পশ্চিমবঙ্গ এক জাতিস্মরকে আপন করে নিয়েছিল ১৯৭১-এ। প্রকাশিত হয়েছিল উপন্যাস; সোনার কেল্লা। ফেলুদার সেই কীর্তি চলচ্চিত্রে হাজির হয়েছিল ১৯৭৪-এ। সেই জাতিস্মর মুকুলকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা অবিনশ্বর হয়ে আছে অসংখ্য হৃদয়ে।
চলচ্চিত্র হিসেবে সোনার কেল্লার প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তির বছরে সেই পশ্চিমবঙ্গই আর এক স্বঘোষিত জাতিস্মরের খোঁজ পেয়েছিল। সেদিন ছিল ২৬ এপ্রিল, ২০২৪। সেই ‘জাতিস্মর’ নিজের গত জন্মের কথা জানালেন মালদহে। তিনি শিশু নন, তিনি ছবি আঁকেন না। গুজরাটের ভাদনগরে জন্ম নেওয়া সেই ৭৩ বছরের বৃদ্ধ সেদিন এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে আমি আগের জন্মে এই বাংলার মাটিতে জন্মেছিলাম। না হয় পরের জন্মে আমি এই বাংলারই কোনো মায়ের কোলে জন্ম নেব।’
সেই জাতিস্মর, ভূত-ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা আর কেউ নন; তিনি নরেন্দ্র মোদি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তার ভারত-শাসনের ১১ বছর পূর্তি হয়েছে। দেশজুড়ে মোদি শাসনের ‘সাফল্যে’র প্রচার চলছে। গত জন্ম এবং পরজন্মের ঠিকানার জন্য এ জন্মে তার অবদানের সাফল্য খতিয়ে দেখার এটিই সময়। এই খতিয়ে দেখা আর একটি কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যে ১৪ বছর মমতা ব্যানার্জির শাসন চলছে। আর নরেন্দ্র মোদিই সেই ব্যক্তি, যিনি মহাকরণের বহু আকাঙ্ক্ষিত চেয়ারে বসার জন্য উদগ্রীব তৃণমূল নেত্রীকে একটি নিদারুণ পরামর্শ দিয়েছিলেন ২০১১-এর মে-তে; ‘প্রথম রাতেই বেড়াল মেরে দিন।’ পশ্চিমবঙ্গের প্রতি তার ভাবনার সেটিই প্রথম প্রকাশ।
রাজ্যে কমিউনিস্টসহ বামপন্থিদের দুর্বল করতে না পারলে আরএসএস, বিজেপির ফণা তোলার সুযোগ ছিল না। তাই মোদির সেই পরামর্শ ছিল। মমতা ব্যানার্জি এবং তার দলের নেতারা মোদির সেই পরামর্শ অনুসারেই এগিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের মদতে আরএসএস-এর শাখা-প্রশাখা বিস্তারই মোদির একমাত্র সাফল্য।
২০১৪-এর এপ্রিল। নরেন্দ্র মোদি তখনো প্রধানমন্ত্রী হননি। সিঙ্গুরে যে কারখানা হওয়ার কথা ছিল, মমতা ব্যানার্জির ‘আন্দোলনে’ ভর করে তা গুজরাটের সানন্দে পৌঁছে গেছে তার আগেই। কলকাতার একটি সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারে মোদি জানিয়েছিলেন, ‘এখন, যখন আমি গুজরাটের বাইরে এসে সারা দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করি, আমার সিঙ্গুরের জন্যও একটি ভাবনা আছে।’ সেই ‘ভাবনা’র আশ্বাস পেয়েই চিঠি লিখেছিল সিঙ্গুর শিল্প বিকাশ ও উন্নয়ন কমিটি। দিনটি ছিল ২০১৪-এর ২৮ জুলাই।
সেই চিঠির পর প্রায় ১১ বছর পার। জবাব তো দূরের কথা। ‘চিঠি মিলা হ্যায় মিত্রো’; এটুকুও জানাননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সিঙ্গুরের শিল্প বিকাশ ও উন্নয়ন কমিটির সদস্যরা চিঠিতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে পদক্ষেপের আবেদনও জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। তারা রাজ্যকে এড়িয়ে মোদিকে কিছু করতে বলেননি। কেন তারা এমন ভেবেছিলেন? কারণ, ২০১৪-এর ফেব্রুয়ারিতে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষ দুটো লাড্ডু পাবেন। এখানে বসে দিদি উন্নয়ন করবেন, আর দিল্লি থেকে আমি উন্নয়ন করব বাংলার।’
তার পর কৌশল বদলে গেল। মমতা বনাম মোদি; এ ধারণা মানুষের মধ্যে গড়ে তুলতে না পারলে, মোদি-মমতা ব্যানার্জি আসলে বন্ধু, তা স্পষ্ট হয়ে গেলে বামপন্থিদের প্রতি মানুষের আশা, সমর্থন বাড়বে; এই অঙ্কটি বুঝেই খেলতে নেমেছিলেন প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী। তাই ২০১৬-এর ২৬ মার্চ খড়গপুরের সভায় নরেন্দ্র মোদির মুখে শোনা গেল, ‘‘এমন দুর্নীতির ছবি বাংলায় দেখেছিলেন। প্রথমে সারদা, এখন ‘নারদ’। গোটা তৃণমূলের নেতৃত্ব ক্যামেরার সামনে এমনভাবে টাকা নিচ্ছেন যেন হপ্তা তুলছেন। আচ্ছা বলুন, ওরা যে টাকা নিচ্ছেন, সেটা কার টাকা। আপনাদেরই টাকা তো লুট হয়ে গেছে।’’
মোদি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের টাকা লুট নিয়ে। খুব স্বাভাবিক। সারদা, নারদ স্টিং অপারেশন, রেগা-আবাস যোজনার টাকা লুট, রেশনের চাল চুরি, কয়লা-গরু-বালি পাচার: তৃণমূল নেতা, সাংসদ, ‘জনৈক অভিষেক’সহ কারও বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত শেষই করতে পারেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো। তাহলে সেই গত জন্মের মা, পরের জন্মের জননীর জন্য কী করলেন ‘যুগপুরুষ’ নরেন্দ্র মোদি?
তৃণমূল-বিজেপির এ বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই পশ্চিমবঙ্গে নরেন্দ্র মোদির শাসনের ‘সাফল্য’কে বিচার করতে হবে। না হলে পুরো লাভ-লোকসানের তালিকা ‘জল জীবন মিশন’-এর রিপোর্টের মতো হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৫৬ শতাংশ পরিবারে পাইপলাইনের মাধ্যমে জল পৌঁছে গেছে। এ রিপোর্ট রাজ্য সরকারেরও। কিন্তু বাস্তবে কেন্দ্র-রাজ্য রিপোর্টে বিস্তর ‘জল’। হিসাবে এমন অনেক গ্রাম আছে, যেখানে দুই ধরনের সমস্যা। কোথাও পাইপ বসিয়েছে ঠিকাদার। কিন্তু জল যায়নি।
কোথাও পাইপই বসেনি। মোদি-মমতা ব্যানার্জির সরকার মিলে দেখাচ্ছে জল পৌঁছে গেছে। সম্প্রতি শিলিগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর সভা ছিল। সেখানে সভামঞ্চে চা না পেয়ে মজা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এরা এখানে চা-ও দেয় না।’ সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য চা আনতে ছুটে গেছিলেন মন্ত্রী, তৃণমূল নেতারা। কিন্তু শিলিগুড়ি যে জেলায়, সেই দার্জিলিংয়ে প্রায় ৫৩ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারে এখনো পানীয় জলের লাইনই পৌঁছায়নি। যে বাড়িগুলোতে লাইন পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে, তার একাংশে শুধু পাইপই পৌঁছেছে, জল যায় না সেই পাইপে। সংখ্যালঘু নিবিড় মুর্শিদাবাদের দাঙ্গাবিধ্বস্ত সমশেরগঞ্জের তৃণমূলের পঞ্চায়েতপ্রধানরাও স্বীকার করেছেন যে, গ্রামবাসীর একাংশ জল কিনে খান। অনেকে জল বয়ে আনেন দূর থেকে।
সম্প্রতি বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করে ৬৭ বছর পর পতিরামে সমবায় সমিতির দখল নিল তৃণমূল। ঘটনাকে ঘিরে জোর চর্চা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায়। রাজ্যে নজিরবিহীন ঘটনা, বলছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। ওই জেলার পতিরাম কো-অপারেটিভ অ্যাগ্রিকালচারাল ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের মনোনয়ন পর্ব জমার শেষ দিনেই পাঁচ ও চার আসনের সমঝোতা করে সমবায়টির দখল নেয় তৃণমূল ও বিজেপি। গোটা রাজ্যে শাসক দল তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষই বিজেপি। পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে পুরসভা, বিধানসভা থেকে শুরু করে লোকসভা নির্বাচন- সবতেই একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে। কিন্তু পতিরামের এ সমবায় নির্বাচনে তৃণমূল ও বিজেপির এমন গোপন সমঝোতা কার্যত অস্বস্তি বাড়িয়েছে উভয় শিবিরকে।
১৯৫৮ সালে গঠিত পতিরাম কো-অপারেটিভ অ্যাগ্রিকালচারাল ক্রেডিট সোসাইটির শেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৫-তে। তার পর থেকে প্রশাসকের অধীনে চলছিল সমবায়। চলতি বছরে নতুন করে নির্বাচন ঘোষিত হতেই জোরদার প্রস্তুতি শুরু হয় সব পক্ষের। কিন্তু মনোনয়ন জমার শেষ দিনে চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায়; নয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটি তৃণমূল ও চারটি বিজেপি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত।
বোঝাপড়ার জেরে ভোট পড়ার আগেই বোর্ড দখল দুই দলের। শাসকবিরোধী সমঝোতায় এমন ‘অঘটন’ অভাবনীয় বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এটি শুধুই স্থানীয় স্তরের ঘটনা নয়; এতে রাজনীতির ভবিষ্যৎ অভিমুখের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে।
যদিও এ নিয়ে কড়া মনোভাব পোষণ করেছেন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা তৃণমূল সভাপতি সুভাষ ভাওয়াল। তিনি জানান, ‘বিজেপির সঙ্গে কোনো প্রকার সমঝোতা দল মেনে নেবে না। বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ। ব্লক সভাপতির কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করা হয়েছে।’ তৃণমূলের কোথাও জনপ্রিয়তা না থাকলে সেখানে দল হারবে, কিন্তু কোনোভাবেই বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করবে না।
অন্যদিকে, বিজেপির জেলা নেতৃত্বের মুখে কুলুপ। দলের জেলা সভাপতি স্বরূপ চৌধুরীর কোনো প্রতিক্রিয়া মেলেনি। মণ্ডল সভাপতি ছোটন চক্রবর্তী অবশ্য জানিয়েছেন, বিষয়টি তার জানা নেই।
পতিরাম কো-অপারেটিভ অ্যাগ্রিকালচারাল ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের ম্যানেজার হিমালয় বিশ্বাস বলেন, এতদিন ইলেকশন হলেও এবারে সিলেকশনের মাধ্যমে সমবায় গঠিত হয়েছে। নয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটি তৃণমূল ও চারটি বিজেপি।
উভয় দলের সদস্যদের মধ্যে সমঝোতা বাইরে হয়ে থাকলে তাদের কিছু বলার থাকে না। তবে এমন ‘চুপিসাড়ে বোঝাপড়া’ মানতে নারাজ স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশও। এ নিয়ে পতিরাম পঞ্চায়েত প্রধান তথা ওই সমবায়ের সদস্য পার্থ ঘোষ জানিয়েছেন, ‘আমার জানা মতে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল।’
রাজনীতির শুদ্ধতায় এ সমঝোতা এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন। পতিরামে যা ঘটল, তা কি নিছক ব্যতিক্রম? নাকি নিচুতলার ‘ভোটের সমীকরণে’ জোটের আগাম ইঙ্গিত? আপাতত সেই উত্তর খুঁজছে গোটা জেলা।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক
চলচ্চিত্র হিসেবে সোনার কেল্লার প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তির বছরে সেই পশ্চিমবঙ্গই আর এক স্বঘোষিত জাতিস্মরের খোঁজ পেয়েছিল। সেদিন ছিল ২৬ এপ্রিল, ২০২৪। সেই ‘জাতিস্মর’ নিজের গত জন্মের কথা জানালেন মালদহে। তিনি শিশু নন, তিনি ছবি আঁকেন না। গুজরাটের ভাদনগরে জন্ম নেওয়া সেই ৭৩ বছরের বৃদ্ধ সেদিন এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে আমি আগের জন্মে এই বাংলার মাটিতে জন্মেছিলাম। না হয় পরের জন্মে আমি এই বাংলারই কোনো মায়ের কোলে জন্ম নেব।’...