রাজধানীসহ সারা দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় তাপমাত্রা বাড়ার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক উষ্ণতার পাশাপাশি স্থানীয় কারণও রয়েছে। ঢাকা শহরের সবুজ মাঠ, খোলা জায়গা ও পুকুর-খাল ধ্বংস করায় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি অনুভূত হচ্ছে। রাজধানীর ৮২ ভাগ এলাকা কংক্রিটে আচ্ছাদিত হওয়াও তাপমাত্রা বাড়ার একটি কারণ।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি) মাঝে-মধ্যেই সবুজায়নের কথা বলে। দুই সিটি করপোরেশনই ছাদবাগানের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। ছাদবাগান করলে ১০ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফের মতো প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে সংস্থা দুটি।
ভবন তৈরির নির্মাণসামগ্রী এবং কাঠামোও তাপ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়নের পাশাপাশি ঢাকায় বেশি গরম লাগার স্থানীয় কারণ আছে। একটি নগরে সবুজ ২৫ ভাগ এবং জলাধার ১৫ ভাগ থাকতে হবে। কিন্তু ২০২০ সালে আমাদের এক গবেষণায় দেখেছি, ঢাকার মোট ভূমির শতকরা ৮২ ভাগ কংক্রিটে আচ্ছাদিত। ফলে এখানে তাপমাত্রা কমানো যায় না। সবুজ ও জলাধার থাকলে তিন-চার ডিগ্রি তাপ কমে যেত।’
এক প্রশ্নের জবাবে এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘পরিবেশের কথা মাথায় না নিয়ে এয়ারটাইট উঁচু উঁচু ভবন তৈরি করা হচ্ছে। সেগুলো কাচে আচ্ছাদিত। এগুলো তাপ উৎপাদন করে। ভবন নির্মাণে যেসব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোও তাপ উৎপাদন করে। এখন থেকে ভূমি ব্যবহারের নীতিমালা ও বিল্ডিং কোড মেনে চললে ২০ থেকে ৩০ বছরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে।’
সবুজায়নে নানা প্রতিশ্রুতি, ফলাফল দৃশ্যমান নয়
সবুজায়নে নানা প্রতিশ্রুতির কথা বলছে দুই সিটি করপোরেশন। একদিকে প্রতিশ্রুতি অন্যদিকে গাছ কাটার মতো ঘটনাও বিভিন্ন সময় প্রত্যক্ষ করা গেছে। ফলে কার্যত তাপ কমার মতো কোনো পদক্ষেপ অনুপস্থিত বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।
ডিএনসিসি গত বছর ২ লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দেয়। সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এ লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষরোপণ করতে তিনটি সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা সই করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া ছাদবাগান করলে ১০ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফের মতো প্রণোদনাও দিয়েছে ডিএনসিসি (ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন)।
এ ছাড়া ডিএনসিসি এলাকায় গাছ কাটতে গেলে অনুমতি নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। যেসব গাছ সিটি করপোরেশনের এখতিয়ারভুক্ত সেসব গাছের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দেবে সিটি করপোরেশন। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন গাছ কাটার ক্ষেত্রে কোনো জবাবদিহি নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘গাছপালা উজার করে যেভাবে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, যদি এখন পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগাতে না পারি, তাহলে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এর জন্য আমাদের দায়ী করবে। তাই বিদ্যমান গাছ রেখে নতুন করে জায়গা খুঁজে বের করে বৃক্ষ রোপণের পরিকল্পনা করছি।
ছাদকৃষি করলে ১০ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফের মতো প্রণোদনা ডিএসসিসিও দিচ্ছে। তবে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বড় গাছ কাটার মতো নজিরও রয়েছে সংস্থাটির। গত বছরের শেষদিকে, পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিকদের বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজধানীর ধানমন্ডি সাত মসজিদ সড়কের গাছ কেটেছে সংস্থাটি।
সেই সময় গাছ কাটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘উন্নয়ন কাজ করতে গেলে অনেক সময় গাছ কাটতে হয়। গাছ কাটা নিয়ে কেউ কেউ মর্মাহত হতেই পারেন, কষ্ট পেতেই পারেন। এটা তাদের আবেগের বিষয়।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনের ভুল ধরিয়ে দিলাম, কিন্তু সিটি করপোরেশন কাউকে পরোয়া করল না। আমরা সেখানে চারটি গাছ লাগিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেই গাছগুলো রাখেনি, তুলে ফেলেছে। গণতন্ত্র থাকলে ডিএসসিসি এমনটা করতে পারত না।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময় জলাধার ভরাট করা হয়েছে। গাছ কাটা হয়েছে নির্বিচারে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনসহ নানা কর্তৃপক্ষ বৃক্ষরোপণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ওই পর্যন্তই। দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখি না।’