিতে আরও বিনিয়োগ দরকার। 

শ্রম ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে সহযোগিতা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান এবং প্রত্যাশিত প্রযুক্তির জটিলতার কারণে সহযোগিতা আরও গঠনমূলক হতে হবে। কর-অর্থায়নকৃত জীবিকা পুনরুদ্ধার-নীতি কার্যকর হলে সংস্থাগুলো তাদের প্রযুক্তি এবং শ্রমশক্তি সমন্বয় করার জন্য আরও বেশি স্বাধীনতা পাবে। এ অর্থনৈতিক নমনীয়তা শেষ পর্যন্ত নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিক উভয়কেই উপকৃত করবে।

ট্রাম্পের নির্লজ্জ আইন বহির্ভূতকাজ আমেরিকানদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ফেলে দিচ্ছে। কারণ অভিজাততন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রে তার নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় করছে। আমরা যদি একটি ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক সমাজ চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই ব্যক্তিগত ক্ষমতা এবং একচেটিয়া মুনাফা মোকাবিলা করতে হবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে এমন একটি জোটকে ক্ষমতায় আনতে অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু এ ধরনের পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠছে, কারণ ট্রাম্প প্রশাসন তাদের ক্ষমতায় আনা শ্রমিকদের জীবন উন্নত করতে চায় না। 

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্র। প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত 
অনুবাদ: সানজিদ সকাল 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট ও জনগণের প্রত্যাশা

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ০২:৩৬ পিএম
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট ও জনগণের প্রত্যাশা

বিশ্বের চ্যালেঞ্জিং অর্থনীতির মুখে আমাদের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে বাজেট করা কঠিন কাজ। অর্থনীতির প্রচলিত নিয়মে একে বাঁধা যায় না। রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক, মেধা-মননের বিকাশের ক্ষেত্রে যে কয়েকটি খাত রয়েছে তার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। এ খাতটি একটি রাষ্ট্রে বসবাসরত প্রতিটি নাগরিকের মেধা, চিন্তা, শক্তি স্বাভাবিক জীবন বোধের জাগরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ খাতের উন্নয়নকল্পে যা যা পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে তা থেকে রাষ্ট্র অনেক দূরে। বড় সমস্যা আমাদের শিক্ষার উন্নতিকল্পে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ খুবই সামান্য। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কার চেয়েও বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম। বাংলাদেশে এমন কিছু খাত আছে যেখানে বরাদ্দ অনেক অথবা উৎপাদনশীল খাত নয়, সেখানেও বরাদ্দ বাড়ানো হয় আর শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ে না বরং কমে। 

সাধারণত স্নাতক শিক্ষিতদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের হার বেশি। এর বড় কারণ, তারা যে ধরনের শিক্ষা অর্জন করেছে আর বাজারে যে ধরনের যোগ্যতার চাহিদা আছে- এই দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ার কারণে প্রতি অর্থবছরে বাজেটের পরিমাণও বাড়ে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সেবা খাতে অর্থ বরাদ্দের যে পরিকল্পনা সেটাই সাধারণত বাজেট হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। আমাদের মতো দেশে মূল্যস্ফীতির বড় কারণ দুষ্প্রাপ্যতা। মাঝে-মধ্যেই অনেক জিনিস দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে, যা আমাদের আমদানি করতে হয়। সেগুলো আমদানি করতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়। এ জায়গাটায় আমাদের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এ সমস্যা কিছুটা সমাধান করতে পারলেও পুরোপুরি সন্তোষজনক এমনটা বলা যাবে না। সুতরাং বাজেটের লক্ষ্য থাকবে রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির সমন্বয় করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।

একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির পেছনের কারণগুলোর দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। কিছু কিছু পণ্যসামগ্রীর অপ্রাপ্যতা নিরসনে তা আমদানি করতে হয়। সেগুলো আমদানিতে যেন বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের রপ্তানি উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের আরেকটি বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে বিদেশে কাজ করা শ্রমজীবী মানুষের পাঠানো রেমিট্যান্স। তা যেন অব্যাহত গতিতে বাড়তে থাকে সেটা প্রত্যাশা করছি। এজন্য ডলারের বাজারমূল্য এবং সরকারের কাছ থেকে বা ব্যাংক হারের মধ্যে পার্থক্য যত কমিয়ে আনা যায় ততই মঙ্গল। 

এতে হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে আশা করা যায়। বাজেটের উন্নয়নমূলক দিকও থাকে। তবে উন্নয়নমূলক বাজেট হিসেবে অতীতে যেভাবে খোলা হাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে চোরতন্ত্র শক্তিশালী করার জন্য; এবারের বাজেটে যেন সেটা না করা হয়। যথাযথভাবে লাভক্ষতি বিশ্লেষণ করে যাতে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়। আবার সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠতে পারে, যেসব প্রকল্প অর্ধসমাপ্ত আছে সেগুলোর কী হবে? এগুলো গলার কাঁটা হলেও সেগুলো শেষ বা সুসম্পন্ন করা প্রয়োজন। তা না হলে যে অর্থটা এরই মধ্যে ব্যয় হয়েছে তা পুরোটাই জলে যাবে।

দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ থাকলে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন। দেশি বিনিয়োগ হওয়ার অর্থ হলো দেশে বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। যে কারণে বারবার বলা হয়, দেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রথমে দেখবে দেশের ব্যবসায়ীরা কতটা সক্রিয় এবং কতটা উৎসাহের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। যদি তারা দেখেন যে দেশি বিনিয়োগকারী বা ব্যবসায়ীরা সেভাবে সক্রিয় নন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তারা নেতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবেন। এজন্য দেশি বিনিয়োগকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা, মানবসম্পদ সৃষ্টির ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে পারি তাহলে এর সুফল দেশের অভ্যন্তরে পেতে পারি।

একই সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ কাজে লাগিয়ে এবং বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর সম্পদ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব। কিন্তু সমস্যা হলো বাজেটের যৎসামান্যই শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা ২ শতাংশেরও কম। বরাদ্দের এখানে পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু কেবল বাজেটে বরাদ্দ বাড়ালেই এসব খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে না। শিক্ষা খাতের বর্তমান সমস্যা হলো এখানে শিক্ষার নামে অশিক্ষা চলছে। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বা অন্য সামাজিক বিবেচনায় এমন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে যাদের শিক্ষকতা করার যোগ্যতা নেই। সুতরাং এ ক্ষেত্রে যতদিন পর্যন্ত না আমরা সুশাসন নিশ্চিত করতে পারব ততদিন অর্থ বরাদ্দ বা শিক্ষক নিয়োগ বাড়িয়ে সুফল পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের সর্বপ্রথম সংস্কার করা দরকার।

 কীভাবে আমরা যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও ভালো শিখন নিশ্চিত করতে পারি, স্কুল-কলেজগুলোকে শিক্ষা উপকরণ, গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরি ইত্যাদি দিক থেকে উন্নত করতে পারি, পেশাদারির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শিক্ষক তৈরি- এসব ক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে হবে। আর বর্তমান শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকলেও প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো ভালো প্রশিক্ষক নেই। এদিকেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া এগুলো বর্তমানে যে বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে তা কীভাবে পুনরুদ্ধার বা নতুনভাবে তৈরি করা যায়, সেসব দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের পিছুটান তৈরি হয়। তারা সাহসী বা উদ্যোগী হতে পারেন না। কিন্তু যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদে কোনো অনিশ্চয়তা না থাকে তাহলে তারা বিনিয়োগ করেন এবং কর্মকাণ্ডের গতি বাড়ান। দেশপ্রেমী মানুষের মধ্যে কর্মের উৎসাহ বাড়ে। এজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আবশ্যক। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা থাকা দরকার। দলগুলোর ন্যায্য দাবি কীভাবে পূরণ করা যায় সেদিকে সরকারের মনোযোগ দিতে হবে।

এমনিতেও সংস্কার ও নির্বাচন ঘিরে একটা জাতীয় বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ বিতর্ক থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া এবং একটা অনির্বাচিত সরকার যতটুকু সংস্কার করতে পারে ততটুকুই করা। বাকি সংস্কার কার্যক্রম নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেওয়া। এটাই একটা সহজ পথ বলে আমি মনে করি। সর্বোপরি ব্যক্তি হিসেবে যা প্রত্যাশিত সম্মান ও স্বীকৃতি, উন্নয়নে অংশগ্রহণ- সব ক্ষেত্রে বৈষম্য মানুষের জীবন অর্থপূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তরুণদের স্বপ্ন হরণ করা হয়েছে। তাদের পরনির্ভরশীলতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়াকে বিপরীতমুখী করার মতো উপকরণ এ বাজেটে প্রত্যাশিত। সেটা শুধু কথা আর আশ্বাস নয়, হতে হবে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য। এক বছরে কতটুকু করা যাবে, সেখানে সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে। 

তবে অন্তত দুই বা তিন বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনা, লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তার প্রথম অংশের বাস্তবায়নের জন্য এবারে বরাদ্দ রাখা যায়। বাকিটা তার যুক্তিসংগত পদাঙ্ক অনুসরণ করে এগিয়ে যাবে ধরে নেওয়া যায়। ক্রমবর্ধমান যে বৈষম্য, তা সবচেয়ে জাজ্বল্যমান গ্রাম ও শহরের মধ্যে। শুধু শহর-গ্রামের বৈষম্য বললেও পুরো পার্থক্য সুস্পষ্ট হয় না। শহর-গ্রামের বৈষম্য কমানোর কিছু প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে জড়িত কৃষির প্রশ্ন, যেটা আসলে কৃষকের প্রশ্ন। বাজেটে কৃষির জন্য, বরাদ্দ থাকে অবশ্যই, সেগুলোর খানিকটা ভৌত অবকাঠামোর জন্য থাকে সাধারণভাবে ভর্তুকি, যন্ত্রপাতির জন্য কর রেয়াত ইত্যাদি।

 কাজেই কৃষির যান্ত্রিকীকরণে প্রণোদনা দিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। কিন্তু কৃষি মজুর, যারা কাজ হারাচ্ছেন, তাদের কী হবে, সেটাও ভাবতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার সংখ্যা কমে গেছে। মোট কর্মসংস্থানে সেগুলোর অংশও তাই কমেছে। অন্যদিকে বৃহৎ উদ্যোক্তাদের কর্মসংস্থানের অংশ বেড়েছে। শ্রমবাজারে তাদের আধিপত্য বেড়েছে, যা বৈষম্য বাড়ার প্রক্রিয়ায় ইন্ধন জোগাচ্ছে। বৈষম্য কমানোর যদি আন্তরিক আগ্রহ থাকে, তাহলে এ বাজেটকে কাজে লাগিয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
[email protected]

উন্নত দেশে শিক্ষায় বাজেট এবং বাংলাদেশ ভাবনা

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ০৯:০৮ পিএম
উন্নত দেশে শিক্ষায় বাজেট এবং বাংলাদেশ ভাবনা
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

একটি জাতির উন্নয়নের মেরুদণ্ড হলো শিক্ষা। আর এই শিক্ষাকে যুগোপযোগী, মানসম্মত ও সমন্বিত করতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, যা বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন সম্ভব। উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা খাতে অর্থায়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। ফলে তারা শুধু মানবসম্পদ উন্নয়নে নয়, প্রযুক্তি, গবেষণা এবং উদ্ভাবনেও বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষায় পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের মধ্য দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা এবং যোগ্য ও দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর অভিমত, শিক্ষায় জিডিপির ৫-৬ শতাংশ বা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া দরকার। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব স্তরে বাজেট বরাদ্দের সঙ্গে যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির প্রসঙ্গটিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কারণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়।

ফিনল্যান্ড বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সফল শিক্ষাব্যবস্থার অধিকারী। তাদের শিক্ষা বাজেট মোট জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ পায়, যা ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এই অর্থে তারা শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করে, শিক্ষকদের উচ্চ বেতন নিশ্চিত করে এবং প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের হাতে আধুনিক প্রযুক্তি তুলে দেয়। শিক্ষাকে তারা কোনোভাবেই বাণিজ্য হিসেবে দেখে না, বরং এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার বলে বিবেচনা করে। ফিনল্যান্ডে কোনো পাবলিক স্কুলে বেতন নেই, আর সরকারি বাজেট থেকেই বই, খাতা, খাবার এমনকি বাসসেবাও দেওয়া হয়।

জার্মানি শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের প্রায় ১১ শতাংশ ব্যয় করে, যার একটি বড় অংশ ব্যয় হয় ‘ডুয়াল এডুকেশন সিস্টেম’-এর ওপর। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একযোগে স্কুল ও কাজ শেখার সুযোগ পায় একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, অন্যদিকে ব্যবহারিক জ্ঞান। সরকারি বাজেটের মাধ্যমে শত শত প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়, যেখানে প্রশিক্ষণরত শিক্ষার্থীদের ভাতা দেওয়া হয় এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পার্টনারশিপ তৈরি করা হয়। ফলে বেকারত্বের হার অনেক কম এবং উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি।

কানাডায় শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ‘সামাজিক সাম্য’। স্থানীয় সরকারগুলোও বাজেট নির্ধারণে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চল, আদিবাসী সম্প্রদায় কিংবা অভিবাসী পরিবারগুলোর শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, কানাডার বাজেটে প্রতি বছর প্রায় ৩ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয় আদিবাসী শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে।

জাপান বরাবরই শিক্ষার মান ও শৃঙ্খলার দিক দিয়ে পরিচিত। বাজেটে তারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বেশি গুরুত্ব দেয়। জাপানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, স্কুল অবকাঠামো এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা হয়।

বাংলাদেশে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের প্রায় ১১ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকলেও, তা জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের নিচে, যা UNESCO-এর প্রস্তাবিত ৪-৬ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। আমাদের দরকার বাজেট বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার, দুর্নীতি রোধ এবং গবেষণা ও প্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়া।

গত ২৯ মে খবরের কাগজে প্রকাশিত ‘শিক্ষায় কমছে বরাদ্দ: মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত নিয়ে প্রশ্ন’ শিরোনামের প্রতিবেদন সূত্রে জানতে পারলাম যে আসন্ন বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে চলতি অর্থবছরের তুলনায়। উক্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আমরা লক্ষ করেছি যে, প্রায় প্রতি বছরই শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের আলোচনা, সংলাপ, সেমিনার চলে।

 কিন্তু সেসব আমলে নেওয়া হয় না। অথচ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭টি বিষয়ের মধ্যে একটি মানসম্মত শিক্ষা। যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে গুণগত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত না হওয়ায় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই নিম্নমুখী বা অবস্থান তলানিতে। ২০২৪ সালে গ্লোবাল এডুকেশন ইনডেক্সের করা তালিকায় ১৪১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৩তম। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার, তার অনেকটাই অনুপস্থিত দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নেই পর্যাপ্ত গবেষণাগার আর ল্যাব সুবিধা। এমনকি শিক্ষকদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই। 

বাংলাদেশ যদি উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে চায়, তাহলে শিক্ষাকে শুধু রাজনৈতিক অঙ্গীকার নয়, বরং বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট কাঠামোর মাধ্যমে শক্ত ভিত্তি দেওয়া উচিত। তাহলেই গড়ে উঠবে এক নতুন, শিক্ষিত এবং সচেতন বাংলাদেশ।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবারের বাজেট হবে জনবান্ধব ও বাস্তবমুখী

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ০১:০৭ পিএম
আপডেট: ০১ জুন ২০২৫, ০৯:৩৩ পিএম
এবারের বাজেট হবে জনবান্ধব ও বাস্তবমুখী
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে আগামী ২ জুন। ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এবারের বাজেটের মূল দর্শন, অগ্রাধিকার খাতসমূহ, রাজস্ব বৃদ্ধি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান এবং সংস্কার ও করনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা

খবরের কাগজ: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটের মূল দর্শন কী হবে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট হবে বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য। অর্থাৎ এবারের বাজেট বরাবরের মতো গতানুগতিক হবে না। ঋণনির্ভরতা যথাসম্ভব কমিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধির একটা উদ্যোগ থাকবে এবারের বাজেটে। একই সঙ্গে বাজেটে অযাচিত ব্যয়হ্রাস বা অপচয় রোধেরও একটা প্রচেষ্টা থাকবে। তবে এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্যই থাকবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। ইতিপূর্বে ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও সাধারণ মানুষ কার্যত এর সুফল পায়নি। কাজেই এবারের বাজেটে জনগণের জীবনমান উন্নয়নের বাস্তবায়নযোগ্য একটা প্রচেষ্টা থাকবে। বিশেষ করে নিরাপত্তাবেষ্টনী বাড়িয়ে প্রান্তিক মানুষের জীবন যাপনকে কীভাবে সহজ করা যায় তার একটি প্রচেষ্টা থাকবে এবারের বাজেটে। একই সঙ্গে বাজেটে বৈষম্য কমিয়ে সমতাভিত্তিক এবং কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নানামুখী পদক্ষেপ থাকবে। 

খবরের কাগজ: এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ কী ? চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন? 
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। আমরা আশা করছি, ৯ শতাংশের কাছাকাছি মূল্যস্ফীতি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৭ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হব। বিশ্বায়নের যুগে নানা কারণে বৈশ্বিকভাবে অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এর ফলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতেও বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। আমরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর ঋণের বোঝায় জর্জরিত ভঙ্গুর একটা অর্থনীতি পেয়েছিলাম। সেখান থেকে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন বা উন্নয়ন আমরা করতে পেরেছি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনো কাজ করছি। দেশি-বিদেশি ব্যক্তিদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করা। সরবরাহ গতিশীল রাখতে দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের একটি অংশ নানা কায়দায় চাঁদা আদায় করে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে। এরাই আবার বাজারে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করে তোলে। এদের দৌরাত্ম্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যদিও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা অর্থনীতির ব্যাপার নয়। এগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। সেক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে হলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশও অনুকূল রাখা দরকার। কিছু একটা হলেই লোকজন কাজ ফেলে রাস্তায় বসে যায়। সব দাবিদাওয়া পূরণ করা তো সরকারের পক্ষে একবারেই সম্ভব নয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথা শুনলে তখন বেসরকারি যারা আছেন তারাও বলবেন, আমরা কী দোষ করেছি? আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে একটা স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। দাবিদাওয়ার বিষয় আসতে পারে। কিন্তু কাজকর্ম ফেলে রাস্তা বন্ধ করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা, অর্থনীতির ওপরও বড় রকমের বিরূপ প্রভাব ফেলে। আগের সরকার কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই যা কিছু একটা করে দিয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করব। 

খবরের কাগজ: এবারের বাজেটে কোন কোন খাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে? 
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এবারের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হবে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। দেশের স্বাস্থ্য খাত সবসময়ই অবহেলিত থাকে। যদিও স্বাস্থ্যসেবায় টাকা কম দেওয়া হয়, তা নয়। কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়ন সেভাবে দেখা যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যন্ত্রপাতি পড়ে থাকে অথবা নষ্ট হয়, অর্থাৎ সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার হয় না বললেই চলে। এবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু মৌলিক বিষয় পরিচালনা ব্যয় বাজেটে নিয়ে আসার একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রকল্পনির্ভর না হয়ে এবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিচালনায় বাজেট বরাদ্দ বেশি হবে। শিক্ষা ও জনকল্যাণে বাজেট বরাদ্দ বাড়বে। তবে রাতারাতি সব ক্ষেত্রেই বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব নয়। সবকিছুর সঙ্গে একটা সমন্বয় করেই এবারের বাজেট তৈরি করা হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতা বাড়ানো হবে।

খবরের কাগজ: এর আগে ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজেটের আকার বড় করা হতো। সে তুলনায় এবারের বাজেট আকারে ছোট হচ্ছে। এটি কতটা যুক্তিযুক্ত মনে করেন? 
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাজেট খুব বড় হচ্ছে অথবা খুব ছোট হচ্ছে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের নামে কালক্ষেপণ, ভোগান্তি, অপচয় রোধে অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা ঋণনির্ভরতা কমিয়ে এনে অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। অর্থাৎ সার্বিকভাবে সবদিক বিবেচনায় নিয়ে একটা ‘ব্যাল্যান্স’ করেই এবারের বাজেট প্রণয়ন করা হবে। বাজেট খুব বড় না হলেও খুব বেশি ছোট হবে না। 

খবরের কাগজ: দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে আসন্ন বাজেটে কী ধরনের পদক্ষেপ থাকবে? 
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এবারের বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হবে। তবে কর্মসংস্থান বলতে আমি বলব শুধু চাকরি নয়, তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে আমরা গুরুত্ব দেব। এ ছাড়া আমাদের মূল লক্ষ্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যবসাবান্ধব একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা। দেশে তরুণদের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত করা হবে। মানুষকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার একটা প্রচেষ্টা থাকবে। এটি করা গেলে প্রত্যেক মানুষ স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পাশাপাশি বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পাবে। সে ক্ষেত্রে আমরা তরুণদের জন্য স্টার্টআপ ফান্ড ব্যবস্থা করেছি। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল আছে। প্রয়োজনে তহবিল আরও বাড়ানো হবে। আগের মতো শুধু বড় বড় প্রতিষ্ঠান সুবিধা পাবে, এমনটি আর হবে না। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। এর আগে মুষ্টিমেয় কিছু প্রতিষ্ঠান বাড়তি সুবিধা পাওয়ায় অনেক ভালো উদ্যোক্তা পিছিয়ে পড়েছেন। এবার এসব সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দেওয়া হবে। সরকারের আয় বাড়াতে বাজেট বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব করা হবে আশা করা যায়।

খবরের কাগজ: বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার কোনো সুযোগ থাকবে কি না। 
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাজেটে কালো টাকা সাদা করার কোনো সুযোগ নেই। এসব উৎস বন্ধে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নেব। একটা উদাহরণ দিয়ে আমি বলি- যে দামে জমি কেনাবেচা হয়, সে দামে জমির দলিল হয় না। ৪-৫ কোটি টাকার জমি দেখা যায় দলিলপত্রে ৭০ লাখ দেখানো হয়। আমরা বলেছি, যে দামে বিক্রি হবে সে দামেই জমির নিবন্ধন বা দলিল হবে। সেটা না হলে কেনাবেচায় দুই পক্ষই বিপদে পড়ে। অনেকে আবার দেখেছি ঘুষটুষ দিয়ে এখান থেকে পার পেয়ে যায়। এসবের মারপ্যাঁচে নানা রকম সমস্যা হয়। এ প্রবণতা বন্ধ করতে ইতোমধ্যেই আমি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেছি। এতে সবার আয় যেমন বৈধ হবে; সরকারেরও রাজস্ব বাড়বে।

খবরের কাগজ: আইএমএফ কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে কর আদায় বাড়াতে গিয়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর কোনো চাপ বাড়বে বলে আপনি মনে করেন? 
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: জনগণ যে কর দেয় তার বড় একটা অংশ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয় না। সেসব অর্থ বেশির ভাগই আদায়কারী কর কর্তাদের পকেটে চলে যায়। এ ধরনের অভিযোগও খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। কয়েক দিন আগে একজন কমিশনার ১০০ কোটি টাকা করের মধ্যে ৬০ কোটি টাকা ছাড় দেখিয়েছে। এর মধ্যে কত নিজে তিনি নিয়েছেন বা কি করেছেন তিনিই ভালো বলতে পারবেন। এসব প্রতিবন্ধকতা অনেকদিন থেকেই চলে আসছিল। এবারের বাজেটে এগুলো বন্ধ করার পাশাপাশি কর ফাঁকি বন্ধেরও উদ্যোগ থাকবে। তাছাড়া করছাড়ও কমিয়ে আনা হবে। ফলে জনগণের ওপর অকারণ বাড়তি চাপ থাকবে না। 

খবরের কাগজ: আগামী বাজেটে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিষয়ে কী কী থাকছে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: ইতোমধ্যে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়নে দুটি আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আলাদা নতুন আইন হয়েছে। এ নিয়ে নানান রকম হইচইও হয়েছে। ইতোমধ্যে আমানতকারীদের বহু টাকা বেহাত হয়েছে। দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এতে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতোমধ্যে ছয়টি ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকিগুলোও একে একে করা হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে সরকার আলাদা তহবিল গঠন করবে। অনেকেই না বুঝে সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আমরা তো বুঝেশুনেই কাজগুলো করছি। আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনীতিতে একটা গতি সঞ্চার হয়েছে। ভঙ্গুর একটা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলেও কিছুটা সময় লাগে। আমরা চেষ্টা করছি। আমি সবসময়ই বলি, কিছু কাজ, কিছু সংস্কার আমরা করে দিয়ে যাব। একটা দিকনির্দেশনা অবশ্যই থাকবে। নির্বাচন-পরবর্তী সরকার এসে যেন সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। কাজেই অযথা বিভেদ-বিভাজন সৃষ্টি না করে সহযোগিতার মনোভাব থাকতে হবে। দোষত্রুটি না খুঁজে বরং নিজেদের মধ্যে একটা ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে। 

খবরের কাগজ: দেশের ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজার প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়েছে। এ থেকে সুরক্ষা পেতে কী কী পদক্ষেপ নেবেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এটা ঠিক যে, মুদ্রানীতি ও বৈদেশিক বিনিময় হার নিয়ে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থা খুবই নেতিবাচক হয়ে গিয়েছিল। নেতৃত্বের সংকট ছিল অধিকাংশ ব্যাংকে। সেটা ধীরে ধীরে আস্থার জায়গায় ফিরে আসছে। আমরা বেশ কিছু ব্যাংকের এমডি-চেয়ারম্যানকে সরিয়ে নতুন লোক দিয়েছি। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ হয়েছে। এটা ভালো কাজে দেবে। ব্যাংক খাতের কয়েকটা দিক নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। একটা হচ্ছে সম্পদ উদ্ধার। সেজন্য একটা বিশেষ তহবিলও করা হচ্ছে। টাকা ফেরতের পাশাপাশি এ তহবিল থেকে জনহিতকর কাজ করা হবে। পাচার হওয়া বিপুল অঙ্কের অর্থ ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো ফিরিয়ে নিয়ে আসাও বেশ কঠিন কাজ। এসব কাজে কিছু জটিলতা থাকে। তবে আমরা ইতোমধ্যেই আইনি পদক্ষেপ নিয়েছি। ব্যাংকগুলোর প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ করছি। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশকে কাজে লাগানো হবে। তবে একটা কথা বলতে পারি যে, আমানতের টাকা সবাই ফেরত পাবেন। সেজন্য সময় লাগবে এবং ধৈর্য ধরতে হবে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জেনে বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। একটা ট্রেন্ড চলে এসেছিল স্টক একচেঞ্জে বিনিয়োগকারীরা ব্যবসার লভ্যাংশ নয় বরং শেয়ার বেচাকেনার একটা গেম প্ল্যান শুরু করেছিল। সেই সুযোগটা বড় ব্যবসায়ী অথবা বড় বড় জুয়াড়িরা নিয়েছে। ফলে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা মূলধন হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। বিনিয়োগকারীদেরও বুঝতে হবে শেয়ারবাজার কোনো নিয়মিত আয়ের উৎস নয়। অনেকে মনে করেন, আমি শেয়ার কিনব, মাস শেষে লাভে বিক্রি করব। এসব কোনো দেশেই চলে না। এসবের ফলে দেখা গেছে অনেকের ৮০ টাকার শেয়ার এখন ২০ টাকায় নেমে গেছে। ইতোমধ্যে আমি ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) কে ৩ হাজার কোটি টাকা দিয়েছি। তারা সেখান থেকে একটি অংশ ইন্টারেস্ট বাবদ ও একটি অংশ বাজারে বিনিয়োগ করবে বলেছে। আমি আশাবাদী শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাজারেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে।

খবরের কাগজ: এবারের বাজেট নিয়ে আপনার প্রত্যাশার কথা বলুন।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এবার বাজেট গতানুগতিক হবে না, কিছুটা ব্যতিক্রম হবে। বাজেট আকার-আয়তনে খুব বড় অথবা খুব বেশি ছোট হবে না। পর্যালোচনার মাধ্যমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাত, যেমন- শিক্ষা স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর প্রাধান্য থাকবে বাজেটে। সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের চাওয়া-পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণের দিকে লক্ষ্য রেখেই এবারের বাজেটে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হবে। যাতে করে সাধারণ মানুষ দুমুঠো খেয়েপরে স্বস্তিতে বসবাস করতে পারে। কাজেই বলা যায়,এবারের বাজেট কার্যত সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে জনবান্ধব ও বাস্তবমুখী একটি বাজেট হবে। 

খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। 
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

অর্থবছর পরিবর্তন করতে হবে

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ০১:৪১ পিএম
অর্থবছর পরিবর্তন করতে হবে
আনু মুহাম্মদ

প্রথমে বলতে চাই- অর্থবছর পরিবর্তন করতে হবে। আমরা জানি, ব্রিটিশ আমল থেকে অর্থবছর জুলাই-জুন হিসেবেই আছে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াসহ হাতে গোনা কয়েকটা দেশ এখনো অর্থবছর হিসেবে জুলাই-জুন ব্যবহার করে। বাকি সবাই তাদের নিজ দেশের পরিস্থিতি, কিংবা নিজ দেশের প্রয়োজন বা আবহাওয়া সবকিছু মিলিয়ে এটা পরিবর্তন করে। সেই হিসেবে কোথাও কোথাও জানুয়ারি-ডিসেম্বর, কোথাও কোথাও এপ্রিল-মার্চ, আবার কোথাও কোথাও মার্চ-ফেব্রুয়ারি আছে। বাংলাদেশে হতে পারে বাংলা বছর বৈশাখ-চৈত্র, ১৪ এপ্রিল-১৩ এপ্রিল অথবা হতে পারে জানুয়ারি-ডিসেম্বর। জুলাই-জুন অর্থবছরের বড় সমস্যা হলো আগের বছর যখন শেষ হয় তখন প্রচুর ঝড়বৃষ্টি থাকে। সে সময় দুর্নীতি-অনিয়মের সুযোগ বেড়ে যায়। অর্থের অপচয় হয় এবং কাজগুলো ঠিকমতো শেষও করা যায় না। সেই কারণে এটা মনে হয় পরিবর্তন হচ্ছে না। এ সরকার দায়িত্ব নিতে পারে। 

দ্বিতীয়ত, সরকারের বড় দায়িত্ব হচ্ছে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উদ্যোগ নিয়ে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের গতিপথ তৈরি করা। আমরা জানি এ সরকার অন্তর্বর্তী সরকার, এ সরকার দীর্ঘদিন থাকবে না। ফলে, তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু উদ্যোগ সরকার সহজেই নিতে পারে। যেমন- শিক্ষা ও চিকিৎসা খাত। এই দুই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি একটা বহু বছরের দাবি। অথচ এখনো সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ একেবারে নিচের দিকে। যেখানে হওয়ার কথা জিডিপির ৫-৬ শতাংশ সেখানে আছে ১-২ ভাগ। অর্থাৎ যথাযথ উদ্যোগ নিলে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ বাড়বে কয়েক গুণ। 
বর্তমানে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ খুব কম আবার তার মধ্যেও প্রচুর দুর্নীতি এবং অনিয়ম হয়।

 অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল বিদেশ সফর, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প আছে। এগুলো বাদ দিতে হবে, স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রত্যেকটা বাজেট, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তার বরাদ্দ বিস্তারিত ওয়েবসাইটে থাকতে হবে। মানুষ দেখবে- কোনটা আসল, কোনটা অপচয় বা দুর্নীতি। একটা উদাহরণ দিই- না চাইলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ করে উন্নয়ন বাবদ বরাদ্দ এল ১৫০০ কোটি টাকা। পেছনে পেছনে হাজির হলো কিছু ঠিকাদার, স্থপতি, চাঁদাবাজ। একের পর এক ভবন নির্মাণ শুরু হয়ে গেল, অপরিকল্পিত যথেচ্ছাচার। ঠিকাদাররাই সব ঠিক করছে তখন। 

আমরা মাস্টার প্ল্যান করার কথা বলছি কিন্তু ওপর থেকে আশীর্বাদ পাওয়া প্রশাসন কোনোকিছুই কানে তুলছে না। পুরো ক্যাম্পাসের বড় ক্ষতি হলো। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একই রকমভাবে অপচয় ও দুর্নীতির উৎসব চলেছে। এ ধরনের বরাদ্দ থেকে বাজেটে দেখাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ল! চিকিৎসা খাতেও এরকম অনেক কেনাকাটা হচ্ছে। মেশিনপত্র পড়ে আছে, ব্যবহার নেই। দামি যন্ত্র কেনা হয়েছে, লোক নিয়োগ করা হয়নি। ভবন নির্মাণ হয়েছে, হাসপাতাল ভবন, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এগুলোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে হবে। 

পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা সংস্কার খুব সহজ ছিল এ সরকারের জন্য। তা হচ্ছে- এটা ঘোষণা করা যে- প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সব উপদেষ্টা, বিশেষ সহকারী, রিপ্রেজেনটেটিভ, সরকারি আমলা, সবাই তাদের চিকিৎসা বাংলাদেশের পাবলিক হাসপাতালে গ্রহণ করবেন। এটা করলে পাবলিক হাসপাতালে জাদুর বাক্সের মতো পরিবর্তন হয়ে যেত। এবং সেই সঙ্গে যদি তারা সিদ্ধান্ত জানাতেন যে, তাদের সন্তানরা বাংলাদেশের পাবলিক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তাহলে দেখতে পেতেন এগুলোর চেহারাও পরিবর্তন হয়ে যেত। এ সূচনাটা তারা সহজেই করতে পারতেন। কিন্তু এর কোনো লক্ষণ নয় মাসেও আমরা দেখতে পাইনি। বাজেটের আগে এ ধরনের ঘোষণা হলে বরাদ্দের যে গুণগত দিক, তারও একটা পরিবর্তন হওয়া খুবই সহজ হতো।

আরেকটা কাজ হচ্ছে- জাতীয় সক্ষমতা। জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রশিক্ষণ, গবেষণা। জাতীয় সক্ষমতার ভিত্তিতে একটা দেশ যদি অগ্রসর না হয় তাহলে কোনো টেকসই পরিবর্তন হয় না। স্যাটেলাইট কিনে গত সরকার বাহাদুরি করল। এর জন্য সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়, এসব বাহাদুরি দেখিয়ে দেশ কখনো অগ্রসর হতে পারে না। এর বদলে এর একাংশ টাকা তারা যদি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিজ্ঞানী, গবেষকদের গবেষণা করতে দিত তাহলে বিজ্ঞান গবেষণার একটা স্থায়ী ভিত্তি তৈরি হতে পারত। সেই জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ। 

চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার কথা প্রধান উপদেষ্টা এমনভাবে ঘোষণা করলেন যে, এটা দিতেই হবে। যেকোনো মূল্যে দিতে হবে। কিংবা করিডর তৈরি করতে হবে। স্টার লিংকের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এসবই জাতীয় সক্ষমতার বিকল্প হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। এখানে চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে সরকারের কী করণীয় ছিল, কী করতে পারত? বিদেশি কোম্পানি আনতেই হবে- এরকম দৃঢ়তা না দেখিয়ে তারা যদি দৃঢ়তা দেখাতেন চট্টগ্রাম 
বন্দরে যেসব দুর্বলতা আছে, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব আছে, এগুলো দূর করার জন্য জাতীয় দক্ষতা বাড়ানো। প্রয়োজনে যদি দরকার হয় 
প্রশিক্ষণে পাঠানো বা প্রশিক্ষক নিয়ে আসা- এগুলো করতে পারতেন। 

আমাদের দরকার গ্যাস উত্তোলনে জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো। সেটার জন্য গত ৯ মাসে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সামনে বাজেটে এ বিষয়গুলো থাকতে হবে। জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিগত অবস্থানের একটা পরিবর্তন করতে হবে। শতভাগ মালিকানায় দেশের সম্পদ দেশেই ব্যবহার সম্ভব হলে নিরাপত্তা থাকবে, সুলভে গ্যাস পাওয়া যাবে, সুলভে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। তার ওপর আমরা নির্ভর করতে পারব। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যে বিশাল ভর্তুকি দেখা যাচ্ছে, তা একেবারে কমে আসবে যদি নিজেদের জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করি। সরকারের একটা সুযোগ ছিল এ কাজগুলো করে পরিবর্তন দৃশ্যমান করার।  

আমরা আগের সরকারগুলোর সময় দেখেছি যে, রেলওয়ের সৈয়দপুর, চট্টগ্রামে যেসব ওয়ার্কশপ ছিল তার জনবল কমানো হয়েছে, বহু বছরে তৈরি দক্ষ জনশক্তিকে বেকার বানানো হয়েছে। ইঞ্জিন, ওয়াগন, বগি সবকিছু আমদানি করা হচ্ছে। অথচ ওয়ার্কশপ যদি শক্তিশালী করা হতো তাহলে বাংলাদেশেই রেলের বগি, ইঞ্জিন নির্মাণ করা সম্ভব হতো। রেলওয়ে-নির্ভর একটা যোগাযোগব্যবস্থা যদি আরও বিস্তৃত হতো তাহলে অনেক অপচয়, পরিবেশদূষণ, দুর্ঘটনা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারতাম।

প্রধান উপদেষ্টার মুখে আমরা থ্রি-জিরোর কথা শুনি। তার থ্রি-জিরোর মধ্যে একটা হলো কার্বন কমানো। কিন্তু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেই যাচ্ছে। দ্বিতীয় হলো বেকারত্ব শূন্য করা। গত নয় মাসে নতুন বেকার হয়েছে লাখেরও বেশি। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। তৃতীয় হলো শূন্য দারিদ্র্য, গত ৯ মাসে ২০ লাখের বেশি দারিদ্র্য বেড়েছে। তার মানে আমরা কথা শুনছি একরকম, কাজ দেখছি আরেক রকম। 

সর্বশেষ বলতে চাই, সরকারের কাজ ছিল বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশ নির্মাণের গতিমুখ ঠিক করা। এ সরকার অস্থায়ী সরকার, এর স্থায়ী কোনো ম্যান্ডেট নেই। সুতরাং তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব নয়। সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট হয়েছে, কিছু সংস্কারের প্রত্যাশা রয়েছে এবং কিছু করণীয় আছে, যেগুলো তারা খুব সহজেই শুরু করতে পারতেন, যাতে জাতীয় সক্ষমতার ভিত্তিতে দেশ অগ্রসর হতে পারে।

লেখক: শিক্ষাবিদ